প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তি

12

বাবুল কান্তি দাশ

বর্তমান সময়ে আমাদের অন্যতম সংস্কৃতি হচ্ছে পরের দোষ দেখা ও পরনিন্দা। আর এতেই ঘটে যত বিপত্তি। এই কথা খুবই সত্য যে, মনে যখনই অপরের দোষ দেখার প্রবৃত্তি এসেছে তখনই ঐ দোষ নিজের ভিতরে এসে বাসা বেঁধেছে। তখনই কালবিলম্ব না ক’রে ওই পাপপ্রবৃত্তি ভেঙ্গেচুরে ঝেঁটিয়ে সাফ্ ক’রে দিলে তবে নিস্তার, নইলে সব নষ্ট হ’য়ে যাবে। প্রবৃত্তির বশবর্তী হয়ে আমরা নিয়ত এই পাপ প্রবৃত্তিকে লালন পালন করে যাচ্ছি। ফলস্বরূপ চারদিকে অস্থিরতা, অস্থিতিশীলতা। অন্যের দোষ খুঁজতে খুঁজতে এবং পরনিন্দাচর্চা করতে করতে ভেতরে ভেতরে আমরা যে হীন এবং দুর্বল হয়ে পড়ছি তারদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। এই কাজে প্রবৃত্ত হয়ে জীবনের অনেক মূল্যবান সময় আমরা নষ্ট করে ফেলছি। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের অগ্রযাত্রা ব্যাহত করছি। আমাদের নজর যদি অন্যের কেবল কু-ই দেখে, তবে আমরা কখনই কাউকে ভালবাসতে পারবো না। আর, যে সৎ দেখতে পারে না সে কখনই সৎ হয় না। নিজে সৎ হওয়া বা থাকা মানে পারিপার্শ্বিক পরিবেশকেও সৎ করে তোলা। আর তা’তেই তৈরী হয় শান্তি স্বস্তির বাতাবরণ। আমি যদি সৎ হই আমার দেখাদেখি হাজার হাজার লোক সৎ হয়ে পড়বে।আর যদি অসৎ হই তাহলে আমাকে সমবেদনা জানাতে কেউ আসবে না, এমনকি প্রিয়জনরাও। কারণ আমি অসৎ হয়ে আমার চারদিককেই অসৎ করে ফেলেছি। তাই কাউকে কিছু বলার আগে নিজেকে পরিশুদ্ধ চলনে প্রবৃত্ত রাখা মানুষ হিসেবে শ্রেষ্ঠত্বের দাবীদার। আমাদের মন যত নির্মল হবে, চক্ষু তত নির্মল হবে, আর জগৎটা আমাদের নিকট নির্মল হয়ে ভেসে উঠবে। আমরা যাই দেখি না কেন, অন্তরের সহিত সর্ব্বাগ্রে তার ভালটুকুই দেখতে চেষ্টা করি, আর এই অভ্যাস যদি মজ্জাগত করে ফেলতে পারি জীবন তখন ভোগের থাকবে না, জীবন হয়ে উঠবে উপভোগের আনন্দের।
আমাদের ভাষা যদি কুৎসা-কলঙ্কজড়িতই হয়ে থাকে, অপরের সুখ্যাতি করতে না পারে, তবে যেন কারো প্রতি কোনও মতামত প্রকাশ না করি। আর, মনে-মনে আমরা নিজ নিজ স্বভাবকে ঘৃনা করতে চেষ্টা করি, এবং ভবিষ্যতে কুৎসা-নরক ত্যাগ করতে দৃঢ়-প্রতিজ্ঞ হই। পরনিন্দা করাই মানে পরের দোষ কুড়িয়ে নিয়ে নিজে কলঙ্কিত হওয়া; আর, পরের সুখ্যাতি করা অভ্যাসে নিজের স্বভাব অজ্ঞাতসারে ভাল হয়ে পড়ে। তাই বলে কোন স্বার্থবুদ্ধি নিয়ে অন্যের সুখ্যাতি ক’রতে যেন না যাই। তখন তা হবে খোসামদ। সে-ক্ষেত্রে মন-মুখ প্রায়ই এক থাকবে না। সেটা কিন্তু বড়ই খারাপ, আর তাতে নিজের স্বাধীন মত প্রকাশের শক্তি হারিয়ে যায়। আমরা যদি আমাদের কুপ্রবৃত্তিকে সৎপ্রবৃত্তির দিকে মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারি তাহলে সকল ক্ষেত্রে আমরা সুখকর এক জীবনের অধিকারী হয়ে উঠব। সৎ প্রবৃত্তিতে রত থেকে মানবকল্যাণে কাজ করে যান যিনি, তিনিই প্রকৃত যোগী অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ মানুষ। যাঁর আদর্শান্বিত পরাক্রমশিলতায় কাল তাঁর অনুবর্ত্তিতায় আবর্তিত হতে থাকে। বলা যেতে পারে তাঁর ভয়ে কাল নত থাকে। প্রকৃত শিক্ষায় দিতে পারে সেই শ্রেয়নিষ্ঠ আদর্শের সন্ধান। শিক্ষা যেখানে নিজের ব্যক্তিত্বকে বিনায়িত করে তুলতে পারেনি, সে যে হোক বা যাই হোক, নয় সে অনুবর্ত্তনা-অনুপ্রেরণী। এমনতরো শিক্ষায় শিক্ষিত জন সমাজ রাষ্ট্রের বিনষ্টির কারণ। ভাব যার অন্বিত সঙ্গতিতে সার্থক হয়ে ওঠেনি, ঐ ভাবনা মর্যাদাহীন, অশুভের জন্মদাতা, নয় শ্রেয়ানুদীপণী। কিম্ভূতকিমাকার মর্যাদায় প্রলুব্ধ হয়ে আত্মবিক্রয় করে চলেছে সতত, স্বার্থনিষ্ঠ উন্মাদনী উত্তেজনাকে আহŸান করে নিত্য নিয়ত। তাদের অশুভ তৎপরতা সমাজে সৃষ্টি করে অস্থিতিশীলতা। নিষ্ঠানন্দিত তপশ্চর্যায় নিমগ্ন ব্যক্তিদের জীবন হয়ে উঠে দুর্বিষহ। উর্ধ্বতনের পর-পণ্যে আত্মবিক্রয় সঙ্গতিহারা জীবন, কাল্পনিক অবাস্তব পরিকল্পনা সাধারণের দুঃখের কারণ। পদলেহন, চাটুকারিতা কখনো ব্যক্তিত্বকে বিভান্বিত করে না। সদগুণ-গ্রাহী নয় তারা দাম্ভিকতার আত্মপ্রসাদে অন্বিত। বিনয় যেখানে প্রকৃত, শ্রদ্ধাও সেখানে সলীল, বিনায়িত মর্যাদায় শ্রেয়শ্রদ্ধ সৃজনশীল মননশীল। পরিমিত, পরিণত পরস্পরানুগ বিভূষিত পদক্ষেপ, সত্তা-সম্পোষণী সার্থক সঙ্গতির জনকল্যাণের অভিক্ষেপ। করা-বলা-চলা সমন্বয়ে শ্রেয়নিষ্ঠ সার্থক সঙ্গতি, সুকেন্দ্রিক নিষ্ঠা-নিয়ন্ত্রিত ব্যক্তিত্বে থাকবে না অসঙ্গতি। তা’রা হলেন ক্ষমাশীল, ধৈর্য্যশীল, ক্ষমতায় নিরহংকার, প্রীতিপ্রবণ শ্রেয়-ধারিণী, অস্তি বৃদ্ধির আবিষ্কারক। শ্রেয়নিষ্ঠ পথ চলনায় প্রবৃত্ত হয়ে প্রবৃত্তির ঊর্ধ্বে উঠতে হবে। প্রবৃত্তির ঊর্ধ্বে উঠতে না পারলে বিবর্ধন হয় না, আর বিবর্ধন না হলে বিবর্ধিত করা যায় না। ধারণা শুদ্ধ না হলে ভাব শুদ্ধ হয় না। ভাব শুদ্ধ না হলে ভাবসিদ্ধ হওয়া যায় না। আর ভাবসিদ্ধ না হলে ভাবান্বিত করে তুলতে পারব না। শ্রেষ্ঠতম স্হানে অধিষ্ঠিত হতে হলে আজকের সময়ে দিব্যজ্ঞানের চেয়ে কাÐজ্ঞান অনেক বেশী জরুরী। কাÐজ্ঞান তৈরী হয় পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায়। নিরসন ঘটে কুপ্রবৃত্তির। শুধু ভালবাস, ভালবেসে যাওয়া। দিয়ে দিই ভালবেসে ফতুর হয়ে যাই, কিন্তু প্রত্যাশা যেন না থাকে। , যা পাবো তাতেই তৃপ্ত থাকব, কিছুরই কাঙ্গাল যেন না হই। যা পাই তাতে ভরপুর হয়ে ওঠি, প্লাবিত হয়ে ওঠি, অঢেল হয়ে ওঠি। এতেই প্রবৃত্তির নিবৃত্তি হবে। তৈরী হবে প্রশান্তির বাতাবরণ। অল্পতেই যেন সন্তোষ প্রকাশ করি। সংযম, নিয়ন্ত্রণ এবং সীমাবদ্ধতায় জীবন ভোগের হয় না, ঐ জীবন হয় উপভোগের। স্রষ্টার প্রীতি আবেশে হয়ে উঠে মহিমান্বিত। ভালবাসা যার হৃদয় জুড়ে থাকে সে তো রাজাধিরাজ, তার কোন অভাব থাকে না। তার অন্তরের পূর্ণতা অপরকেও আনন্দপূর্ণ ক’রে তোলে। কিন্তু কামনায় কাঙ্গাল হ’লে মানুষ আত্মকেন্দ্রিক হ’য়ে পড়ে। সে কেবল ভাবে-কি পেলাম না, সে কি করল না। সে অবস্থায় প্রিয়কে উপভোগ করতে পারে কমই। মনের গতি তরঙ্গের মতো কখনও উপরে ওঠে কখনও নীচে নামে। ঢেউগুলি যদি ক‚লের দিকে যায়, তাহ’লে ভাবনা নাই। ক‚লের দিকে মানে কেন্দ্রের দিকে। মন যত তাঁর দিকে ঝুঁকে থাকে, তত তাঁর প্রতি ভালবাসা জীয়ন্ত থাকে। ঢেউ-এর মত ওঠা-নামা আছেই। কবীর বলতেন- “উত্থানেরই পতন আছে কবীর কহে সাধু! ভক্তিটাকে সঙ্গে রাখিস ছাড়িস না তুই কভু।’ ভক্তি মানে, কেন্দ্রানুগ আনতি। সব সময় সচেষ্টভাবে ভক্তিটাকে অক্ষুণœ রাখতে হয়। অন্তহীন বিরহের অগ্নিদহন বুকে নিয়ে মানুষ পাওয়ার নেশায় মেতে বেভুল বাতুলের মত কত কিছুর পিছনে ছুটে চলে জীবনপথে। তার লাখো চাহিদা পূরণ হলে সে দেখে তার অন্তর ভরেনি। না পাওয়ার বেদনা তাকে আকুল আতুর করে তোলে। চিরন্তন তৃপ্তি ও শান্তি তার লাগালের বাইরে থেকে যায়। ফলকথা, জীবন জীবনেশ্বরকেই সন্ধান করে ফিরছে। জীবন -সম্বেগ, যোগাবেগ বা সুরতের এই -ই স্বধর্ম। প্রাণবল্লভকে না হলে প্রাণ বুঝি আর বাঁচে না। বাসনাবেগ লেশশূন্য শুদ্ধচিত্ত মানুষের হৃদয় মানুষের জন্য এমনতর ব্যাকুল ও পাগলপারা হয়ে উঠলে পৃথিবীর সকল কিছু নিজ নিজ সৌন্দর্যের মহিমায় মহিমান্বিত হয়ে । এই আবেগরঙিন অচ্যুত সক্রিয় উৎসাভিসারের প্রসঙ্গই দয়াল আমার দরদীয়া ভাষায়, মরমীয়া আভাসে, প্রণয়ঘন ছন্দে, মধুর মোহন মুর্তিতে তুলে ধরেছেন ‘সুরত-সাকী’ গ্রন্থে। বস্তুত, সুরত বা জীবাত্মা যখন পরমাত্মা বা মুর্ত পরম পুরুষে লগ্ন বা মগ্ন হবার জন্য উদগ্র হয়, তখনই সে প্রকৃত বান্ধবের মত, হাতধরা সাথীয়ার মত আমাদের বাঞ্ছিত লোকে এগিয়ে নিয়ে চলে। প্রবৃত্তির নিবৃত্তির জন্য প্রয়োজন আদর্শানুগ জীবন চলন। পরিমিত জীবন যাপন। যা এখন যাদুঘরে ঠাঁই নিয়েছে। লোভ মোহের এতো উদগ্রতা সেই পরিমিত জীবন যাপনকে নির্বাসনে পাঠিয়েছে। বিত্তের প্রাচুর্য চিত্তের পচন ধরিয়েছে। যার প্রেক্ষিতে কুপ্রবৃত্তির বাসনা দুর্দমনীয়। আসলে হৃদয়ের মানচিত্রে এক বড় জঙ্গির অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে ফেলেছি আমরা, তার নাম ঘৃণা। জাতির নামে, স¤প্রদায়ের নামে, গোত্রের নামে, বর্ণের নামে ক্রমাগত ঘৃণার চালান হতে থেকেছে হৃদয়ে। শিরা, উপশিরা, রক্তসরণি বেয়ে আসমুদ্র হিমাচলে কীভাবে তা ছড়িয়ে পড়েছে, আমরা যাঁরা সাধারণ নাগরিক, আন্দাজও পাইনি। দেশের সারসত্য যদি মানুষ হয়, সেই সত্যে কোথাও টান পড়ছে, টান পড়ানো হচ্ছে। এক জাতি-এক প্রাণ, একতার কথা বলব আর ক্রমাগত চাষ করব বিদ্বেষ, বিভাজন, ঘৃণার, এর চেয়ে বড় দ্বিচারিতা আর কিছু হতে পারে না। দেশ নিয়ে যদি ন্যূনতম গর্বের ভাগীদার হতে চাই, তবে তার জন্য অর্জন করতে হবে যোগ্যতা। আমরা তার জন্য প্রস্তুত? আজ এই অন্ধকার সময়ে, এই গুলিয়ে যাওয়া পরিবেশ-পরিসরে ভালবাসা সেই জরুরি অনুভূতি, যা আমাদের কুপ্রবৃত্তির নিরসন ঘটিয়ে সুস্থ করে তুলতে পারে, ভদ্র করে তুলতে পারে।

লেখক : শিক্ষক, প্রাবন্ধিক