ডা. হাসান শহীদুল আলম
(৬ষ্ঠ পর্ব )
ক্ষুদ্রঋণ সম্পর্কিত যে সমস্ত ভুল তথ্য সমাজে প্রচারিত হয়েছে- ছ) ক্ষুদ্রঋণ যুথবদ্ধ বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করে এবং ব্যক্তিগত বিনিয়োগকে উৎসাহিত করে। ফলে ব্যক্তিগত বিনিয়োগ অসফল হলে ভূমি অনুৎপাদিত থাকে। ফলে গ্রামে উৎপাদন বিকাশ লাভ না করে এক ধরনের ফটকাবাজার তৈরী হচ্ছে। প্রকারান্তরে একজনের বিনিয়োগ সফল হলে বিপরীতে তিনজনের বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যেহেতু ভূমি সংস্কার ছাড়া গ্রামীণ উৎপাদনের সম্ভাবনা নেই, সেহেতু ক্ষুদ্রঋণ ভ‚মি সংস্কারকে নিরুৎসাহিত করে প্রকারান্তরে গ্রামীণ উৎপাদনের বিকাশ রুদ্ধ করছে।
জ) ক্ষুদ্রঋণ সামাজিক শান্তি প্রতিষ্ঠা করে। বাস্তবে এটা সত্যি নয়। (১) ‘ক্ষুদ্রঋণ গ্রহণকারী পরিবারের ক্ষেত্রে যৌতুকের চাপ বেড়েছে : ৮২ শতাংশ ক্ষুদ্রঋণ গ্রহণকারী পরিবারের ক্ষেত্রে যৌতুকের চাপ বেড়েছে। যেহেতু এ সকল পরিবার ক্ষুদ্রঋণ সংগ্রহ করতে পারছেন সেহেতু এই সব পরিবারের মেয়েদের বিয়ের সময় পাত্রপক্ষ যৌতুকের জন্য বেশি চাপ দিচ্ছে (সচলায়তন,০৭-০৮-২০০৮)।’ (২) ক্ষুদ্রঋণ পারিবারিক সমস্যা সৃষ্টি করে : স্বামীর কাছ থেকে কিস্তি নিয়ে এনজিওতে প্রদান করতে না পারার কারনে অনেক মহিলা সদস্য আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়। অনেক সদস্যের পারিবারিক বন্ধন ভেঙ্গে যায়। ফলস্বরূপ এদের ছেলেমেয়েরা যাযাবরের মতো বড় হতে থাকে এবং অনেকেই পরবর্তীতে সন্ত্রাসী অথবা মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে।
ঝ) ক্ষুদ্রঋণ স্বাস্থ্যসেবার মান বাড়ায়, এটাও সত্যি নয়। ‘ক্ষুদ্রঋণগ্রহীতাদের স্বাস্থ্যসেবার মান বাড়েনি : ফলাফল আরো দেখায় যে, ৭১ শতাংশ ঋণগ্রহীতা পরিবার এখনো সঠিক চিকিৎসা পায় না। তারা সাধারনতঃ হাতুড়ে চিকিৎসকের কাছে যায়। এটি বাংলাদেশের পল্লী অঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবার চরম পশ্চাৎপদতার প্রতিফলন এবং ক্ষুদ্রঋণ এ ক্ষেত্রে তেমন সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারেনি। যারা স্বাস্থ্যসেবা মোটামুটি গ্রহণ করতে পারছে তাদের একটা বড় অংশ আবার এটাও জানিয়েছেন যে, ক্ষুদ্রঋণ গ্রহণের পর তাদের স্বাস্থ্যসেবায় যে উন্নতি ঘটেছে তার প্রধান কারণ হলো সরকারী-বেসরকারী জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম ও স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার সুবিধা, ক্ষুদ্রঋণ গ্রহণের কারণে নয় (সচলায়তন, ৭-৮-২০০৮)।’
