প্রতিদিন ধনী-গরীব আড়াই হাজার মানুষের ইফতার

4

মনিরুল ইসলাম মুন্না

এক কাতারে ধনী-গরীব বসে ইফতার করা, পরে নামাজ আদায় করা হচ্ছে ইসলামের সৌন্দর্য। আর সেই সৌন্দর্য ধরে রেখেছে আনজুমান-এ-রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্টের পরিচালানাধীন ষোলশহর জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া কামিল মাদ্রাসা সংলগ্ন আলমগীর খানকাহ শরীফ। সেখানে প্রতিদিন আড়াই হাজার রোজাদারের জন্য তৈরি হয় ইফতার।
গতকাল বুধবার আলমগীর খানকাহ শরীফের দায়িত্বরত স্বেচ্ছাসেবী ও সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে এ তথ্য পাওয়া যায়।
দেখা গেছে, আছরের নামাজের পর থেকে বাড়তে থাকে ইফতার করতে আসা মানুষের সংখ্যা। সেখানে কেউ ধনী পরিবারের, আবার কেউ গরীব পরিবারের মানুষ। কারও মাঝে কোন ভেদাভেদ নাই। সামনে সারি সারি ইফতারের প্লেট সাজানো। আট রকমের বাহারি খাবার। যার মধ্যে রয়েছে- ছোলা, পিয়াজু, বেগুনি, সেমাই, ফিরনি, খেজুর, শরবত এবং জিলাপি। আর এসব তৈরিতে স্বেচ্ছাসেবকদের ব্যস্ততারও শেষ নেই।সারাদিন রোজা রেখেও কাজ করতে যেন ক্লান্তি নেই তাদের। তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে রমজান মাসে এই খানকাহ শরিফ রোজাদারদের পদচারণে মুখর থাকে। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। বরং অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার রোজাদারের সংখ্যা বেড়েছে।
অক্সিজেন এলাকা থেকে ইফতার করতে আসেন নঈম উদ্দিন। তিনি বলেন, রমজান মাস ইবাদতের মাস। এখানে আছরের নামাজের পর মিলাদ, দোয়া মাহফিল, জিকির ইত্যাদি থাকাতে আমাদের জন্য নফল ইবাদতগুলো পরিপূর্ণ হয়ে যায়। তাই মানসিক শান্তির জন্যই এখানে আসি।
স্টিলমিল বাজার থেকে আসা মো. করিম বলেন, আমি সপ্তাহে একবার হলেও আসার চেষ্টা করি। তাই আছরের নামাজের পূর্বে চলে আসি। এখানে নামাজ আদায় করার পর দোয়া ও মিলাদে অংশগ্রহণ করি। পরে ইফতারের জন্য স্বেচ্ছাসেবকদের সাথে কাজ করি। এতে মানসিক শান্তি পাই।
আানজুমান-এ-রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্টের (আনজুমান ট্রাস্ট) মুখপাত্র অ্যাডভোকেট মোছাহেব উদ্দিন বখতিয়ার বলেন, প্রতি বছর এই আয়োজন হয় স্বতঃস্ফ‚র্তভাবে। ১৯৯৪ সালের আগেও আমি ইফতারির আয়োজন দেখেছি। সে সময় মানুষ এত বেশি হতো না। প্রতি বছর ক্রমান্বয়ে রোজাদারের সংখ্যা বাড়ছে। এখানে ইফতারিতে যেসব খাবার পরিবেশন করা হয় তার সবই এখানে রান্না হয়। জামেয়ার বাবুর্চিরা প্রতি বছর রমজান মাসে অতিরিক্ত কাজ হিসেবে ইফতারি তৈরি করে দেন।
প্রস্তুতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, রোজার দুই থেকে তিন সপ্তাহ আগে থেকেই তারা ইফতার আয়োজনের প্রস্তুতি নেন। যেহেতু প্রতিবছর এই আয়োজন হয়, তাই এর জন্য কোমর বেঁধে নামার দরকার হয় না। যারা জানেন তারা নিজে থেকেই শরিক হন। কেউ ছোলা, কেউ চাল, কেউ খেসারির ডাল, কেউ জিলাপির উপকরণ, কেউ সেমাই, কেউ চিনি, খেজুর, কেউ শরবতের উপকরণ দেন। আবার অনেকেই ইফতার করতে যাওয়ার সময় নানা ধরনের ফল কিনে নিয়ে আসেন। তাও রোজাদারদের মাঝে সমানভাবে ভাগ করে দিয়ে দেওয়া হয়। মানুষ যতই বাড়–ক, তাদের তা নিয়ে কোন দুশ্চিন্তা নেই। আমাদের কাছে পর্যাপ্ত ইফতারি থাকে।
আনজুমান-এ-রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্টের অর্থ সম্পাদক কমরুদ্দিন সবুর বলেন, প্রতিদিন দুপুর ১২টায় খানকাহ শরিফের নিচতলায় দস্তরখানা বসে যায়। সব দস্তরখানা লাল রঙের। গাউছিয়া কমিটির স্বেচ্ছাসেবকরা মনপ্রাণ উজাড় করে দিয়ে এই কাজ করেন। চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে রোজাদাররা এখানে ইফতার করতে আসেন। কেউ কেউ এখানে এক দিন ইফতার করার জন্য গ্রাম থেকেও চলে আসেন। তবে এখানে কে কোত্থেকে এসেছেন তার কোনো হিসাব করা হয় না। যিনি আগে আসেন, তিনি আগে বসেন। সবার ইফতারি একই রকম। যেদিন যে আইটেম থাকে সবাইকে একই রকম আইটেম দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়। বিশেষ কোন অনুষ্ঠান হলে তখন বাড়তি কিছু আয়োজন করা হয়। দিন দিন রোজাদারের সংখ্যা বাড়ার কারণে সবাই খানকাহ শরিফে বসার জায়গা পান না। অনেক রোজাদারকে বাইরে বসে ইফতার করতে হয়। ইফতার শেষে সবাই নামাজ আদায় করে যে যার মতো চলে যান। লোকজন এখানে আগেভাগে চলে আসেন। কারণ এই আয়োজনে ইফতারের বাইরেও ধর্মীয় আলোচনা হয়। রোজাদাররা এখানে যতক্ষণ থাকেন ইবাদতের মধ্যেই থাকেন। আসরের নামাজের পর থেকে খতমে গাউছিয়া শরিফ, মিলাদ শরিফ, দোয়া, কোরআন-হাদিস নিয়ে আলোচনা, গেয়ারভী শরিফ ইত্যাদি হয়। এসব করতে করতেই ইফতারের সময় হয়ে যায়।
জানা যায়, ১৯৮৪ সালে আলমগীর খানকাহ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৯৬ সাল থেকে গণইফতারের আয়োজন করা হচ্ছে। যা এখনও চলমান রয়েছে। এটি আনজুমান পরিচালিত সর্ববৃহৎ খানাকাহ শরীফ। আওলাদে রাসুল আল্লামা হাফেজ কারী সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়ব শাহর (র.) নির্দেশে প্রতিবছর ইফতারের আয়োজন করা হয় ২৯ বা ৩০ রমজান পর্যন্ত। এ খানকাহ শরীফ থেকে প্রতি বছর দেশের সর্ববৃহৎ জশনে জুলুস বের হয় আওলাদে রাসুল আল্লামা সৈয়দ মুহাম্মদ তাহের শাহ ছাহেব ও আল্লামা পীর সাবির শাহ ছাহেবের নেতৃত্বে।