প্রচলিত ক্ষুদ্রঋণ ও দারিদ্র্য স্থায়ীকরণ প্রসঙ্গে

2

ডা. হাসান শহীদুল আলম

(৭ম পর্ব )
কর্পোরেট পুঁজি ক্ষুদ্রঋণের পক্ষে কেন ? (৪) ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্প দ্বারা দারিদ্র্য দূর হয় না। দারিদ্র্য দূর হওয়ার এমন একটি আশা গরিব মানুষের মনে সৃষ্টি করা হয়, যাতে তাদের মনে ক্ষোভ ও অসন্তোষ বেড়ে না উঠে এবং তারা কোন ধরনের সংগ্রাম ও আন্দোলনের পথে পা না বাড়ায়। (৫) সুদনির্ভর ব্যাংকিং ব্যবস্থার আদলে দরিদ্র মানুষকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে চক্রবৃদ্ধি মুনাফার এক ঋণদান ব্যবস্থার নাম ক্ষুদ্রঋণ। মজার ব্যাপার হচ্ছে এই চক্রবৃদ্ধি সুদের হিসাব অশিক্ষিত দরিদ্র ঋণগ্রহীতারা ধরতে পারে না। (৬) ক্ষুদ্রঋণ দরিদ্রদের থেকে ধন আহরনের পদ্মতি। গরীবরাও ঋণের বাজার হতে পারে। এটি বৃহৎ বাণিজ্যিক সংস্থা এমনকি বহুজাতিক পুঁজির বিনিয়োগ ও বাজার সংকট মোকাবেলায় একটি কার্যকর মাধ্যম হয়েছে, (৭) ক্ষুদ্রঋণের সাফল্য এক বিশাল বাজারকে বৃহৎ বিনিয়োগকারীদের সামনে হাজির করে ঃ পুঁজিবাদের রক্ষাকবজ হিসাবে ঋণ অর্থনীতির প্রসার ঘটে এবং তা এক দানবীয় আকার ধারন করে। কিন্তু তার বিনিয়োগ ক্ষেত্র হয়ে পড়েছে সংকুচিত। শিল্পোন্নত দেশের নাগরিকদের আয়ের চেয়ে ঋণ অনেক বেশি। সেই বাজারের অধিক সম্প্রসারনের সম্ভাবনা সংকুচিত হওয়ার মুখে। পুঁজি ঝুঁকেছে নানা বিপজ্জনক ফটকাবাজারি তৎপরতায়। এই সময়েই ক্ষুদ্রঋণের সাফল্য সংখ্যাগরিষ্ঠ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর এক বিশাল বাজারকে বৃহৎ বিনিয়োগকারীদের সামনে হাজির করে। (৮)ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম ভূমি সংস্কারের দাবিকে হটিয়ে দিয়েছে। ভূমি সংস্কারের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলে উৎপাদন বিকশিত হতে পারে। এর ফলে গ্রামে দরিদ্র কমে যাবে। দরিদ্র কমে গেলে ক্ষুদ্রঋণ তার ফটকা বাজার হারাবে। তাই বিশ্বব্যাপী ফটকা পুঁজির মালিকরা গ্রামাঞ্চলে ভূমি সংস্কারের বিরোধী। ক্ষুদ্রঋণ দেখিয়েছে যে, বিদ্যমান মালিকানা ব্যবস্থা অক্ষুন্ন রেখে গ্রামাঞ্চলে পুঁজির বিস্তার ঘটানো যায়।
(৯) কোন ধরনের শ্রেনী সংঘাত ছাড়াই এটি এক ধরনের বিপ্লবের প্রতিশ্রুতি দেয় ঃ ক্ষুদ্রঋণের ধারনাটি দারিদ্র্য দূরীকরণে এক ধরনের উইন-উইন অবস্থা হিসাবে দেখানো হয়, যেখানে দু’পক্ষই লাভবান হয়। এটি ধনী রাষ্ট্রগুলিকে এই নিশ্চয়তা প্রদান করে যে,ধনী দেশগুলো দারিদ্র্য দূর করতে সক্ষম হবে চলমান রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক সিস্টেমকে কোন হুমকীর মাঝে না ফেলে। অন্যভাবে বললে, কোন ধরনের শ্রেনী সংঘাত ছাড়াই এটি এক ধরনের বিপ্লবের প্রতিশ্রুতি দেয়। (১০) দারিদ্র্য সামাজিক সমস্যা নয়, ব্যক্তিগত সমস্যা- এরূপ ভ্রান্ত মতবাদ প্রচার করা হয় ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের মাধ্যমে ঃ রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রনের জন্যও এটি খুব কার্যকর একটি পন্থা। এ প্রসঙ্গে ক্ষুদ্রঋণের অন্যতম প্রধান সমালোচক মিলপোর্ড বেটম্যান বলেছেন,এই ক্ষুদ্রঋণ আন্দোলন আসলে ল্যাটিন আমেরিকায় পরিচালিত মার্কিন মুল্লুকের ‘কনটেইনমেন্ট স্ট্র্যাটেজি’ এর উপর দাঁড়িয়ে আছে বা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যার মাধ্যমে জনগনকে বাম ধারার আন্দোলন থেকে দূরে রাখা সম্ভব এই বলে যে, দারিদ্র্য আসলে কোন রাজনৈতিক সমস্যা নয়, এটি একটি ব্যক্তিগত সমস্যা। (১১) ক্ষুদ্রঋণগ্রহীতারা যদি ব্যর্থ হন, তবে এর দায়ভার শুধু তাদেরই ঃ ক্ষুদ্রঋণ এ ক্ষেত্রে একটি শক্তিশালী মাধ্যম এটা বুঝানোর জন্য যে,দরিদ্র লোকেরা নিজেরাই দারিদ্যের দুষ্টচক্র থেকে বের হয়ে আসতে পারবেন। প্রয়োজন শুধুমাত্র একটু সাহস আর ক্ষুদ্রঋণ,তবে তারা খুব সহজেই দারিদ্র্য থেকে বের হয়ে আসতে পারবেন। আর এরপরও যদি তারা ব্যর্থ হন,তবে এর দায়ভার শুধু তাদেরই।
খ) নিওলিবারেলিজম বা নব্য-উদারনীতিবাদ কি ? নিওলিবারেলিজম বা নব্য-উদারনীতিবাদ হলো একটি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নীতির মডেল যা মুক্তবাজার পুঁজিবাদের মূল্যকে গুরুত্ব দেয় এবং সরকার থেকে বেসরকারী খাতে অর্থনৈতিক কারণগুলির নিয়ন্ত্রন হস্তান্তর করতে চায়। সরকারের ক্ষমতা সীমিত করে ব্যবসায়ীদের কাছে মানুষকে জিম্মি করে রাখাই এর মূল উদ্দেশ্য। বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম ও দূর্নীতি প্রতিরোধে জনগন কোন প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। কিন্তু ভোট দিয়ে নির্বাচিত সরকারের অনিয়মের বিরুদ্ধে সাধারন জনগন গোষ্ঠীবদ্ধ প্রতিবাদ গড়ে তুলতে পারে।সরকারের গোষ্ঠীবদ্ধতাকে কাটিয়ে মানুষ একাকী সফল উদ্যোক্তা হয়ে উঠতে পারে- এই রকম কথা নিওলিবারেলিজম বা নব্য-উদারনীতিবাদ দ্বারা প্রচার করা হয়। আইএমএফ ও বিশ্ব ব্যাংক আফ্রিকার অর্থনৈতিক উন্নয়নের কথা বলে সেখান নিওরিবারেল অর্থনীতি চালু করে ১৯৮০ সালে।শুরুর দিকে এশিয়াতে ধাক্কা না লাগলেও নব্বইয়ের দশকে ‘এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট মডেল’ হিসাবে এশিয়ায় এর জোর প্রবেশ ঘটে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে নতুন নিওলিবারেল দেশ হিসাবে প্রতিষ্ঠা মানেই একটা চকচকে বিমানমন্দর, নতুন একটা ম্যাকডোনাল্ডস, ২/৩ টা বিলাশবহুল হোটেল,হাজার তিনেক এনজিও, আর একটা মার্কিন সামরিক ঘাঁটি।
গ) ক্ষুদ্রঋণ ও নিওলিবারেলিজম এর মিল কি ঃ (১) সরকারের গোষ্ঠীবদ্ধতাকে কাটিয়ে মানুষ একাকী সফল উদ্যোক্তা হয়ে উঠতে পারে- এই রকম কথা প্রচার করে নিওলিবারেলিজম। মজার ব্যাপার হচ্ছে ক্ষুদ্রঋণও ঠিক একইভাবে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের কথা বলে। নিওলিবারেলিজম-এর মতে অর্থনৈতিক বিকাশ নির্ভর করবে ব্যক্তিমানুষের দক্ষতা ও পরিশ্রমের উপর। ঠিক একইভাবে ব্যক্তিমানুষের পরিশ্রমের উপর জোর দেয় ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাগুলি।
(২) ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্প দ্বারা দারিদ্র্য দূর হয় না। দারিদ্র্য দূর হওয়ার এমন একটি আশা গরীব মানুষের মনে সৃষ্টি করা হয়, যাতে তাদের মনে ক্ষোভ ও অসন্তোষ বেড়ে না উঠে এবং তারা কোন ধরনের সংগ্রাম ও আন্দোলনের পথে পা না বাড়ায়। (৩)গরীব করা আর গরীব রাখার ব্যবস্থা বহাল রাখার জন্যই গরিবদের ঋণ দিয়ে ও উচ্চহারে সুদ নেয়া হয়। (৪) ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের মাধ্যমে গ্রামনি অর্থনীতি অনেক বেশী বাজারমুখী হয়েছে যা নিওলিবারেলিজম বা অর্থনীতির উদারীকরনের পক্ষে কাজ করে।