ঞ) ক্ষুদ্রঋণ শিক্ষার উন্নতি ঘটায়, এটাও সঠিক প্রমানিত হয়নি। ‘শিক্ষার যেটুকু উন্নতি তা ক্ষুদ্রঋণ গ্রহণের কারণে নয় : বিশেষতঃ মেয়ে সন্তানদের শিক্ষার ক্ষেত্রে যেটুকু উন্নতি হয়েছে তা হয়েছে প্রধানতঃ সরকারী-বেসরকারী প্রচারনা এবং তাদের দেয়া আর্থিক সহযোগীতা ও সুবিধার কারনে (সচলায়তন, ৭-৮-২০০৮)।’
ট) দারিদ্র্য বিমোচন না হয়ে দারিদ্র্য স্থায়ীকরণ হচ্ছে ঋণগ্রহীতার বিনিয়োগ সম্পর্কিত জ্ঞানের অভাবে, বাস্তবে এটা সঠিক নয়। প্রকৃতপক্ষে ঋণগ্রহীতা বিনিয়োগে আগ্রহী থাকলেও ক্ষুদ্রঋণের পদ্মতিগত ত্রæটিতে বিনিয়োগ সফল হচ্ছে না এবং দারিদ্র্য স্থায়ীকরন হচ্ছে।
ঠ) বাস্তবে ক্ষুদ্রঋণ কোন মহৎ সামাজিক ব্যবসা নয়। ক্ষুদ্রঋণকে অনেক বড় এবং মহৎ সামাজিক ব্যবসা হিসাবে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বহির্বিশ্বে প্রচার করা হয় এবং দাতা দেশ ও সংস্থাগুলোর কাছ থেকে অনুদান আনা হয়। এটির মর্মকথা হচ্ছে ঋণপ্রদানকারীগণ কর্তৃক বৃহৎ পুঁজিপতিদের স্বার্থ রক্ষা করা। গরীব লোকদের সামান্য অংকের ঋণ দিয়ে উচ্চ সুদ আদায় করে অল্প কিছু লোকের ধনী হওয়ার এবং বিগ ক্যাপিটেলিস্টদের স্বার্থ রক্ষার এটি একটি কৌশলী প্রকল্প। ড) ক্ষুদ্রঋণ দারিদ্র্য বিমোচনের একমাত্র উপায় এরূপ প্রচারনা চালানো হয়। বাস্তবে দেখা গিয়েছে যে, এটি দারিদ্র্য বিমোচনের একমাত্র উপায় নয়, বরং এটি দারিদ্র্র্য হ্রাস প্রক্রিয়ার একটি উপাদান হতে পারে। সে ক্ষেত্রে ঋণের শর্তগুলি আরো সহজ হতে হবে, কিস্তি পরিশোধ ও সুদের কার্যকর হার সহজ হতে হবে। মনে রাখা দরকার ধনীরা দুলনামূলকভাবে অনেক অনুক‚ল শর্তে ঋণ পেয়ে থাকে।
ঢ) দারিদ্র্য বিমোচনে প্রধান বাধা ব্যক্তির ব্যর্থতা, এ কথা ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাসমূহ বলে থাকে। সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে শুধুমাত্র ব্যক্তির ব্যর্থতা দারিদ্র্য বিমোচনের বাধা নয়, দারিদ্র্র্য বিমোচনে প্রধান বাধা হচ্ছে : (১) সমাজের বর্তমান ক্ষমতা কাঠামো : সমাজের বর্তমান ক্ষমতা কাঠামো যেখানে জনগোষ্ঠীর একটি ক্ষুদ্র অংশ ক্ষমতা ও সমৃদ্ধি ভোগ করছেন এবং রাষ্ট্রের বিভিন্ন দিক নিয়ন্ত্রণ করছেন। বিপরীতে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী বিচ্ছিন্ন থেকে যাচ্ছেন এবং নিচুস্তরের কষ্টসাধ্য জীবন যাপন করছেন, (২) প্রচলিত নয়া উদারবাদী মুক্তবাজার অর্থনীতির ধারা ক্রমেই গেড়ে বসছে এবং বর্তমান সমাজ কাঠামোকে অধিকতর শক্তিশালী করছে।
