প্রধান উপদেষ্টাকে বিএনপির চিঠিতে যা আছে

4

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে দেওয়া ‘দেশে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে দ্রæত করণীয় কিছু বিষয়ে মতামত ও পরামর্শ’ শীর্ষক চিঠিতে বিএনপি শুরুতেই উল্লেখ করেছে, ‘বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন, সামরিক স্বৈরশাসনের অবসানে ৯০’র ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের পথ ধরে প্রায় ১৬ বছরের স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে জনগণের অবিরাম লড়াইয়ের শেষ পর্যায়ে ২০২৪-এর জুলাই-আগস্টে ছাত্র-শ্রমিক-জনতার অভূতপূর্ব ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ে বাংলাদেশ ফ্যাসিবাদী শাসন থেকে মুক্ত হয়েছে। শাসকদের প্রধানসহ তার অসংখ্য সহযোগী পালিয়ে জীবন রক্ষা করেছে; আর অবশিষ্টরা হয় বন্দি হয়েছে, কিংবা আত্মগোপন করেছে।খবর বাংলা ট্রিবিউনের।
গতকাল বুধবার যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাতে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সই করা এই চিঠি অধ্যাপক ইউনূসকে দেওয়া হয়। দুপুর ১২টার পর যমুনায় বৈঠক শুরু হয়।
চিঠিতে বলা হয়, উল্লিখিত লড়াইয়ে প্রতিটি পর্যায়ে অসংখ্য আন্দোলনকামী মানুষ জীবন উৎসর্গ করেছে। শুধু বিগত ১৬ বছরের লড়াইয়ে ১৭শ’র বেশি বিরোধী নেতাকর্মী গুম হয়েছেন, সহস্রাধিক খুন হয়েছেন এবং ৬০ লাখেরও বেশি নেতাকর্মী আহত, পঙ্গু এবং গায়েবি মামলায় কারারুদ্ধ ও সীমাহীন হয়রানির শিকার হয়েছেন।
একমাত্র ২০২৪-এর জুলাই আগস্টের যুগান্তকারী গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্বের সামনে থাকা দুই সহস্রাধিক তরুণ ও ছাত্র-ছাত্রী, শ্রমিক এবং নারী ও শিশুসহ নানা শ্রেণি পেশার মানুষ ও রাজনৈতিক কর্মী জীবন উৎসর্গ করেছেন, আহত ও পঙ্গু হয়েছেন আরও কয়েক হাজার নারী পুরুষ-শিশু। ফ্যাসিবাদের পতন এবং গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার এমন ধারাবাহিক লড়াই যেকোনও জাতির জন্য অসীম আত্মত্যাগ ও সাহসী লড়াইয়ের এক গৌরবজনক ইতিহাস।
১৫ এপ্রিল বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এই চিঠি সদস্যরা পর্যালোচনা করেন।
বিএনপি উল্লেখ করেছে, মহান মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে গণতন্ত্র ও মানবিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রতিটি লড়াইয়ের নেতৃত্বদানকারী কিংবা গর্বিত সক্রিয় অংশীদার হিসেবে বিএনপি তার অবস্থান থেকে প্রতিটি লড়াইয়ের সুফল জনগণের জন্য কার্যকর করার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে এবং করছে।
সেই লক্ষ্যেই এবারও জুলাই-আগস্টের ছাত্র-শ্রমিক-জনতার অভ্যুত্থানের সুফল জনগণের কল্যাণে এবং তাদের আকাক্সক্ষা পূরণে নিবেদিত করার টেকসই ক্ষেত্র প্রস্তুতের লক্ষ্যে দেশের সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপরিচালনার ভার নিজ যোগ্যতায় দেশ-বিদেশে বরেণ্য, নিষ্ঠাবান, দলনিরপেক্ষ ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি হিসেবে আপনার নেতৃত্বে অন্তর্র্বতী সরকার প্রতিষ্ঠায় আমরা সমর্থন জানিয়েছি এবং দায়িত্ব পালনে আপনাকে পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছি এবং সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছি।
আপনার ও আপনার নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে প্রায় দেড়যুগ ধরে গণতান্ত্রিক অধিকারহীন জনগণের স্বাভাবিক প্রত্যাশা ছিল, যত দ্রæত সম্ভব ফ্যাসিবাদী দল, তাদের দলীয় সরকার ও তার দোসরদের আইনের আওতায় এনে তাদের গণবিরোধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার, দুর্নীতি-অনাচারের মাধ্যমে দেশের সম্পদ লুণ্ঠনকারীদের বিচার ও পাচারকৃত অর্থ পুনরুদ্ধারের, ফ্যাসিস্ট সরকারের হাতে নিহত ও আহতদের পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ, সুচিকিৎসা ও পুনর্বাসন এবং দ্রব্যমূল্য ও আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে পতিত সরকারের সব অপচক্র ও সিন্ডিকেট ধ্বংস করার পাশাপাশি যত দ্রুত সম্ভব দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়া, যাতে তারা সম্মিলিতভাবে দেশে সুষ্ঠু রাজনীতি, উন্নত অর্থনীতি এবং জনগণের মানবিক অধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিত করতে পারে।
