পূর্বাঞ্চল রেলে আবারও ‘কালো বিড়াল’ অধ্যায়

689

রেলে খালাসি নিয়োগের প্রকাশিত ফলাফলের ২ ও ৩৪৪ নং সিরিয়ালে নাম আছে ইউসুফ রায়হানের। তাও আবার জামালপুর ও ঢাকা বিভাগের দুই কোটায়। তার আরেক ভাই আবিদেরও একই পদে চাকরি হয়েছে। তিনি চাকরি পান টাঙ্গাইল জেলা কোটায়। সম্পর্কে আপন দুই ভাই হলেও চাকরি পেয়েছেন তিন জেলা কোটায়। আবার বাড়তি বয়স হলেও ২৮ বছর দেখিয়ে চাকরি পেয়েছেন একজন। অথচ তার ছেলের বয়স তখন ছিল ১৮। এমন তুঘলকি অনিয়ম মেনেই ৮৬৩ খালাসি নিয়োগের চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণা করেছিল নিয়োগ কমিটি। অবশ্য শেষ রক্ষা হয়নি। দুদকের তদন্তে প্রকাশ পেয়েছে আরেক ‘কালো বিড়াল’ অধ্যায়।
গতকাল চাঞ্চল্যকর এই নিয়োগের সাথে সম্পৃক্ত রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের সাবেক মহাব্যবস্থাপক (জিএম) সৈয়দ ফারুক আহমদ, ঢাকা রেলভবনের মহাব্যবস্থাপক (প্রকল্প) ও নিয়োগ কমিটির প্রধান মিজানুর রহমান, পূর্বাঞ্চলের সহকারী মহাব্যবস্থাপক (এজিএম) ও নিয়োগ কমিটির সদস্য সচিব জোবেদা আক্তার, নিয়োগ কমিটির আরেক সদস্য মো. রফিকুল ইসলামসহ ১২ জনের বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয়-১ এ মামলা দায়ের হয়েছে। দুদক প্রধান কার্যালয়ের অনুমোদনের পর দুদকের উপ-সহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিন এ মামলাটি দায়ের করেন। মামলার অন্যান্য আসামিরা হলেন- সাবেক জিএম সৈয়দ ফারুক আহমদের গাড়িচালক হারাধন দত্ত, ঢাকা শাহজানপুর রেলওয়ে সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক সুরাইয়া সুলতানা, খালাসি আবুল বশর খাঁন, পূর্বাঞ্চল সংস্থাপন দপ্তরের প্রধান সহকারী ও শ্রমিক লীগের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক খোন্দকার সাইফুল ইসলাম মামুন, রেলওয়ে টিকিট প্রিন্টিং প্রেস কলোনি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক মৃণাল কান্তি দাশ, শাহজানপুর রেলওয়ে সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের অফিস সহকারী মো. আক্তার হোসেন, মেসার্স ফাতেমা এন্টারপ্রাইজের মালিক আমিরুজ্জামান আশীষ, মেসার্স প্রান্ত শান্ত এন্টারপ্রাইজের মালিক মোছাম্মৎ পারভীন আক্তার। এরমধ্যে আসামি আমিরুজ্জামান আশীষ ১৩ জনকে ও মোছাম্মৎ পারভীন আক্তার নয়জনকে অনৈতিকভাবে লাভবান হয়ে চাকরি দিয়েছেন। এছাড়াও আসামিদের মধ্যে কয়েকজনসহ ঐশী এন্টারপ্রাইজের মালিক কাউছার, জিএম সৈয়দ ফারুকের শ্যালক ফজলুল রহমান মুকুলসহ মোট ১৩ জনের সম্পদ অনুসন্ধান করা হবে বলে জানিয়েছেন দুদক।
দুদক সূত্র জানায়, পূর্বাঞ্চলের খালাসি পদে ৮৬৩ জন নিয়োগ কমিটির পাঁচজন সদস্যের মধ্যে দুইজন সদস্যের স্বতন্ত্র মার্কশিট না থাকা, একত্রিত মার্কশিটে চারজনের নম্বর দেখানো হলেও একজনের মূল্যায়ন মার্ক অসৎ উদ্দেশ্যে সৃজন করে প্রতারণাপূর্বক ১৯ জনকে নিয়োগ প্রদান, দুইজন নিয়োগ প্রার্থীকে চার জেলা হতে নিয়োগ, বয়স্ক ও জাল সনদধারী লোকদের জাল সনদ সৃজনপূর্বক ব্যবহার করে চাকরি প্রদান করা হয়েছে। এছাড়াও নিজেরা লাভবান হয়ে ক্ষমতার অপব্যবহারপূর্বক একে অপরের সহযোগিতায় এক কোটি দুই লাখ ৪৪ হাজার টাকা এস.এ পরিবহন কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে পাচার ও ঘুষ গ্রহণ করে ভোগ দখলে রেখে বিভিন্ন জায়গায় পাচার ও বিনিয়োগ করেছেন আসামিরা।
দুর্নীতি দমন কমিশন চট্টগ্রাম সমন্বিত জেলা কার্যালয়-২ এর উপ-সহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিন পূর্বদেশকে বলেন, ‘খালাসি নিয়োগে ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে। আসামিরা বিভিন্ন মাধ্যমে চাকরি দেয়ার নাম করে টাকা ঘুষ গ্রহণ করেছেন। কয়েকজনের একাউন্টে সে অর্থের তথ্যও মিলেছে। তারা ঘুষ গ্রহণ করে দোকান, বাড়ি-গাড়ি কিনেছেন। এ নিয়োগ অনিয়মে আরো কেউ জড়িত থাকলে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
রেলওয়ে সূত্র জানায়, ২০১৩ সালের ৪ জুলাই ৮৬৩ জন খালাসি নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি জারি করে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল। এরমধ্যে নিয়োগ প্রক্রিয়াটি আদালত পর্যন্ত গড়ায়। ২০১৫ সালে নিয়োগের মৌখিক পরীক্ষা সম্পন্ন হয়। এ নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠিত হয়। কমিটিতে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের তৎকালীন প্রধান যান্ত্রিক প্রকৌশলী মিজানুর রহমানকে আহŸায়ক ও আরটিএ’র সদস্য সচিব জোবেদা আক্তারকে সদস্য সচিব করা হয়। এছাড়াও রেলওয়ের কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম, শেখ খলিলুর রহমান ও এম.এ জিন্নাহকে সদস্য করা হয়। এরমধ্যে এম.এ জিন্নাহ মারা যান এবং শেখ খলিলুর রহমানকে অন্য মন্ত্রণালয়ে বদলি করা হয়। দুই কর্মকর্তা অনুপস্থিত থাকলেও নিয়োগের আগে এই দুই পদে স্থলাভিষিক্ত না করেই নিয়োগ চূড়ান্ত করা হয়।
রেলের খালাসি নিয়োগ নিয়ে শুরু থেকেই তোলপাড় শুরু হলে তদন্তে নামে দুদক। পরে রেলওয়ের কাছ থেকে যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ শেষে অভিযুক্ত রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের সাবেক জিএম সৈয়দ ফারুক আহমদ ও ১৩ কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ মোট ২৪ জনকে তলব করা হয়। এরমধ্যে ২০২০ সালের ফেব্রæয়ারি মাসে সৈয়দ ফারুক আহমদ ও নিয়োগ কমিটির তিনজনসহ মোট ১৫ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। অভিযুক্তদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুসন্ধানে খালাসি নিয়োগে জড়িত পুরো সিন্ডিকেটের হদিস মিলে।
এর আগে ২০১৮ সালে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে খালাসি নিয়োগের ফলাফল ঘোষণায় দুর্নীতির আয়োজন চলছে অভিযোগ তুলে স্বচ্ছতা বজায় রেখে নিয়োগের দাবি জানায় রেলওয়ে শ্রমিক কর্মচারী সংগ্রাম পরিষদ। এর পর রেলওয়ের উচ্চ পর্যায়ের এক বৈঠকে খালাসি পদে মন্ত্রী-সাংসদসহ দলীয় নেতাদের সুপারিশের ভিত্তিতে লোক নিয়োগ দিতে চাপ সৃষ্টির অভিযোগের কথা জানিয়েছিলেন পূর্বাঞ্চলের তৎকালীন জিএম আব্দুল হাই। জিএমের এমন বক্তব্যেও পর নিয়োগ বাণিজ্যের সাথে যুক্ত সিন্ডিকেটটি ক্ষিপ্ত হন এবং অল্পদিনের মধ্যে আব্দুল হাইয়ের স্থলাভিষিক্ত করা হয় সৈয়দ ফারুক আহমদকে। পরে এই জিএমের সাথে যোগসাজশ করে নিয়োগ কমিটির তিনজন মিলে গত বছরের মে মাসে অনিয়মে ভরা এ নিয়োগ কার্যক্রম সম্পন্ন করেন বলে জানা গেছে।
রেলওয়ে সংগ্রাম পরিষদের সমন্বয়ক মোখলেছুর রহমান পূর্বদেশকে বলেন, ইউসুফ আলী মৃধা, হাফিজুর রহমান, গোলাম কিবরিয়া ছাড়া বাদবাকি কারো বিষয়ে রেলওয়ের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। রেলের খালাসি নিয়োগ প্রক্রিয়াটি ছিল অনিয়মে ভরা। দুদক যখন খালাসি নিয়োগের বিষয়টি অনুসন্ধান করছে তখনই রেলওয়ে চাইলে বিষয়টি তদন্ত করে অনিয়মে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারতো। সেটি না করে উল্টো অভিযুক্তদের পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। এখন দুদকের তদন্তে পূর্বাঞ্চলে আরেক কালো বিড়াল অধ্যায় বের হয়ে আসছে।
প্রসঙ্গত, ২০১২ সালের ৯ এপ্রিল বিজিবি সদর দপ্তরের মূল ফটক দিয়ে হঠাৎ একটি গাড়ি ঢুকে পড়ে। নিরাপত্তারক্ষীরা গাড়িটি তল্লাশি করে ৭০ লাখ টাকা উদ্ধার করেন। সাথে আটক করেন চালকসহ গাড়িতে থাকা আরও তিনজনকে। এই তিনজন হলেন, তৎকালীন রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এপিএস ওমর ফারুক, রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক ইউসুফ আলী মৃধা ও কমান্ডেন্ট এনামুল হক। রেলের ইতিহাসে এখনো পর্যন্ত এটিই বড় দুর্নীতির ঘটনা। এ ঘটনার পর থেকে নড়চড়ে বসে রেল প্রশাসন। একে একে বেরিয়ে আসে রেল দুর্নীতির থলের বিড়াল। এ ঘটনার পর ‘কালো বিড়াল’ শব্দটি দেশজুড়ে ব্যাপক আলোচনায় আসে।