এমরান চৌধুরী
বাঙালির জীবনে বইমেলার প্রয়োজনীয়তা কতটুকু তা বইমেলায় গেলে সহজেই উপলব্ধি করা যায়। বইমেলা শুধু বই বিক্রির মেলা নয়। সব ধর্ম-বর্ণের মানুষের মিলনমেলা। আসলে এটি একটি উৎসবও। নানা ব্যস্ততার কারণে অনেক সময় অনেক প্রিয়জনের সাথে দেখা সাক্ষাৎ করার ফুরসত অনেকের হয়ে ওঠে না। হঠাৎ দেখা গেল কোনো এক স্টলে সেই প্রিয়মুখ বই নাড়াচাড়া করছে। শুরু হলো পরস্পরের কুশল বিনিময়, সে সাথে পছন্দের বইটি কেনা হলো। আর যদি বরাত ভালো থাকে দেখা হয়ে যায় বইয়ের লেখককে। বাড়তি পাওনা হিসেবে পাওয়া যায় লেখকের অটোগ্রাফ। এর চেয়ে আনন্দজনক ব্যাপার আর কী হতে পারে!
বইমেলার এ মহামিলনের জন্য দীর্ঘ এক বছর ধরে প্রস্তুতি নিয়ে থাকে লেখক, প্রকাশক, শিল্পী এবং সংশ্লিষ্টরা। আর যখন মেলা শুরু হয় অমনি প্রজাপতির মতো নেচে ওঠে বই অনুরাগী মানুষের মন। বড়দের পাশাপাশি ছোটদের আনন্দটা আরও বেশি। বইমেলাতে গেলেই এটা ওটা কোনোটাই বাদ দিতে চায় না ছোটরা। মায়ের কাছে, বাবার কাছে বায়না ধরে এই বই চাই, ওই বই কিনে দিতে হবে। রূপকথার বই, দেও দানো ভূতপ্রেতের বই, মোটোপাতলু, ডরিমনের বই সব বই যেন তাদের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া চাই। পড়ুক আর নাই পড়ুক বইয়ের প্রতি শিশুদের এ অপার আনন্দ পাল্টে দেয় মেলার পরিবেশে – মেলা যেন হয়ে ওঠে রূপকথার স্বপ্নপুরি।
বই পছন্দ করে না এমন মানুষের সংখ্যা খুবই কম। যদিও প্রযুক্তির কল্যাণে এখন নানা যন্ত্র বিনোদনসহ সব কিছুর উৎস হয়ে ওঠেছে। শিক্ষা, তথ্য, দেশবিদেশের খবরাখবর সবকিছুই। ফলে হাতে নিয়ে বইপড়া, বইকেনার সংখ্যা আগের তুলনায় অনেক কমেছে। তবে বইয়ের সাথে শিক্ষিত থেকে অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন মানুষ পর্যন্ত সবার রয়েছে আত্মার নিবিড় সম্পর্ক। যারা বই থেকে নিজেদের মন মানসিকতা গঠন এবং আত্মার খোরাক খুঁজে নেয়ার চেষ্টা করেন। বই মেধা বিকাশ এবং মানসিক পরিতৃপ্তির আশ্রয়স্থল। অক্ষরজ্ঞানহীন মানুষও বইয়ের বুকে গাথা পৃষ্ঠার অক্ষর বা ছবিতে হাত বুলিয়ে বইয়ের ভেতর বিস্তৃত সত্য ও সুন্দরের পরশ নেওয়ার চেষ্টা করে।
প্রতিটি বইয়ের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে সংশ্লিষ্টদের অর্থ, শ্রম, ভালোবাসা। তাই লেখক কিংবা প্রকাশকের কাছে সৌজন্য কপি নয় বরং সৌজন্য মূল্যে বই কিনে বইয়ের প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ ঘটানো সবার নৈতিক দায়িত্ব। কারণ চরিত্র গঠনে, সত্যভাষী নির্ভীক চিত্তের আগ্রামী প্রজন্ম বিনির্মাণে, নৈতিকতা বোধ সৃজনে, দেশপ্রেম ও মানবতাবোধ জাগাতে, সামাজিকরণে, ধর্মের প্রতি অনুরাগী করে গড়ে তুলতে যাঁরা নিজেদের শ্রম, মেধা, মননকে নিরন্তর নিয়োজিত রেখেছেন সামান্য একটা বই কিনে আমরা যদি তাদের উৎসাহিত না করি তাহলে একজন মানুষ হিসেবে, একজন দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে আমরা অবশ্যই বিবেকের কাছে অপরাধী হব। তাই প্রতি বছর আগ্রহ ভরে অপেক্ষা করে চট্টগ্রামের মানুষ, কখন শুরু হচ্ছে বইমেলা —প্রাণের মেলা।
