প্রযুক্তির ছুঁড়ে দেওয়া চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করা কি সম্ভব

3

অধ্যক্ষ আবু তৈয়ব

কথায় আছে ‘কুইনাইন জ্বর সারাবে বটে কিন্তু কুইনান সারাবে কে?’ আবার সেই কথার ভাবকে এই প্রাযুক্তিক ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে এসে বলা হচ্ছে, ‘শজারু হওয়ার চেয়ে শিয়াল হওয়াই ভালো। ক্রমবর্ধমান ও পরিবর্তনশীল জটিল ডিজিটাল পরিস্থিতে শজারুর মত স্থির ও সংকীর্ণ মনোযোগের চেয়ে শিয়ালের মতো বুদ্ধি ক্ষিপ্রতা বেশি প্রয়োজন। যদি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এ.আই) ও রোবোটিক্স এর এই যুগে আমরা টিকে থাকতে চাই। যেখানে দ্রæত পরিস্থিতি পালটায়, নতুনত্ব ও সৃজনশীলতায় প্রাযুক্তিক কৌশলের এপস কিছু সময়ের পর পর পরিবর্তন হতে থাকে, জীবনকে আরও সহজ করার জন্য আরও স্বাচ্ছন্দভাবে জীবনকে কাটাতে পারার জন্য। এই পরিবর্তনে পরিস্থিতিও বদলাতে থাকে। যার জন্য আমাদেরকে নতুন নতুন পরিস্থিতি মোকাবেলা করে টিকে থাকতে হবে। দ্রুত সমস্যা চিহ্নিত করার সক্ষমতা অর্জন করতে হয়। ইস্যু তৈরি করে তাতে মানুষের কল্যাণে সচেতনতা ও সক্রিয় করায় দক্ষতার পরিচয় দিয়ে যেতে হয়। আর উদ্ভুত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বহুমাত্রিক ইচ্ছাকে ও দৃষ্টিভঙ্গিকে সমন্বিতকরণে নিপুন হয়ে উঠতে হয়।
মানুষ আগে, আদিকালে প্রকৃতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতো, প্রকৃতির বসে থাকতে হতো। মানুষের টিকে থাকা নির্ভর করত প্রকৃতির দয়ার উপর। কলেরার প্রাদুর্ভাবে মারা যেতে থাকলে, খরা, দুর্ভিক্ষায় প্রাণ হারাতে থাকলে মানুষের করার কিছুই থাকতো না। আবার জীবীকার জন্য সরাসরি প্রকৃতির ফলফলাদি পাওয়া না পাওয়া ও পশু শিকার করতে পারা না পারার উপর বেচেঁ থাকা নির্ভর করত। অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে মানুষ তথা তার মস্তিষ্ক এমন এক মানসিক ক্ষমতা প্রাপ্ত হতে থাকল যা দিয়ে জীবনের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে পারতে শুরু হলো। প্রাপ্ত অভিজ্ঞতার এক তথ্যের সাথে অন্য তথ্যের সম্পর্ক তৈরি করার অসীম ক্ষমতা লাভ করল। তথ্য হলো যা শ্রোতা বা দর্শকের সেই বিষয়ে সন্দেহ দূর করে বা নিশ্চিত করে। তথ্যে তথ্যে সে সম্পর্ককে আমরা জ্ঞান বলছি। জ্ঞানের বিস্তার ও প্রসার দ্রুত সঞ্চিত হতে থাকলে সেই জ্ঞানে মানুষ এক একজন প্রতিভাস হয়ে উঠতে থাকে। ফলে নিজে যেমন বদলাতে থাকে পরিবেশকেও বদলে দিতে থাকে, পরিবেশের নিয়ন্ত্রন থেকেও মুক্ত হতে থাকে। এক সময় উলটো পরিবেশকে বসে এনে ও নিয়ন্ত্রণ করে মানুষের শ্রেষ্ঠত্বকে আরও উদ্ভাসিত করে তুলতে থাকল। তার শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ হতে থাকল। মানুষ সমাজবদ্ধতা থেকেও এক সময় মুক্ত হয়ে স্বাধীন ব্যক্তি স্বত্ত¡া লাভ করল। এতে নিজস্ব ভাবনায় ও চিন্তায় জগতকে বিচার বিশ্লেষণ শুরু