ক্ষুদ্রঋণ বহুজাতিক পুঁজির নতুন আবিষ্কার : ক্ষুদ্রঋণ বহুদিন পর্যন্ত একটি বিকল্প,অনানুষ্ঠানিক ব্যাংকিং হিসাবেই পরিচিতি পেয়ে এসেছে। একে দেখা হয়েছে গরীবের জন্য একটি সহায়তা কার্যক্রম হিসাবে। একসময় বিশ্বের লগ্নি পুঁজির মালিকগণ ক্ষুদ্রঋণের প্রতি আকৃষ্ট হলো। এর কারণ প্রথমতঃ বর্তমান পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্ব ব্যবস্থায় শিল্প পুঁজির চেয়ে বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে অর্থকরী বিনিয়োগ বা ফটকা পুঁজি (অর্থ খাটিয়ে অর্থ রোজগার করা)। এই ফটকা পুঁজির আয়তন বৃদ্ধি পেতে পেতে এমন অবস্থায় পৌঁছল যে, পুরাতন সকল গতিমুখ অতি ব্যবহারের কারণে ফটকা পুঁজির প্রবেশের জন্য অবরুদ্ধ ও ব্যবসায়িক লোকসানের সম্মুখীন হয়ে পড়লো। দ্বিতীয়তঃ আশির দশকে ক্ষুদ্রঋণের সাফল্যের গতি দেখে বিশ্বের লগ্নি পুঁজির মালিক সংগঠকগন বিস্মিত হয়ে পড়লো। তৃতীয়তঃ বৃহদায়ন ফটকা পুঁজির অন্তিম সময়ে বিশ্বজুড়ে পুঁজি বিনিযোগের ভিন্ন গতিমুখ হিসাবে ক্ষুদ্রঋণ স্বীকৃত হলো এবং ফটকা পুঁজির নতুন এক বিশাল বাজার উন্মোচিত হলো।
কর্পোরেট পুঁজি ক্ষুদ্রঋণের পক্ষে কেন ? (১) পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার মধ্যেই সংখ্যালঘুর ধনী ও সংখ্যাগরিষ্ঠের গরীব হওয়ার প্রক্রিয়া নিহিত। এই গরীব করা আর গরীব রাখার ব্যবস্থা বহাল রাখার জন্যই গরীবদের ঋণ দিয়ে ও উচ্চহারে সুদ নেয়া হয়। (২) ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের মাধ্যমে বিপুল মূলধন সংবর্ধিত হচ্ছে ঃ এনজিওদের অর্থের জোগানদাতা হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি। পৃথিবীর সর্বত্র তাদের নেটওযার্ক সক্রিয়। পাশ্চাত্য সংস্কৃতির বিকাশ, আভ্যন্তরীন রাজনীতি নিয়ন্ত্রন, নতুন মুৎসুদ্দী শ্রেনী তৈরী করে সা¤্রাজ্রবাদী শক্তির পুঁজি পাহারা দেয়া তাদের লক্ষ্য। ক্ষুদ্রঋণের মধ্য দিয়ে যে বিপুল মূলধন সংবর্ধিত হচ্ছে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে, তা বৃহৎ বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। (৩) যুথবদ্ধ কোন শিল্পে উদ্যোগী না হয়ে একাকী উদ্যোক্তা হিসাবে থাকলে যে কোন সামাজিক আন্দোলন, জমায়েত, ট্রেড ইউনিয়নে যোগদানের সুযোগ ঘটবে না। ফলে শ্রমিকদের আন্দোলন থেকে যেকোন কর্পোরেট রক্ষা পাবে।এখানে একাকী উদ্যোক্তা মানে ক্ষুদ্রঋণ গ্রহীতাদের বুঝানো হয়েছে। (চলবে)
লেখক: ডায়াবেটিস ও চর্মযৌনরোগে ¯œাতকোত্তর
প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসক, চট্টগ্রাম