পেরেন্টস লাউঞ্জ, ধারণা ও বাস্তবায়ন

2

মুশফিক হোসাইন

জীব জীবনের রহস্যময় সত্য হচ্ছে-বার্ধক্য উপনীত হওয়া। বৃক্ষলতা, পশুপাখি মানুষসহ প্রতিটি জীবন প্রাকৃতিক নিয়মে বার্ধক্যে উপনীত হয়। যাকে মানব সমাজ প্রবীণ বা বুড়ো বলে আখ্যায়িত করে থাকে। মানব জীবন হচ্ছে সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, পাওয়া না পাওয়ার সমাহার। প্রবীণ সময়ে সাধারণতঃ জরায় আক্রান্ত হয়ে থাকেন। বাংলাদেশের প্রবীণগণ ঐ সময় অসহায় জীবন যাপনে বাধ্য হয়ে থাকেন। শারীরিকভাবে দুর্বল ও অক্ষম হয়ে পড়েন। তখন সামাজিক ও পারিবারিক কারণে তাদের সহায়সম্পদ সন্তানসন্ততি বা অন্যদের দখলে চলে যায়। বঞ্চিত হয় নানাবিধ সুখসুবিধা। ফলতঃ তারা অন্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। এই অনাকাক্সিক্ষত সময়ে খড়কুটো আঁকড়ে ধরে আশ্রয় খোঁজে, বাঁচতে চায়।
বাংলাদেশ একটি জনসংখ্যাবহুল দেশ। শিক্ষা ও অর্থনীতিতে স্বনির্ভর নয়। তাদের মন-মনন স্বাস্থ্য সচেতনতা নি¤œ পর্যায়ের। তারপর সা¤প্রতিক সময়ে স্বাস্থ্য, মাতৃমৃত্যু সহ নানা সূচকে উন্নত হওয়ায় এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ার কারণে গড় আয় বাড়ছে। যা জন বিশেষজ্ঞদের মতে গড় আয়ু ৭২+। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশে জনসংখ্যা প্রবৃদ্ধি হচ্ছে ৬.১০ হারে।
জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিল (UNFPA) বলছে ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশে প্রবীণ জনসংখ্যা দ্বিগুণ হওয়ার সম্ভাবনা। বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন ২০৪৭ সালের মধ্যে বাংলাদেশ জাপানের মতো প্রবীণ সমাজে রুপান্তরিত হতে পারে। এই বাস্তবতায় আমাদের প্রবীণগণ অবহেলিত ও অধিকার বঞ্চিত। তবে আশার কথা এই যে. বাংলাদেশ সরকার প্রবীণদের সামাজিক সুরক্ষার্থে ‘প্রবীণ নীতিমালা ২০১৩ এবং পিতামাতার ভরণপোষণ আইন ২০১৩ প্রণয়ন করেছেন। এ ছাড়া ও বয়স্কভাতার প্রচলন আছে।
তবে দেশে প্রচলিত আইন বিদ্যমান থাকা সত্তে¡ও-বাস্তবিক অর্থে প্রবীণগণ কার্যতঃ অবহেলিত ও অসহায়। বয়স্কভাতা সার্বজনীন নয়। দেশের শিক্ষা কারিকুলামে বয়স্কদের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধার বিষয়ক প্রবন্ধ / শিক্ষাসূচি অন্তর্ভুক্ত হয়নি। সামাজিক জীবনাচরণে ও প্রবীনদের সুরক্ষা দেওয়ার প্রবণতা নেই বললে চলে। হালের তরুণদের মাঝে উগ্রতা লক্ষণ করা যাচ্ছে। বয়স্কদের শ্রদ্ধা, সম্মান ও সহমর্মিতা দেখানোর প্রবণতা দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। অন্যদিকে শিক্ষার হার বৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক নিশ্চয়তার কারণে পারিবারিক সদস্যরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাচ্ছে। প্রবাস গমনের হারও বাড়ছে। ফলে একান্নবর্তী পরিবার ভেঙ্গে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরিবারের সংখ্যা আশক্সক্ষা জনকভাবে বাড়ছে। ফলে জীবনের শেষ প্রান্তে এসে পিতামাতা/বয়স্করা একা হয়ে যাচ্ছেন। জীবন সায়াহ্নে