চিঠিতে আরও বলা হয়, বিএনপি মনে করে যে জনগণের স্বার্থরক্ষা ও স্থায়ী কল্যাণ নিশ্চিত করার জন্য গণতান্ত্রিক শাসনের বিকল্প নেই। আর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সংস্কার একটি সদা চলমান অনিবার্য প্রক্রিয়া।
বিগত ফ্যাসিবাদী পতিত সরকারের মতো ‘আগে উন্নয়ন পরে গণতন্ত্র’ যেমন জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণের অপকৌশল ছিল, এখনও কিছু ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর ‘আগে সংস্কার পরে গণতন্ত্র’ তেমনই ভ্রান্ত ক‚টতর্ক।
চিঠিতে বলা হয়, এ দেশের রাজনীতি ও অর্থনীতির ইতিহাসে প্রায় সবগুলো যুগান্তকারী সংস্কার কিংবা ইতিবাচক পরিবর্তন বিএনপির হাত ধরেই এসেছে। বহুদলীয় গণতন্ত্র, সংসদীয় শাসন ব্যবস্থা, তত্ত¡াবধায়ক সরকার পদ্ধতি, স্থানীয় সরকার শক্তিশালীকরণ, বিচার বিভাগ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, দুর্নীতি দমন কমিশন গঠন, উপবৃত্তি চালুসহ নারী ও কারিগরি শিক্ষা, দেশে-বিদেশে কর্মসংস্থান, মুক্তবাজার অর্থনীতি, কৃষি উন্নয়ন, চিকিৎসাসেবা, পল্লি বিদ্যুতায়ন, অপ্রচলিত পণ্য রপ্তানি, সমুদ্র মৎস্য শিকার থেকে শুরু করে স্বেচ্ছাশ্রমে খাল-নদী খনন, গ্রাম সরকার, গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী, সমবায়, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের বিকাশ এমন হাজারো দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা যায়।
আজ যারা সংস্কারের কথা বেশি বেশি বলে এবং বিএনপিকে সংস্কারের বিপক্ষের শক্তি বলে চিহ্নিত করার অপচেষ্টা করছে—তাদের ভিশন-২০৩০ এবং রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের ৩১ দফা কর্মসূচিতে যেসব সংস্কারের প্রস্তাব করা হয়েছে ও যেসব পরিবর্তনের আকাক্সক্ষা ব্যক্ত করা হয়েছে, তার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।৩১ দফায় বিএনপি বলেছে, এসব প্রস্তাবের চেয়ে ভালো কোনও প্রস্তাব কেউ দিলে জনস্বার্থে তা সাদরে গ্রহণ করা হবে। অর্থাৎ সংস্কারের চলমান প্রক্রিয়া বিএনপির ঘোষণারই অংশ। বিএনপি মনে করে যে সব পরিবর্তনই সংস্কার নয়। সংস্কারের উদ্দেশ্য ইতিবাচক ও গঠনমূলক পরিবর্তন। এ ব্যাপারে বিএনপি সব প্রস্তাব নিয়েই যুক্তিগ্রাহ্য আলোচনাকে স্বাগত জানায়।
ইতোপূর্বে গত ২১ নভেম্বর ২০২৪ এবং ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ আমরা আপনাকে লিখিতভাবে আমাদের কিছু উদ্বেগের কথা এবং কিছু পরামর্শ জানিয়েছিলাম। দুর্ভাগ্যক্রমে সেসব বিষয়ে আপনাদের অবস্থান আমরা জানতে পারিনি, কিংবা এসব বিষয়ে কোনও আলোচনাও হয়নি।
চিঠিতে বলা হয়, আমরা দৃঢ়ভাবে মনে করি যে যেকোনও রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী ও তার সরকারের বক্তব্য ও মতামতে সমন্বয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স¤প্রতি এর কিছু ব্যতিক্রম আমাদের উদ্বিগ্ন করেছে। আমরা আপনাকে সমর্থন জানিয়েছি এবং আপনার ওপরই আস্থা রাখতে চাই। কিন্তু আপনার সরকারের কিছু ব্যক্তি এবং আপনাকে সমর্থনকারী বলে দাবিদার কিছু ব্যক্তি ও সংগঠনের প্রকাশ্য বক্তব্য ও অবস্থান জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে। আশা করি আপনি এসব বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন।
বিএনপি বলে, আমরা আগেও বলেছি এবং এখনও বলতে চাই যে দেশের জনগণকে তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার যে মহান দায়িত্ব আপনার ওপর অর্পিত হয়েছে—যত দ্রুত সম্ভব আপনি তা পালন করবেন। একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য যেসব আইন, বিধি, বিধান সংস্কারে এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোতে যেসব পরিবর্তন জরুরি, তা সম্পন্ন করার মাধ্যমে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্ভব বলে আমরা মনে করি।
চিঠিতে ‘আপনার আস্থাভাজন’ উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সই করেন।