প্রফেসর ডা. মোহাম্মদ নুরুল আমীন পিএইচডি চট্টল গর্ব এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রবাদপ্রতিম মহাপুরুষ

1

সোহেল মো. ফখরুদ-দীন

বাংলাদেশের চট্টগ্রাম জেলার চন্দনাইশ উপজেলার চন্দনাইশ গ্রামের একটি সাধারণ মুসলিম পরিবারের সন্তান অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ নুরুল আমীন, তার জীবনযাত্রা এবং চিকিৎসা সেবার মাধ্যমে দেশের মানুষের জন্য এক অমূল্য রত্নে পরিণত হয়েছেন। ১৯৩৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণকারী এই মহাপুরুষের জীবনব্যাপী সেবামূলক কাজ এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রতি তার গভীর ভালোবাসা তাকে অসংখ্য মানুষে জন্য আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তার কাজ এবং অবদান শুধু চট্টগ্রাম বা বাংলাদেশেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং আন্তর্জাতিক পর্যায়েও প্রশংসিত হয়েছে।
শৈশব ও শিক্ষা জীবন : প্রফেসর ডা. মোহাম্মদ নুরুল আমীন জন্মগ্রহণ করেন চট্টগ্রাম জেলার চন্দনাইশ গ্রামের একটি মধ্যবিত্ত মুসলিম পরিবারে। তার পিতার নাম মরহুম আলহাজ্ব আবদুছ ছামাদ, তিনি একজন সফল কৃষক এবং ব্যবসায়ী। যদিও পরিবারের আর্থিক অবস্থা সচ্ছল ছিল, তবে তারা কোনো প্রাচুর্য বা বিলাসিতার দিকে মনোযোগী ছিল না। শৈশবকাল থেকে তিনি কঠোর পরিশ্রম এবং নিয়মিত অধ্যবসায়ের মাধ্যমে লেখাপড়ার প্রতি নিবেদিত ছিলেন। তিনি চন্দনাইশ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তার শিক্ষা জীবন শুরু করেন। পরে, গাছবাড়ীয়া নিত্যানন্দ গৌরচন্দ্র হাই স্কুল থেকে ১৯৫৪ সালে মেট্রিকুলেশন এবং চট্টগ্রাম সরকারী কলেজ থেকে ১৯৫৬ সালে আই.এস.সি. পাস করেন। তারপর তিনি ঢাকার তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের একমাত্র মেডিকেল কলেজ, ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন এবং ১৯৬১ সালে এম.বি.বি.এস. ডিগ্রি অর্জন করেন।

চিকিৎসা শিক্ষা এবং প্রথম কর্মজীবন : ১৯৬১ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এম.বি.বি.এস. পাস করার পর, ১৯৬২ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমানে বাংলাদেশ) চিকিৎসা সেবায় এসিস্ট্যান্ট সার্জন হিসেবে যোগদান করেন। তার উচ্চশিক্ষার জন্য, সরকার কর্তৃক মনোনীত হয়ে ১৯৬৩ সালে তিনি যুক্তরাজ্য গমন করেন এবং লন্ডনে ডি.এল.ও. ডিগ্রি অর্জন করেন ১৯৬৪ সালে। পরবর্তীতে, তিনি ১৯৬৭ সালে এডিনবরা রয়েল কলেজ অব সার্জনস থেকে এফ.আর.সি.এস. ডিগ্রি অর্জন করেন এবং দেশে ফিরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের নাক, কান গলা বিভাগের বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ শুরু করেন।

শিক্ষাবিদ ও চিকিৎসা সেবক : প্রফেসর ডা. মোহাম্মদ নুরুল আমীন শুধু একজন চিকিৎসকই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন মহান শিক্ষক এবং গবেষক। তিনি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন এবং ১৯৬৮ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮২ সালে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে অধ্যাপক হিসেবে বদলি করা হয় এবং সেখানে তিনি নাক, কান গলা বিভাগে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। তাঁর নেতৃত্বে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ১৯৮৩ সালে ৬০ শয্যার একটি পূর্ণাঙ্গ নাক, কান গলা বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয়। এর আগে, এই বিভাগ ছিল ২৬ শয্যাবিশিষ্ট। তিনি এই বিভাগের উন্নতির জন্য নিরলসভাবে কাজ করেন এবং তার শিক্ষা ও প্রশিক্ষণমূলক কর্মকান্ডের মাধ্যমে একাধারে শিক্ষার্থীদের দক্ষতা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করেন।

সাহিকের প্রতিষ্ঠা এবং সামাজিক অবদান : প্রফেসর নুরুল আমীন চিকিৎসা সেবার পাশাপাশি সমাজসেবায়ও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তিনি ১৯৮৭ সালে ‘সোসাইটি ফর এসিস্ট্যান্স টু হিয়ারিং ইম্পেয়ারড চিলড্রেন (সাহিক)’ প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংগঠনটির মাধ্যমে তিনি বধির শিশুদের পুনর্বাসন এবং তাদের চিকিৎসা সেবা প্রদানের ব্যবস্থা করেন। ১৯৯২ সালে তিনি ‘ন্যাশনাল সেন্টার ফর হিয়ারিং এন্ড স্পীচ ফর চিলড্রেন’ প্রতিষ্ঠা করেন, যা দেশের প্রথম এবং অন্যতম বৃহৎ প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত। এই কেন্দ্রটি শুধু চিকিৎসা সেবা প্রদান করেনি, বরং বধির শিশুদের শিক্ষার ব্যবস্থা করে, তাদের জীবনে স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছে। এছাড়া, তিনি ১৯৯৪ সালে “বধির ভিশুদের সমন্বিত প্রাক বিদ্যালয়” কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন, যা বধির শিশুদের জন্য বিশেষ শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

আন্তর্জাতিক খ্যাতি : প্রফেসর ডা. মোহাম্মদ নুরুল আমীনের কাজ শুধু বাংলাদেশেই নয়, আন্তর্জাতিক পরিসরেও প্রশংসিত হয়েছে। তিনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডঐঙ) বধিরতা প্রতিরোধ, প্রতিকার ও পুনর্বাসন প্রকল্পের পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন। এছাড়াও, তিনি আন্তর্জাতিক নাক, কান, গলা বিশেষজ্ঞদের গঠিত বিভিন্ন সংস্থার সদস্য। তার অবদান স্বীকৃত হয়েছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলন ও গবেষণায়।
পুরস্কার এবং সম্মাননা : তাঁর দীর্ঘ এবং অসাধারণ সেবা জীবনের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি নানা ধরনের সম্মাননা ও পদক লাভ করেছেন। ১৯৯৫ সালে ‘ম্যাবস’ কর্তৃক সমাজ সেবায় বিশেষ অবদানের জন্য ‘ক্রেষ্ট অব অনার’, ১৯৯৯ সালে ‘দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস গবেষণা পরিষদ’ কর্তৃক স্বর্ণ পদক, ২০১১ সালে ‘রোটারী ইন্টারন্যশনাল’ কর্তৃক স্বর্ণ পদক এবং ২০১৭ সালে ‘সার্ক ই.এন.টি. এন্ড হেড এন্ড নেক সার্জারী এসোসিয়েশন’ কর্তৃক লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট গোল্ড মেডেল অর্জন করেছেন। এছাড়া, তিনি ২০১৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক সম্মানসূচক পিএইচ.ডি. ডিগ্রি লাভ করেন।
পারিবারিক জীবন : প্রফেসর ডা. মোহাম্মদ নুরুল আমীনের পারিবারিক জীবনও প্রশংসনীয়। তার স্ত্রীর নাম অধ্যাপক ডা. আনোয়ারা খাতুন, যিনি একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা। তাদের দুই ছেলে, বড় ছেলে ডা. মোহাম্মদ আরশাদুল আমীন বর্তমানে যুক্তরাজ্যে চক্ষু বিশেষজ্ঞ হিসেবে কর্মরত এবং ছোট ছেলে ডা. মোহাম্মদ আহসানুল আমীন কানাডায় হেলথ ইকোনমিস্ট হিসেবে কাজ করছেন।
বর্তমান অবস্থা : বর্তমানে প্রফেসর ডা. মোহাম্মদ নুরুল আমীন মহাখালীতে তার প্রতিষ্ঠিত সাহিক-এ চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তার দীর্ঘ চিকিৎসা জীবনের নানা পর্যায়ে তাকে অসংখ্য রোগী, ছাত্র, সহকর্মী এবং সমাজের মানুষ সমীহ করে এসেছে। তার অমূল্য অবদান পৃথিবীজুড়ে মানবকল্যাণে বিরাজমান থাকবে।
শেষকথা : প্রফেসর ডা. মোহাম্মদ নুরুল আমীনের জীবন একটি অনুপ্রেরণার গল্প। তিনি তার কঠোর পরিশ্রম, নিষ্ঠা, এবং সেবা করার প্রতিজ্ঞায় দেশ ও জাতিকে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি উপহার দিয়েছেন। তার কাজ, গবেষণা, ও সমাজসেবার মাধ্যমে তিনি চট্টগ্রামসহ সমগ্র বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে চিরকাল অ¤øান স্মৃতি হয়ে থাকবেন। আমি তাঁর সুস্থতা কামনা করছি।

লেখক : ইতিহাসবেত্তা ও সভাপতি, বিএইচআরপি