২০১৯ সালের আগে চট্টগ্রামে বিভিন্ন জায়গায় বইমেলা হতো। চট্টগ্রামের ডিসি পাহাড়, লালদিঘি ময়দান এবং মুসলিম ইন্সটিটিউট হলে ভিন্ন ভিন্ন ব্যবস্থাপনায় বইমেলার আয়োজন করা হতো। এসব বইমেলায় না ছিল জৌলুস, না ছিল বইপ্রেমিদের স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি। সাবেক মেয়র মনজুর আলমের আমলে মুসলিম হলের বইমেলায় সম্পৃক্ত হয় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন। তখন থেকে একটি অভিন্ন বইমেলার দাবি উঠতে থাকে চট্টগ্রামের সৃজনশীল প্রকাশনা পরিষদসহ চট্টগ্রামের সাহিত্য-সংস্কৃতিসেবিদের পক্ষ থেকে। এই দাবি আরও জোরালো হয় চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ.জ.ম নাছির উদ্দীন মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর। আ.জ.ম নাছির উদ্দীন-এর পরম আন্তরিকতায় অবশেষে পূর্ণ হয় একটি অভিন্ন বইমেলার স্বপ্ন। ২০১৯ সালে আয়োজিত হয় প্রথম অভিন্ন বইমেলা, তার জন্য স্থান নির্বাচন করা হয় চট্টগ্রামের নাভি হিসেবে পরিচিত চট্টগ্রামের স্টেডিয়াম সংলগ্ন জিমনেসিয়াম চত্বর।
২০১৯ সাল থেকে চট্টগ্রামে স্টেডিয়াম সংলগ্ন জিমনেসিয়াম চত্বরে ৪ বছর বইমেলার আয়োজন করা হয়। ২০২১ সালে বৈশ্বিক মহামারিজনিত কারণে বইমেলা বসেনি। প্রতি বছর একটু একটু করে মেলাটি বেশ জমে উঠেছিল। কিন্তু বইমেলাটি পরিপূর্ণ অবয়ব পাওয়ার আগেই ছন্দপতন হলো। জেলা প্রশাসন ঐ স্থানে গত বছর বইমেলা করার অনুমতি দেয়নি। আমাদের আশা ছিল এই স্থানে স্থায়ীভাবে বছরে একবার ২০/২১ দিনের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ মাঠটি বইমেলার জন্য বরাদ্দ দেবে। শহিদ মিনারের পর এই জায়গাটি ছিল সবদিক দিয়ে নিরাপদ ও উপযুক্ত স্থান। কারণ জায়গাটির আশেপাশেই বিভিন্ন বিনোদন ও বাহারি খাবারের দোকান থাকায় কয়েক হাজার মানুষ এমনিতে থাকে। ফলে যে কোনো মেলা সহজেই জমে ওঠে। তাছাড়া মেলায় আসা যাওয়ার জন্য যে কোনো দিকে থেকে পরিবহন ব্যবস্থা সহজলভ্য। বিশেষ করে পাবলিক পরিবহনের সুবিধা প্রচুর। ফলে চকবাজার কিংবা নিউমার্কেট কিংবা বহদ্দারহাট থেকে ৫/৭ টাকায় মেলা প্রাঙ্গনে পৌঁছে যাওয়া যায়।
কিন্তু গত বছর মেলার স্থান নির্ধারণ করা হয় সিআরবি-তে। বইমেলার জন্য যে জায়গাটি নির্বাচন করা হয়েছিল তাতে বইমেলা মোটের ওপর জমে ওঠেনি। কারণ নিরাপত্তা ও যোগাযোগ ব্যবস্থার দিক দিয়ে জায়গাটি বইমেলার জন্য মোটেই অনুক‚ল নয়। তারপর মাঠটি ছিল মূল সড়ক থেকে অনেক নিচে, যাতে সহজে বইপত্র আনা নেওয়ার সুযোগ ছিল না। আমাদের বড় দুর্ভাগ্য যে বইমেলার মতো একটি সৃজনশীল কর্মকাÐে বিগত সরকার যতটুকু আন্তরিক হওয়া দরকার তার ধারে কাছে ছিল না। ভুলে গেলে চলবে না, সুস্বাস্থ্যের জন্য খেলাধুলা যেমন প্রয়োজন তেমনি বই পাঠও প্রয়োজন। কেননা শারীরিকভাবে ভালো থাকা মানে স্বাস্থ্য নয়, মানসিকভাবে ভালো থাকাও জরুরি। একমাত্র বইই পারে মানুষকে সর্বোত্তম মানসিক সার্পোট দিতে। একারণে বর্তমান প্রশাসনের কাছে আমাদের আবেদন থাকবে হয় বইমেলা আগের মতো জিমনেসিয়াম মাঠে আয়োজন করার।
আশা করব চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসন এবং বর্তমান চসিক মেয়র ডা.শাহাদাত হোসেন চট্টগ্রামের সৃজনশীল প্রকাশক ও বইপ্রেমীদের স্বার্থের কথা আন্তরিকভাবে বিবেচনা করে এ বিষয়ে যথাযথ ভূমিকা রাখবেন। চট্টগ্রামের স্বার্থে, বইমেলার স্বার্থে, সৃজনশীল প্রকাশকদের বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে বইমেলা জিমনেসিয়াম মাঠের মতো জায়গায় স্থায়ীভাবে স্থান নির্বাচনে রাখবেন সর্বোচ্চ আন্তরিকতার প্রয়াস।
লেখক : শিশুসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক