প্রশাসনকে কঠোর হতে হবে

1

দেশে ‘মব সন্ত্রাস’ বা গণপিটুনির মাধ্যমে বিশৃঙ্খলা বা অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টির ঘটনা চলছেই। সরকার যদিও বলছে মব সন্ত্রাস বন্ধের জন্য তারা কাজ করছেন এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কঠোর হাতে তা দমন করছেন, বাস্তবে আইন-শৃঙ্খরা বাহিনীর সামনে অনেক ক্ষেত্রে আইন-শঙ্খলা বাহিনীকে জিম্মি করেও মব সন্ত্রাসের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। এতে দেশ এক অনিবার্য বিশৃঙ্খলার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, যা আগামী নির্বাচনকেও অনিশ্চিত করে তুলতে পারে। গত মাসে হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) এক প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ৯ মাসে দেশে অন্তত ১৩১ জন মব সন্ত্রাসের শিকার হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন এবং আহত হয়েছেন দেড় শতাধিক ব্যক্তি। সাম্প্রতিক সময়ে একজন সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের দুজনের (বাবা-ছেলে) ওপর মব সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটেছে এবং সারা দেশে তা তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। গতকাল একটি জাতীয় দৈনিকে (ইংরেজি) অনলাইন বাংলা ভার্সনে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, চব্বিশের ৫ আগস্টের পর থেকে দেশে বেড়েই চলেছে মবের ঘটনা। কোথাও বাড়ি-ঘরে হামলা, কোথাও পিটিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটছে। এমন পরিস্থিতিতে নীরব প্রশাসন। স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তায় দেশের পরিবেশ নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত মব সহিংসতায় অন্তত ১৭৪ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে বহু মানুষ। এই পরিসংখ্যান প্রকাশের পর গতকাল কুমিল্লার মুরাদনগরে একই পরিবারের তিনজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এর বাইরে জুনে এমন আরো কয়েক জায়গায় পিটিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। এমন সব হত্যাকান্ডের ঘটনায় দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতিও প্রশ্নের মুখে পড়েছে। এভাবে প্রকাশ্যে সংঘবদ্ধভাবে পিটিয়ে মানুষ হত্যার ঘটনায়, মৃত্যুর ঘটনায় দায় কার এই প্রশ্ন সামনে এসেছে। মব তৈরি করে মানুষ হত্যা বা নির্যাতনের ঘটনাগুলোর জন্য মামলা এবং যথাযথ বিচারিক উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না বলেও মনে করছেন মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরা। বিশেষজ্ঞদের মতে, মব সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ না করাই এই পরিস্থিতির মূল কারণ। দুর্বৃত্তরা নিজেদের হাতে আইন তুলে নিচ্ছে, যা সমাজে অস্থিরতা বাড়াচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক মনে করেন, মব সন্ত্রাসকে জামিন অযোগ্য অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করে এর ইন্ধনদাতা ও নেতৃত্বদানকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি ইনামুল হক সাগর অবশ্য বলছেন, যারা আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত সাপেক্ষে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, ‘অপরাধী যত বড়ই হোক, মব জাস্টিস বা উচ্ছৃঙ্খল জনতার বিচার সমর্থনযোগ্য নয়। আদালতে পুলিশের উপস্থিতিতে কিভাবে আসামিরা হেনস্তা হন, সে বিষয়েও তিনি প্রশ্ন তোলেন। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী সাবেক সিইসির ওপর হামলার ঘটনাকে অগ্রহণযোগ্য বলে মন্তব্য করেছেন এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কারো জড়িত থাকার প্রমাণ পেলে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছেন। ৩০ জন বিশিষ্ট নাগরিকের এক যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকারের নিষ্ক্রিয়তায় দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং মানবাধিকার সুরক্ষিত রাখার অঙ্গীকার প্রতিনিয়ত লঙ্ঘিত হচ্ছে। তাঁরা মব সহিংসতায় জড়িতদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ নেওয়ার আহবান জানিয়েছেন। মব সন্ত্রাস একটি গুরুতর সামাজিক ব্যাধি, যা শুধু ব্যক্তিজীবনকেই নয়, সমগ্র সমাজব্যবস্থাকে কলুষিত করছে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য সরকারের দৃঢ় পদক্ষেপ, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সক্রিয় ভূমিকা এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধি অত্যন্ত জরুরি। অপরাধীদের কঠোর শাস্তির পাশাপাশি রাজনৈতিক দলের মদদপুষ্ট মব সন্ত্রাস বন্ধে সংশ্লিষ্ট দলগুলোকেও দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। নতুবা এই সহিংসতা আরো ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারে। আমরা লক্ষ করছি, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়ার আগেই দেশব্যাপী সবকটি থানায় হামলা ও পুলিশ হতাহতের ঘটনায় এ বাহিনীটি অনেকটা আতঙ্কে দিন কেটেছে। সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর ক্রমান্বয়ে পুলিশ বহিনীকে সক্রিয় করার চেষ্টা করা হলেও এখনও পুরোপুরি জনননিরাপত্তায় তাদের অংশগ্রহণ আশানুরুপ নয়। এরমধ্যেই কারো স্বার্থে আঘাত আসলেই পুলিশের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ আসছে। এ অবস্থায় সবকিছু ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেয়া দরকার সরকারের। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে দেশের শান্তি ও অগ্রগতি। এছাড়া একটি জাতীয় নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশের জন্যও অপরিহার্য আইনশৃঙ্খলা পরস্থিতির উন্নতি। এক্ষেত্রে সরকারকে আরো কঠোর এবং কৌশলী হতে হবে। জননিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের-এ বিষয়টি সরকার বাহাদুরকে উপলব্দী করতে হবে।