ঘ) ইউনূসীয় অর্থনীতি (বিশ্বব্যবস্থা,সমাজ ও অর্থনীতি নিয়ে ড. ইউনূসের ভাবনা)-এর মতে- (১) প্রতিটা মানুষ একজন উদ্যোক্তা, (২) ক্ষুদ্রঋণ পাওয়া এক ধরনের অধিকার, (৩) মানুষের মৌলিক চাহিদা রাষ্ট্র পূরণ না করে মুনাফালোভী বেসরকারী প্রতিষ্ঠান করবে। ক্ষুদ্রঋণ দরিদ্র জনগণের মৌলিক চাহিদাসমূহ ভাত, কাপড়, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা,কর্ম সংস্থান পূরণ করবে।
ঙ) ইউনূসীয় অর্থনীতি- এর ত্রুটিসমূহ ঃ উল্লিখিত তাত্তি¡ক কথাসমূহ মানুষের মনে ইচ্ছাশক্তির কাল্পনিক বিকাশ ঘটিয়ে দিলেও এর পেছনের সত্যটুকু কারো চোখে ধরা পড়ে না ঃ (১) উদ্যোক্তা হলেই যে সাফল্য ধরা দেবে তা নয় ঃ দরিদ্র বা হতদরিদ্ররা এক ধরনের উদ্যোক্তাই। কারণ তারা যে কাজ করে তার পেছনে শ্রম, চিন্তাশক্তি কোনটারই কমতি নেই। এটা কোন নতুন কথা নয়। কিন্তু উদ্যোক্তা হলেই যে সাফল্য ধরা দেবে তা নয়। দরিদ্র মানুষের গরিবী অবস্থার কারন অনেকগুলোÑ অর্থনৈতিক, সামাজিক, ব্যক্তিগত। (২)নগদ অর্থের অভাব এদের মধ্যে একটি। কিন্তু পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা, শিক্ষা, জনসংযোগ ইত্যাদির অভাবে তার উদ্যোগ সফল হয় না। (৩) দারিদ্র্যের মূল কারণগুলোকে চিহ্নিত না করে ঋণগ্রহীতার মধ্যে আশার আলো জ্বালিয়ে খুব একটা লাভ হয় না। ফলাফল দাঁড়ায়, ঋণ নিয়ে একটা দুষ্টচক্রের মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে অশিক্ষিত, স্বাস্থ্যহীন, গরিব ঋণগ্রহীতাগণ।
চ) ড. ইউনূসের বক্তব্যের সাথে বিশ্বায়নের লক্ষ্যের মিল রয়েছে ঃ (১) সামাজিক ব্যবসার নামে প্রফেসর ইউনূস যে সব ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার বিবরন দিচ্ছেন এবং বক্তব্য রাখছেন সেগুলোর সাথে বিশ্বায়নের লক্ষ্যও মিলে। (২) প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে বারাক ওবামার শান্তিতে নোবেল লাভ আর সুদনির্ভর ঋণব্যবস্থার প্রবর্তন করে ড. ইউনূসের নোবেল লাভ একই সূত্রে গাঁথা। শান্তির উদাহরণ হতে পারে লিবিয়ায় হাজার হাজার নির্দোষ মানুষের জীবন দান। অপরপক্ষে ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে গ্রামের দরিদ্র পরিবারকে ঘর তুলতে সাহায্য যেমন করা হয় তেমনি ঋণ পরিশোধ করতে না পারলে ঘর ভেংগে নেয়ার উদাহরণও কম নয়। দেখা যাচ্ছে, শান্তি প্রতিষ্ঠা না করে অশান্তি বা গণহত্যা করলে বিশ্বায়ন যেভাবে নোবেল পুরষ্কার দিচ্ছে তেমনিভাবে ক্ষুদ্রঋণ প্রদানের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন না করে দারিদ্র্য স্থায়ীকরন করলেও বিশ্বায়ন তেমনিভাবে নোবেল পুরস্কার দিচ্ছে। অর্থাৎ বিশ্বায়ন ও ক্ষুদ্রঋণের লক্ষ্য একইসূত্রে গাঁথা। (চলবে)
লেখক : ডায়াবেটিস ও চর্মযৌনরোগে ¯œাতকোত্তর
প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত চিকিৎসক, চট্টগ্রাম