রোগব্যাধি, একাকিত্ব, অর্থ সংকট ও পঙ্গুত্ব নিয়ে জীবনযাপনে বাধ্য হয়। এই কঠিন সময়ে পরিবার ও সমাজে অবহেলিত হয়ে মৃত্যুর প্রহর গুণেগুণে বেঁচে থাকেন। বলা চলে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করেন। কিন্তু কেবা চাহে মরিতে। মানুষ তো শান্তিময় মৃত্যু কামনা করে। অপেক্ষার এই রুঢ় সময়ে কথা বলা, হাসি তামাসার জন্য লোক পান না। হয়ত হেসে জিজ্ঞেস করে না কেমন আছেন ? অথচ তারাই এক সময় পরিবার দেশ, সমাজ ও জাতির জন্য মেধা ও শ্রম দিয়েছেন। এই কঠোর বাস্তবতাকে অনুধাবন করে প্রবীনদের সুরক্ষার তাগিদে জানুয়ারি ০১-২০২২ সালে কতিপয় প্রবীণদের সম্মিলিত উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘প্রবীণ নাগরিক ফোরাম-চট্টগ্রাম’। (Senior Citizens Forum-Chattagram))
ইতিপূর্বে ২০১৭/১৮ সালে বাদল সৈয়দ কবি আকতার হোসেন প্রমুখের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল পেরেন্টস লাউঞ্জ। সেখানে প্রবীণদের হালকা চা-নাস্তা ও বিনোদনের ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু সঠিক তত্ত¡াবধান ও পরিচর্যা এবং মাতৃ প্রতিষ্ঠান অনেস্টের ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গি, অবহেলা ও স্থান পরিবর্তনের বিলুপ্ত হয়ে যায় ২০২৩/২৪ সালে। সকল সুবিধাসম্পন্ন করার তাগিদে ব্যক্তিগতভাবে লেগে থাকার কারণে আমার সকল উদ্যোগ ও প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। আমি একটি লাউঞ্জ/সংঘ গড়ে তোলার জন্য যাত্রা’ শুরু করি। আমার এই স্বপ্ন যাত্রা প্রবীণ নাগরিক ফোরাম চট্টগ্রামের মাধ্যমে বাস্তবায়িত করার নিরন্তর শ্রম ও চেষ্টা অব্যাহত থাকে। ফোরামের মাধ্যমে প্রবীণদের সম্মাননা প্রদান, সভা সেমিনার আনন্দ ভ্রমণসহ নানাবিধ কর্মকাÐ সম্পন্ন হয়। কিন্তু একটি নিবাস বা ঠিকানা গড়ে তোমার তীব্র যন্ত্রণা নিয়ে দিন অতিবাহিত করতে থাকি। সামর্থের অভাবে তীব্রযন্ত্রণায় ভুগতে থাকি। হৃদয়ের ক্ষরণ হতে থাকে। বয়স বেড়ে যাচ্ছে অবশেষে আল্লাহর অশেষ রহমতে ১৪ অক্টোবর ২০২৫ সালে প্রবীণ বন্ধুদের সহায়তায় একটি স্থায়ী ঠিকানা হয়। এখন আমাদের বড় সমস্যা হচ্ছে-অর্থ সংকট। প্রতি মাসে ষাট হাজার ব্যয়। দেশের দানশীল ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠানের সহয়তার অপেক্ষায় তাকিয়ে আছি-
‘পেরেন্ট’ বলতে আমরা বাবা-মা কে একসাথে বুঝে থাকি। ক্যামব্রিজ ডিকশনারী মতে ‘মানবকুলে জন্মগ্রহণকারী সন্তানদের পিতা-মাতা বা অন্য কেউ কর্তৃক রক্ষণাবেক্ষণ কারীকে বোঝায়। বলা চলে যিনি বা যারা অভিভাবক”। আর লাউঞ্জ হচ্ছে আরামদায়ক স্থান বা বাসা। যেখানে মানুষ বিশ্রাম নিতে পারে। অথবা অলস সময় কাটানো বা আনন্দ আমোদে বিশ্রাম নেয়ার স্থান। এই আরামে কাটানোর স্থানই হচ্ছে লাউঞ্জ।
এই অর্থে প্রবীণদের জন্য পেরেন্টস লাউঞ্জ নামটি যুক্তিযুক্ত। তবে কেউ কেউ ‘সিনিয়ারস লাউঞ্জ’ নামে অবহিত করতে চায়। নামে কি আসে যায়। প্রবীণদের সুরক্ষা ও আরাম আয়েশের জন্য বিশেষ করে স্বপ্ন বাস্তবায়নের কাজ শুরু হল। সকলের সহায়তা চাই।
লেখক : কবি, নিসর্গী ও ব্যাংক নির্বাহী (অব)