প্রসঙ্গ: কোরবানির প্রাসঙ্গিক কথন

1

এমরান চৌধুরী

বছর ঘুরে আমাদের দ্বারপ্রাপ্নে সমাগত জিলহজ্জ মাস। জিলহজ্জ মাসের ১০ তারিখে নিখিল মুসলিম দুনিয়ায় ভাবগম্ভীর পরিবেশে পালিত হবে ঈদুল আজহা। ঈদুল আজহা নামাজের পর দেওয়া হয় কোরবানি।
কোরবানি ইসলাম ধর্মের অন্যতম একটি নিদর্শন। পবিত্র কোরআনের সূরা কাউসার-এর দ্বিতীয় সংখ্যক আয়াতে মহান রাব্বুল আলামীন বলেছেন, ‘তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশে নামাজ আদায় করো ও পশু কোরবানি করো।’ কোরবানি পশুর রক্ত প্রবাহিত করার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জিত হয়। পবিত্র কোরআনের সূরা হজ্জ্ব, ৩৭ সংখ্যক আয়াতে আল্লাহ পাক বলেন, ‘আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না কোরবানির গোশত এবং রক্ত, বরং পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া।’ আল্লাহর প্রিয় হাবিব, হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আল্লাহ তাআলার নিকট কোরবানির দিন মানবজাতির কোরবানি অপেক্ষা অধিকতর পছন্দনীয় কোনো আমল নেই।’ (তিরমিজি, হাদিস : ১৩৯১)
উপর্যুক্ত আয়াত ও হাদিসে স্পষ্ট কোরবানির অপরিহার্যতা ও গুরুত্ব। সুতরাং ইসলামের অন্যতম নিদর্শন এই ইবাদতটি সম্পাদনের মূল উপলক্ষ কোরবানির পশু কেনা বা নির্বাচনের ক্ষেত্রে আমাদের সর্বাধিক সতর্কতা ও সচেতনতা অবলম্বন করতে হবে। গরুর বাজারে গিয়ে হুটহাট করে গরু একটা কিনে নিলেই হবে না। যা-ই কিনেন তা নির্বাচনে রয়েছে কয়েকটি অপরিহার্য শর্ত।
কোরবানি দিতে হবে শরিয়ত মোতাবেক। শরিযত যে ধরনের পশু অনুমোদন করে সেগুলো দিয়েই কোরবানি করতে হবে। মানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোনো মূল্য এখানে নেই। কোরবানির জন্য যে সব পশুর কথা শরিয়তে উল্লেখ করা হয়েছে তা হলো: উট, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, দুম্বা ইত্যাদি । এ ধরনের পশুকে কোরআনের ভাষায় বলা হয় ‘বাহিমাতুল আনআম’ অর্থাৎ ‘অহিংস্র গৃহপালিত চতুষ্পদ জন্তু’। এই ছয় প্রকার পশু ছাড়া অন্য কোনো পশু দ্বারা কোরবানি করা যায় না।
আবার এসব পশু কত বছর বয়সী হতে হবে তাও নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। কোরবানির জন্য ছাগল, ভেড়া ও দুম্বার বয়স এক বছর হতে হবে। গরু ও মহিষের বয়স দুই বছর এবং উটের বয়স পাঁচ বছর হতে হবে। দুম্বার এক বছর পূর্ণ না হলেও যদি দেখতে এক বছরের মতো স্বাস্থবান ও সবল হয় তাহলে কোরবানি দেওয়া যাবে। উল্লিখিত পশুগুলো নর, মাদি বা বন্ধ্যা যা-ই হোক তা দ্বারা কোরবানি শুদ্ধ হবে।
হাদিসের আলোকে কোরবানির পশু স্বাস্থ্যবান হওয়া উত্তম। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সবল, নিখুঁত ও উত্তম পশু দ্বারা কোরবানি করতেন এবং খুঁতবিশিষ্ট পশু কোরবানি করতে নিষেধ করেছেন।
কোরবানি পশু হতে হয় সুস্থ, সবল ও দেখতে সুন্দর। কারণ এর সাথে জড়িয়ে আছে হযরত ইব্রাহিম আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আত্মত্যাগের সুমহান দৃষ্টান্ত। কোরবানির পশু কেনার সময় তাই সর্বোচ্চ সতর্কতা ও সচেতনতার পরিচয় দিতে হয়। নিচের যে কোনো একটি খুঁত থাকলে সে পশু দিয়ে কোরবানি করা বৈধ নয়।
১. খোঁড়া পশু: যে পশু তিন পায়ে চলে, এক পা মাটিতে রাখতে পারে না।
২. রোগা পশু : যে পশু জবাইয়ের স্থান পর্যন্ত হেঁটে যেতে পারে না বা নেওয়া যায় না।
