বাংলাদেশ সম্মিলিত জাগরণ জোটের মুখপাত্র ও হাটহাজারীর পুন্ডরীক ধামের অধ্যক্ষ চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে গ্রেফতার ও আদালতের জামিন না মঞ্জুরের ঘটনাকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রামে যে তান্ডব চলেছে তা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। ঘটনায় আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফের হত্যাকান্ড পুরো চট্টগ্রাম বিক্ষোভে উত্থাল হয়েছে। অপরদিকে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা তাদের গুরু চিন্ময়ের গ্রেফতারকে সহজে মেনে নিতে পারছেনা। সব মিলিয়ে চট্টগ্রামে দু’দিন ধরে আইন-শৃঙ্খলার চরম অবনতি হয়েছে। অনেকে সাম্প্রদায়িত সংঘাতের আশক্সক্ষা করলেও সর্বশেষ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও রাজনৈতিক দলগুলোর তৎপরতায় উভয়পক্ষ শান্ত হয়েছে। তবে চট্টগ্রামে সার্বিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় প্রশাসনকে সার্বক্ষণিক নজরদারি বাড়াতে হবে। চট্টগ্রাম ছাড়াও রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য জেলায় আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রমেই অবনতি হচ্ছে। অস্থিরতা, বিক্ষোভ, সংঘাত, সংঘর্ষের ঘটনা ক্রমেই বাড়ছে। বাড়ছে জনদুর্ভোগ। তবে এসব অরাজকতা দমনে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নির্লিপ্ততা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে। গত সোমবার রাজধানীর মাতুয়াইলে ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও কবি নজরুল সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীদের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়েছে। দুই ঘণ্টা ধরে চলা সংঘর্ষের সময় ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট চালানোর অভিযোগ পাওয়া গেছে। সংঘর্ষের সময় পুলিশের গুলিভর্তি একটি ম্যাগাজিন চুরি হয়েছে বলে সূত্রাপুর থানায় আট হাজার শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এর আগে ২০ নভেম্বর মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থীরা চিকিৎসকের অবহেলায় তাদের এক সহপাঠী মারা যাওয়ার অভিযোগে ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ ও সোহরাওয়ার্দী কলেজে হামলা ও ভাঙচুর করে বলে অভিযোগ রয়েছে।
এসব হামলায় একজন গুলিবিদ্ধসহ অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছে বলে জানা যায়। এর আগে ২০ নভেম্বর রাজধানীর সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকায় ঢাকা কলেজ ও সিটি কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। একই ধরনের সংঘর্ষ হয় গত রবিবার বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব টেক্সটাইল (বুটেক্স) ও ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীদের মধ্যে। এসব সংঘর্ষের ঘটনায়ও অনেক শিক্ষার্থী আহত হয় এবং দীর্ঘ সময় ধরে আশপাশের রাস্তায় যান চলাচল বন্ধ থাকে। শুধু শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ নয়, কয়েক দিন ধরে রাজধানীর অনেক রাস্তাঘাট প্রায় অচল করে দিয়ে বিক্ষোভ করেছে ব্যাটারিচালিত রিকশার চালক ও মালিকরা। উচ্চ আদালত থেকে রাজধানীতে ব্যাটারিচালিত রিকশার চলাচল তিন দিনের মধ্যে বন্ধ করার নির্দেশ দেওয়ার কারণে তারা এই বিক্ষোভ শুরু করে। সোমবারও রাজধানীর আগারগাঁওয়ে চার ঘণ্টা ধরে সড়ক অবরোধ করে রাখা হয়। এদিকে রাষ্ট্রপক্ষের আপিলের ভিত্তিতে আপিল বিভাগের চেম্বার আদালত এক মাসের জন্য হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত করেন। অন্যদিকে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের পক্ষ থেকেও আন্দোলনরত চালকদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করা হয়। গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জে থেমে থেমে চলছে শ্রমিক অসন্তোষ ও সড়ক অবরোধের ঘটনা। অন্যদিকে দেশের ইসলামপন্থী দলগুলোর একাংশ ইসলামবিদ্বেষী, ভারতীয় আগ্রাসন এবং পতিত স্বৈরাচার সরকারের দোসর আখ্যা দিয়ে দৈনিক প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধের দাবিতে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালিত হয়েছে। কিছু স্থানে পত্রিকা পোড়ানোসহ বিলবোর্ড ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটে। সোমবার বিকেল সাড়ে ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত রাজধানীর কারওয়ান বাজারসংলগ্ন প্রথম আলো পত্রিকার প্রধান কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করে বিক্ষোভকারীরা। আগের দিনও সেখানে একই রকম কর্মসূচি চলে। এ সময় প্রথম আলোর কার্যালয় ঘিরে নিরাপত্তায় ছিলেন পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা। শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষোভ-বিক্ষোভ তৈরি হতেই পারে। কিন্তু তা নিয়ে এভাবে নিজেরা সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার ঘটনায় উদ্বিগ্ন দেশের মানুষ ও অভিভাবকরা। শিক্ষার্থীদের মাঝে এ ধরনের অসহিষ্ণুতার মনোভাব প্রমাণ করে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় বড় ধরনের গলদ রয়েছে। ছাত্রদের নৈতিক শিক্ষা শূন্যের কোটায় ঠেকেছে। এছাড়া বিশেষজ্ঞদের অভিমত জুলাই বিপ্লবের পর শিক্ষার্থীদের দ্রæত ক্লাসে মনোযোগী করার যে মোটিভেশনের প্রয়োজন ছিল না হওয়ায় এখন তারা অনেকটা লাগামহীন। নেতৃত্বহীন। এ অবস্থার দ্রুত অবসান হওয়া জরুরি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং চট্টগ্রাম আদালতে সংঘটিত প্রতিটি ঘটনার গভীরে গিয়ে নিরপেক্ষ তদন্ত করতে হবে। অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। আমরা মনে করি, প্রতিটি শ্রেণি পেশার মানুষের আন্দোলনের অধিকার রয়েছে, তবে তা কোনভাবেই জনদুর্ভোগের কারণ হতে পারে না। ক্ষোভ-বিক্ষোভ প্রকাশ করতে গিয়ে মানুষ হত্যা কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না। চট্টগ্রামের আইনজীবী হত্যাসহ ঢাকায় সংঘটিত প্রতিটি ঘটনার সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করবে সরকার এমনটি প্রত্যাশা দেশবাসীর।