করলে দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে থাকে, মূল্যবোধ পাল্টাতে থাকে। এতে সে জ্ঞান বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ হতে থাকে। সেই সমৃদ্ধ জ্ঞান বিজ্ঞানের শক্তি প্রায়োগিক ক্ষেত্রে অপরিমেয় সফলতা এনে দিতে থাকল। যার জন্য আমরা এই সভ্য উন্নত প্রাযুক্তিক বিশ্বে উঠে আসতে পেরেছি। আবার এক সময় আমরা গ্রামে আর স্বস্তি পাচ্ছিলাম না। না পেয়ে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা ভোগের জন্য জীবনকে উন্নত ভাবার জন্য নগরায়নে উঠেপড়ে লাগলাম। কিন্তু সেই নাগরিক পরিবেশও জটিল হতে হতে এখন সেই পরিবেশ পাকাদালান কোটা আকাশচুম্বি ভবনের জঞ্জালে পরিণত হলো। হৃদয়হীন নাগরিক কৃত্রিম সম্পর্কের জটিলতার জৌলুসে হাঁপিয়ে উঠতে থাকে মানুষ। তখন রবীন্দ্রনাথ জঞ্জাল ও দুষিত সেই পরিবেশে নাগরিকের মানসিক যন্ত্রণায় সংবেদি হয়ে বলে উঠেন- দাও ফিরে সেই অরণ্য/ লও এই নগর…। কিন্তু প্রাযুক্তিক বিশ্বে তো গ্রামে আর শহরে কোন সীমা রেখা এখন থাকছে না, গ্রাম ও শহরের পার্থক্য গুছিয়ে যাচ্ছে, বিভেদ রেখা অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। এখন প্রযুক্তির যাদুর কাঠিতে একবিশ্ব একগ্রামে পরিণত হয়েছে। প্রযুক্তি দিয়ে এখন সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে, পেশাদারি কাজগুলোও প্রযুক্তি দিয়ে করায়ে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে। ডাক্তার, বিমান চালক, আইনি পরামর্শক থেকে শুরু করে শিল্প কলকারখানার পরিচালক, শ্রমিক, গবেষক, প্রবন্ধকার-নিবন্ধকার ইত্যাদিও রোবোটিক্স ও এ, আই দিয়ে তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে। এতে পালটে যাচ্ছে পরিস্থিতি, বদলে যাচ্ছে আমাদের মানসিকতা, চিন্তার জগত ও আবেগের জগত। এই বদলা বদলিতে আমাদের জীবনের গতিতে ভারসাম্য রাখা কি সম্ভব হচ্ছে? সম্ভব হলে চারদিকে এত অস্থিরতা, অপ-কাজ, অপ-সংস্কৃতিতে আমাদের প্রজন্মদের নিয়ে ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাচ্ছি কেন। প্রযুক্তির আগ্রাসন ও অপ-ব্যবহারের পাশাপাশি আমাদের মস্তিষ্ক, হৃদয়, আবেগ ও মানসিক শক্তি তথা বুদ্ধিমত্তা ইত্যাদিগুলোর সাথে পারস্পরিক ভারসাম্যমূলক সমন্বয় করা সম্ভব হয়ে উঠছে ন। উঠছে না বলে আমাদের সমাজে ও ব্যক্তির মধ্যে এই অস্থিরতা, এই অপ-মানুষ হয়ে যাওয়ার প্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে। ধারণার জন্য এখানে দুই একটা প্রসঙ্গ সামনে আনা হলো-
ক) আবেগ ও বুদ্ধিমত্তা তথা হৃদয়- আবেগ যেখানে উচ্ছ্বাসিত সেখানে বুদ্ধি কাজ করে না বা লোপ পায়। প্রচলিত এই ধারণা থেকে সরে আসতে হচ্ছে। আবেগকে বুদ্ধিমত্তার বিপরীতে দাঁড় করানো যাচ্ছে না এখন আর। এই ডিজিটালের প্লাবনে ভেসে না গিয়ে সৃজিনশীলতায় দক্ষতায় টিকে থাকতে হলে শুধু আবেগ দিয়ে ভাবা যেমন টিকে থাকা অসম্ভব। তেমনি আবার আবেগ ছাড়া শুধু বুদ্ধি দিয়ে চলাও অসম্ভব, একঘেঁয়েমিতে ক্লান্তি এসে আপনাকে ধসিয়ে দেবে। তাই আবেগ ও বুদ্ধিকে একে অপরের পরিপূরক করে নিতে হবে। আবেগকে বুদ্ধি তথা মস্তিষ্কের উপর বিজয় করা যাবে না বা ভাবা যাবে না। বরং আবেগি বুদ্ধিমত্তাকে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে সফল হওয়ার জন্য অন্যতম দক্ষতা হিসাবে বিবেচনা করা হয়। জরিপে আসছে শুধু আবেগ বা শুধু বুদ্ধি দিয়ে এই ডিজিটাল যুগে টিকে থাকতে চাইলে নেতৃত্বের গড়পড়তা মান অর্জন করা যায় বটে। কিন্তু আবেগময় বুদ্ধিমত্তার পর্যায় বা দুই সমন্বিত গুণকে ক্রমাগত চর্চায় রাখা সম্ভব হলে চূড়ান্তভাবে তুখোড় নেতৃত্বের গুণাবলী অর্জনের দিকে যাওয়া যায়। তাই আবেগ ও বুদ্ধির সমন্বয়ে তড়িৎকর্মা হয়ে উঠতে পারা বড় ধরণের চ্যালেঞ্জ।
খ) অনুপ্রাণিত বুদ্ধিমত্তা- বায়ু থেকে শ্বাস নেওয়া ছাড়া যেমন বেঁচে থাকা যায় না। তেমনি তথ্যে প্লাবিত হওয়ার যুগে ও প্রযুক্তির বিপ্লবের যুগে কল্যাণমুখী প্রযুক্তিকে গ্রহণ করা ছাড়া টিকে থাকা যাবে না। এই যে সময়োপযোগী প্রযুক্তি গ্রহণের মানসিকতা এটাকে বলা হচ্ছে অনুপ্রাণিত বুদ্ধিমত্তা। তা দিয়ে প্রযুক্তি ভরা বায়ু থেকে শ্বাস বা প্রযুক্তি গ্রহণের মানসিকতা তৈরি করা জরুরি। গ্রহণের বা শ্বাস নেওয়ার এই অনুপ্রাণিত হওয়ার মানসিকতা গড়ে তুলতে পারা দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ। যদি আবেগ দিয়ে প্রযুক্তিকে এড়িয়ে চলার মানসিকতা পরিহার না করি বা শুধু আবেগ সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তিতে আটকা পড়ি তবে আমরা আত্মকেন্দ্রিকতা রোগে ভোগতে থাকব। যেটা সচেতনতার অভাবে এখন, এই সময়ে দেখা যেতে শুরু করেছে। এখান থেকে সামষ্টিক লক্ষ্যের দিকে মনোযোগ বাড়াতে হবে। এর জন্য মানবিকতায় বিশ্বাস থাকাটা অপরিহার্য। একনিষ্ঠ বিশ্বস্থতা পারস্পরিক সম্পর্ক ও দলগত কাজকে ত্বরান্বিত করে। তাই কোন উদ্ভাবনকে সর্বজনীন যেমন করে তুলতে হয় তমনি সর্বসাধণের স্বার্থেই তা কাজে লাগানো যায়। যেমন করোনার অবরুদ্ধ সময়ে শিক্ষক সমাজ শিক্ষার্থীদের নিয়ে অন লাইনে মাল্টিমিডিয়া ক্লাশ নিয়ে শিক্ষাকে এগিয়ে রাখতে পেরেছিলেন। আমরা সেই সময়ে আমাদের স্ব স্ব আবেগ ও বুদ্ধিকে আত্মকেন্দ্রিক না করে সামষ্টিক ও সর্বজনীন করে তুলতে পেরেছিলাম। তাই সেই ঝুকিঁ কাটিয়ে উঠা সম্ভব হয়।
গ) বাহ্যিক বুদ্ধিমত্তা-শারীরিক সুস্থতা চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যে তিনটি অপরিহার্য অন্যতম বৈশিষ্ট্যের কথা বলা হলো এদের প্রত্যেকটি চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সাথে মানিয়ে নেয়ার দক্ষতা ও মামসিক উপযোগিতা। কিন্তু এই সবের জন্য দরকার চতুর্থ অন্যতম বাহ্য উপাদান। তা হলো বাহ্য বুদ্ধিমত্তা, যার সাথে ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য সুস্থতা, পরিপুষ্টির ব্যাপারটি জড়িত। জীববিদ্যার শাখায় এপোজেনেটিক্স নামে একটি শাখা আছে। আমাদের সার্বিক আচরণ আমাদের জিনগত। জিন নিয়ে জীব বিজ্ঞানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শাখা জেনেটিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং-এ আলোচলা করা হয়। এখানে জিন হলো তাই যা আমাদের স্বভাব বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রণ করে ও পরবর্তী বংশে তা নিয়ে যায়। জরুরি ও মনোযোগের বিষয় হলো এই জিনোমে এপোজিন নামক বিশেষ জিন থাকে। যে এপোজিনের মাধ্যমে পরিবেশ আমাদের জিনগত বৈশিষ্ট্য ও অভিব্যক্তিকে বা পরিবর্তিত পরিবেশে অভিযোজিত হতে বা তা মানিয়ে নিতে সক্ষমতাদান করে। বদলায়ে দিতে পারে আমাদের মানসিক অবস্থা। ফলে আমরাও বদলে যেতে থাকি, সুক্ষমভাবে অগোচরে। এই চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে আমাদের মন, আবেগ, পুরো দুনিয়ার সাথে বাহ্যিক শরীরের ভারসাম্যমূলক সমন্বয়ের ঐকতান ধরে রাখার নতুন পন্থাগুলো শনাক্ত করতে পারা, বোঝতে পারা ও আত্মস্থ করতে পারা অন্যতম চ্যালেঞ্জের বিষয়, যা নিয়ে সক্ষমতা অর্জন করা খুবই জরুরি। এক্ষেত্রে অবিশ্বাস্য উন্নতি হয়েছে যেমন চিকিৎসা বিজ্ঞানে,পরিধানযোগ্য ডিভাইসে, প্রতিস্থাপন যোগ্য প্রযুক্তিতে ও মস্তিষ্কের গবেষণায়। যা আমাদের সাধারণ গড় মামসিকতা ধারণা করা সম্ভব না। এখানে মানবিক সহযোগিতাকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্টিন নোয়াক বলেছেন ‘সহযোগিতা হলো গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য যা মানবজাতিকে মানবিক গুণসম্পন্ন সরল পথে ফেরাবে’। কেননা এটা মানুষ আর প্রযুক্তির মধ্যেকার সম্পর্কের জটিলতার ভেতর মানিয়ে নিতে সক্ষম করে। যা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক শৃঙখলাকে শক্তিশালী করে। এই শক্তিশালী শৃঙ্খলাই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পারে। সেই শক্তিশালী শৃঙ্খলা গড়ে তোলতে পারা বড় চ্যালেঞ্জ। এখন পরিকল্পিত ধারাবাহিকতায় ডিজিটালইজড ৪র্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জগুলো শনাক্ত করতে পারার বিশেষ গবেষণা চালিয়ে যাওয়া। সেই চিহ্নিত চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলার জন্য আবেগের সাথে বুদ্ধিমত্তাকে, অনুপ্রাণিত বুদ্ধিমত্তার সাথে বাহ্য বুদ্ধিমত্তাকে সমন্বিত করায় দক্ষতা অর্জনে নিয়মিত অপরিমেয় প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। তার অনুশীলন করে আমাদের মানসিক জাড্য দূর করে ডিজিটিলাইজড এই চতুর্থ শিল্ল বিপ্লবে পরিবর্তিত যে কোন পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নেয়ার দক্ষতা অর্জন করতে হবে। তবেই প্রযুক্তির ছুঁড়ে দেওয়া চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করা সম্ভব হবে।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট
অধ্যক্ষ- খলিলুর রহমান মহিলা (ডিগ্রি) কলেজ