৩. দন্তহীন পশু: যে পশুর একটি দাঁতও নেই বা এত বেশি দাঁত পড়ে গেছে যে, ঘাস বা খাদ্য চিবাতে পারে না।
৪. শিং ছাড়া পশু: যে পশুর শিং একেবারে গোড়া থেকে ভেঙ্গে গেছে। তবে যে পশুর অর্ধেক শিং বা কিছু শিং ফেটে বা ভেঙ্গে গেছে বা শিং একেবারেই ওঠেনি তা দ্বারা কোরবানি করা বৈধ।
৫. লেজ-কান কাটা: যে পশুর লেজ বা কোনো কানের অর্ধেক বা তারও বেশি কাটা সে পশুর কোরবানি জায়েজ নয়। আর যদি অর্ধেকের বেশি থাকে তাহলে তার কুরবানি জায়েজ আছে। তবে জন্মগতভাবেই যদি কান ছোট হয় তাহলে অসুবিধা নেই।
৬. যে পশুর দুটি চোখই অন্ধ বা এক চোখ পুরো নষ্ট।
কোরবানি করার নিয়তে ভালো পশু কেনার পর যদি তাতে এমন কোনো দোষ ধরা পড়ে তাহলে ওই পশুর কুরবানি অনুচিত। এমনটি হলে আরেকটি পশু কোরবানি করতে হবে। তবে ক্রেতা বা ক্রেতাগণ গরিব হলে, দ্বিতীয় পশু কেনার সামর্থ্য না থাকলে ত্রুটিযুক্ত পশু দ্বারাই কুরবানি করতে পারা যাবে।
এবার দেখা যাক, কোরবানি কাদের ওপর ওয়াজিব? সহজ কথায়, যাদের ওপর জাকাত ওয়াজিব, তাদের ওপর কোরবানিও ওয়াজিব। প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন ওই মুসলিম নর-নারীর ওপর কোরবানি ওয়াজিব। যে ব্যক্তি ১০ জিলহজ্ব ফজর থেকে ১২ জিলহজ্ব সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়ের মধ্যে নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক। সোনার ক্ষেত্রে সাড়ে সাত তোলা সোনার মালিক হলেই তাকে নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক বলে গণ্য করা হবে আর রুপার ক্ষেত্রে সাড়ে বায়ান্ন তোলা। টাকা-পয়সা ও অন্যান্য বস্তুর ক্ষেত্রে সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপার মূল্যের সমপরিমাণ অর্থ বা এমন জিনিস যার মূল্য সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপার মূল্যের সমপরিমাণ বা বেশি হয়। কোনো ব্যক্তির কাছে যদি সোনা বা রুপা কিংবা টাকা-পয়সা এগুলোর কোনো একটি পৃথকভাবে নিসাব পরিমাণ নাও থাকে, কিন্তু একাধিক বস্তু মিলে সাড়ে সাত তোলা সোনা বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপার মূল্যের সমপরিমাণ হয়ে যায় তাহলে তার ওপর কোরবানি করা ওয়াজিব। ধরুন,কারো কাছে এক তোলা সোনা ও সামান্য কিছু টাকা আছে, যার কোনো একটিও পৃথকভাবে নিসাব পরিমাণ নয়। কিন্তু এক তোলা সোনার মূল্য ও সামান্য টাকাকে একত্র করলে সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপার মূল্যের বেশি হয়ে যায়। যেহেতু সোনার মূল্য অনেক বেশি, তাই কারো কাছে এক তোলার কিছু কম সোনা ও সঙ্গে কিছু টাকা থাকলেই সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপার সমপরিমাণ হয়ে যায়। ফলে তিনি নিসাবের মালিক বলে গণ্য হবেন এবং তার ওপর কোরবানি ওয়াজিব হবে।
উল্লিখিত আলোচনা দ্বারা বোঝা যায়, আমাদের দেশে অনেক নারীর ওপরই কোরবানি ওয়াজিব, যেহেতু তাদের সবার কাছে কমবেশি গহনা থাকে। কিন্তু তাদের পক্ষ থেকে কোরবানি দেওয়া হয় না। আবার এমন অনেক পুরুষ আছেন, যার ওপর মূলত কোরবানি ওয়াজিব নয় (ওয়াজিব তার স্ত্রী/কন্যার ওপর)। কিন্তু তার পক্ষ থেকেই কোরবানি দেওয়া হয়।
কোরবানির সঙ্গে নিহিত আছে আল্লাহ পাকের প্রতি আমাদের ভালবাসা, আনুগত্য, নৈকট্য ও আত্মত্যাগের নিদর্শন। তাই কোরবানি করতে গিয়ে কোরবানি যথাযথ নিয়মেই করতে হবে। আল্লাহ পাক আমাদের সবাইকে সঠিক পশু ও শরীয়ত মোতাবেক কোরবানি করার তৌফিক দান করুন।

লেখক : শিশুসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক