প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে শোকজ মেয়রের

1

নিজস্ব প্রতিবেদক

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) ৪১নং ওয়ার্ডের ৫১৫/এ/৫৯৪ নং হোল্ডিংয়ের বার্ষিক মূল্যায়নে অনিয়মের মাধ্যমে করের মূল্য কমানোর অভিযোগ উঠেছে। এতে চসিকের বিপুল পরিমাণে রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে। অথচ প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম দায়িত্ব পালনকালেও কোনো প্রকার ব্যবস্থা নেননি। এমনকি দোষীদেরও শনাক্ত না করায় তিনি দায়িত্ব পালনে অবহেলা করেছেন। ফলে গতকাল সোমবার সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন স্বাক্ষরিত একটি আদেশে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে আগামী ১৫ দিনের মধ্যে ব্যাখ্যা করতে বলা হয়।বিষয়টি পূর্বদেশকে নিশ্চিত করেন মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন।
নোটিশ সূত্রে জানা যায়, ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরের এ মূল্যায়নে ফিল্ড বুকে ঘষামাজা করে ২৫ কোটি ৬৭ লাখ ৪ হাজার ৭৫০ টাকা থেকে ২০ কোটি টাকা কমিয়ে ৫ কোটি ৬৭ লাখ ৪ হাজার ৭৫০ টাকার মূল্যায়ন দেখানো হয়। একইভাবে, ৩৮নং ওয়ার্ডের ৩১৮/৩৩১ নং হোল্ডিংয়ের ফিল্ড বুকে ঘষামাজা করে ২৬ কোটি ৩৮ লাখ ১৯ হাজার ২৫০ টাকা থেকে ২০ কোটি টাকা কমিয়ে ৬ কোটি ৩৮ লাখ ১৯ হাজার ২৫০ টাকার মূল্যায়ন দেখানো হয়। এরপর, রিভিউ এসেসম্যান্ট বোর্ডের মাধ্যমে ৫৮ লাখ টাকা এবং ২ কোটি টাকায় চ‚ড়ান্ত নিষ্পত্তি করা হয়। এই ঘষামাজা এবং মূল্য কমানোর ফলে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হয়েছে। অভিযোগটি প্রথম ২০২৩ সালের ২৮ উত্থাপন করা হলেও, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম চলতি বছরের (২০২৫) গত ৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কোন পদক্ষেপ নেননি। এই কারণে, দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়নি এবং রাজস্ব আয় ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। এরপর গত ৬ সেপ্টেম্বর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা প্রশিক্ষণের জন্য কর্মস্থল ত্যাগ করলে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের বর্তমান কর্তৃপক্ষ দ্রæততার সাথে তদন্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করে এবং অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। এছাড়া, এসেসম্যান্ট রিভিউ বাতিলপূর্বক পুনঃরিভিউ করার নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে।
মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন পূর্বদেশকে বলেন, এই অনিয়মের তদন্তে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের অনিয়ম রোধ করতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
এর আগে গত ১৬ ফেব্রæয়ারি দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রধান কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. মনিরুজ্জামান স্বাক্ষরিত একটি আদেশে চসিক’র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলামের বিরুদ্ধে অনিয়ম, দুর্নীতি, ঘুষ বাণিজ্য ও সরকারি অর্থ আত্মসাতসহ নামে-বেনামে জ্ঞাত আয় বহির্ভুত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধানের নির্দেশ প্রদান করেন। যা চলতি বছরের ২৬ ফেব্রæয়ারি দৈনিক পূর্বদেশে প্রকাশিত হয়েছে।
সে আদেশে বলা হয়েছিল- ‘অভিযোগটি দুদক, সজেকা (সম্মিলিত জেলা কার্যালয়), চট্টগ্রাম-১ থেকে অনুসন্ধান করার নিমিত্ত কমিশন কর্তৃক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। এর প্রেক্ষিতে অভিযোগটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা নিয়োগের জন্য কমিশন কর্তৃক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। এ অবস্থায় বিধি মোতাবেক নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অনুসন্ধান সম্পন্ন করে প্রতিবেদন প্রেরণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।’
দায়ের করা অভিযোগটিতে উল্লেখ করা হয়, ‘চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম অনিয়ম দুর্নীতির সাথে জড়িত থাকলেও দীর্ঘদিন যাবৎ ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। এক সময়ে টানাপোড়নের সংসার ছিল তাদের। এখন তিনি বিপুল অর্থ সম্পদের মালিক। অনিয়ম দুর্নীতির মাধ্যমে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনে আত্মীয় স্বজনদের চাকরি দিয়েছেন। যোগদানের পর থেকে ক্রয় সংক্রান্ত দুর্নীতির সাথে জড়িত হয়ে যান। ফাইলে জটিলতা দেখিয়ে আর্থিক সুবিধা নেন। দপ্তরে ফাইল গেলেই আমলাতান্ত্রিক জটিলতা তৈরি করে অনৈতিকভাবে আর্থিক সুবিধা নেন সেবাপ্রার্থীদের কাছ থেকে। বেশ কয়েকবার বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় এবং গণমাধ্যমে তার দুর্নীতির খবর প্রকাশিত হয়েছে। এরপরও তিনি বহাল তবিয়তে আছেন। তার দপ্তর যেন টাকা আয়ের কারখানা। সীমাহীন দুর্নীতি, টেন্ডার বাণিজ্য, সরকারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে গুপ্তচর হিসেবে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানানো হয়। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রতিটি ফাইলে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা সৃষ্টি করে বিভিন্ন স্তরের সুবিধাভোগীদের মুঠোফোনে কল দিয়ে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। যার কারণে চট্টগ্রামের উন্নয়নে ব্যাঘাত সৃষ্টি হচ্ছে। এই কর্মকর্তার আরও অনেক ফিরিস্তি চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের নথিপত্রের মধ্যে লিপিবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। শুধু তাই নয়, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়রের একান্ত গোপন বিষয়াদি বিভিন্ন মহলে আলোচনা সৃষ্টি করে ভাবমূর্তি নষ্ট করছেন এই কর্মকর্তা। তৌহিদুলের গ্রামের বাড়ি ফটিকছড়িতে। তার এমন বিরামহীন দুর্নীতির ফলে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সুনাম খ্যাতি হারানোর পাশাপাশি জনগণ হয়রানির শিকার হচ্ছে। তিনি দীর্ঘদিন একই পদে বহাল থাকার সুবাদে গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড়। নামে-বেনামে রয়েছে একাধিক ব্যাংক একাউন্ট, নগদ টাকা ছাড়াও রয়েছে নিজ স্ত্রীর নামে রয়েছে ২টি বার্জ, ৩টি ট্রলার এবং ১টি কার্গো জাহাজ। স্ত্রীর নামে চান্দগাঁও মৌজায় চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন অনন্যা আবাসিক এলাকায় ৫ কাঠা বা ৩৫৯৮.৫৬ বর্গফুট আয়তনের ‘এ-২৫৯’ নং প্লট ৯৯ বছর মেয়াদে লিজ গ্রহণ করেন। নিজ নামে ১ কোটি ৬৫ লক্ষ টাকা ব্যয়ে নগরীর খুলশী থানাধীন চিটাগাং কো-অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটি লিমিটেডের লে-আউট প্ল্যানের প্লট নং-১/সি তে নির্মিত ‘ফয়জুন ভিস্তা’ নামক এপার্টমেন্ট ভবনের অবিভক্ত ও অচিহ্নিত ০.৭৪ শতক ভিটি ভুমি এবং উক্ত এপার্টমেন্ট ভবনের ৫ম (সি-৭) তলার পশ্চিমাংশে বি-টাইপ এপার্টমেন্টের পরিমাণ ২৩৫০ বর্গফুট এবং নিচ তলার গাড়ি পার্কিং স্পেস ১৬৫ বর্গফুটসহ মোট ২৫১৫ বর্গফুট আয়তনের ফ্ল্যাট ক্রয় করেন। তার স্ত্রী’র নামে ২০২২ সালে সদর সাব-রেজিস্ট্রি অফিস, চট্টগ্রামের দলিল নং- ৩০৪৫, তারিখ-১৫/০১/২২ইং মূলে চট্টগ্রাম জেলার ডবলমুরিং থানাধীন আগ্রাবাদ মৌজায় ১০ শতাংশ বা ৫ গন্ডা জমি ক্রয় করেন। অতঃপর উক্ত জমির উপর ১০তলা আবাসিক ভবন নির্মাণ করেন। এছাড়াও চট্টগ্রামের খুলশীতে স্ত্রীর নামে দুটি ফ্ল্যাট ও বহদ্দার হাট পুলিশ বক্সের সাথে ১০ শতাংশ জায়গা রয়েছে। যার আনুমানিক মূল্য ৩ কোটি টাকা। তার নিজের নামে একটি জিপ গাড়ি ও একটি টয়োটা-এফ প্রিমিয়ো গাড়ি রয়েছে। স্ত্রী ও ছেলে-মেয়েদের ব্যবহারের জন্য রয়েছে একটি প্রাইভেট কার ও একটি জিপ গাড়ি। তিনি টাকার হিসাব গোপন রাখতে গ্রামের বাড়িতে তার ভাইয়ের নামে প্রায় ২০ বিঘা জমি ক্রয় করেছেন। যার আনুমানিক মূল্য প্রায় ১২ কোটি টাকা। তার আপন ছোট ভাইয়ের নামে সদর জয়েন্ট পাহাড়তলী থানাধীন উত্তর হালিশহর মৌজায় ৬০ শতক নাল জমি ক্রয় করেন। ভালভাবে খোঁজ করলে তার নিজের নামে ও পরিবারের সদস্যদের নামে আরও প্রচুর অবৈধ সম্পদ পাওয়া যাবে।’
চসিক সূত্রে জানা যায়, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলামের বিরুদ্ধে হালিশহর ফইল্যাতলী কিচেন মার্কেটের দোকান বরাদ্দ দেওয়া নিয়ে বিশাল আর্থিক অনিয়মের অভিযোগসহ স্থানীয় কাউন্সিলর অধ্যাপক ইসমাইলের সংশ্লিষ্টতায় বড় অংকের টাকা লেনদেনের বিষয়টা চসিক কার্যালয়ে আলোচনায় রয়েছে। পাশাপাশি তৌহিদুলের একচ্ছত্র আধিপত্যে অস্থায়ী একজন প্রকৌশলীকে সেবক কলোনি নির্মাণ প্রকল্পের পিডি নিয়োগের মতো চাকরির বিধিমালা লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে। সেটা নিয়ে প্রকৌশল বিভাগে নানারকম গুঞ্জনও আছে। ওই সেবক কলোনির গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাস্তবায়নে কৃত্রিম স্থবিরতা নিয়েও রয়েছে তৌহিদুলের মৌন সমর্থন, যার ফলে চসিকের উন্নয়ন কাজে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়।