পূর্ণাঙ্গ পরীক্ষাগার, সব পণ্যের মান যাচাই হবে চট্টগ্রামেই

8

এম এ হোসাইন

দীর্ঘ আট বছরের প্রতীক্ষার পর অবশেষে উদ্বোধন হতে যাচ্ছে চট্টগ্রাম বিএসটিআইর (বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন) দশতলা আঞ্চলিক ভবন। তবে এই যাত্রাপথ মোটেই মসৃণ ছিল না; অনিয়ম, দুর্নীতি, ঠিকাদার জটিলতা এবং প্রশাসনিক ধীরগতির কারণে সম্পন্ন হয়নি ভবনটির নির্মাণকাজ। অথচ একই প্রকল্পের আওতায় খুলনায় নির্মিত ভবনটি ৪ বছর আগেই শেষ হয়ে গেছে এবং পুরোদমে চালু রয়েছে।
২০১৫ সালে ‘চট্টগ্রাম ও খুলনায় বিএসটিআইর আঞ্চলিক অফিস স্থাপন ও আধুনিকীকরণ’ প্রকল্প গ্রহণ করে সরকার। ২০১৭ সালের ২৬ অক্টোবর চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ জাম্বুরি মাঠ সংলগ্ন এলাকায় শুরু হয় দশতলা ভবনের নির্মাণকাজ। ৩৫ কোটি টাকা ব্যয়ে এর ঠিকাদার হিসেবে কাজ পায় বিতর্কিত জিকে শামীমের প্রতিষ্ঠান জিকেবিএল (জেভি) ও দি বিল্ডার্স ইঞ্জিনিয়ার্স। চুক্তি অনুযায়ী দুই বছরের মধ্যে ভবনটি নির্মাণ সম্পন্ন হওয়ার কথা থাকলেও সাড়ে তিন বছরে কেবল তিনতলার ছাদ ঢালাই হয়। এরপর প্রকল্পের কাজ একপ্রকার বন্ধই হয়ে যায়। বিষয়টি নিয়ে গণপূর্ত বিভাগ একাধিকবার নোটিশ দিয়েও কোনো অগ্রগতি না দেখে অবশেষে কার্যাদেশ বাতিল করে নতুন ঠিকাদার নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু করে। এই দীর্ঘসূত্রতার কারণে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা পড়েছেন চরম ভোগান্তিতে।
এতসব প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে অবশেষে নির্মিত হয়েছে নতুন ভবন। আজ শনিবার এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হবে। ভবনটিতে স্থাপন করা হয়েছে পূর্ণাঙ্গ ও আধুনিক মান পরীক্ষাগার। আগে যেখানে ৯২টি পণ্যের রাসায়নিক ও ২৪টি পণ্যের ফিজিক্যাল পরীক্ষা সম্ভব ছিল, সেখানে এখন প্রায় সব বাধ্যতামূলক পণ্যের পরীক্ষা চট্টগ্রামেই হবে।
বিএসটিআই চট্টগ্রাম বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানি বলেন, নবনির্মিত ভবনে অত্যাধুনিক ল্যাবরেটরি স্থাপন করা হয়েছে। বাধ্যতামূলক তালিকাভুক্ত সব পণ্যের পরীক্ষা এখন চট্টগ্রামেই সম্ভব হবে। ইতোমধ্যে বেশিরভাগ মেশিন স্থাপন করা হয়েছে, কিছু মেশিন বসানো বাকি রয়েছে। বৈদ্যুতিক সংযোগ পেতে দেরি হওয়ায় এ কাজ পিছিয়ে পড়েছিল। তবে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই সব মেশিন বসানো হবে। এমনকি ঢাকার কিছু পণ্যও পরীক্ষার জন্য চট্টগ্রামে পাঠানো হতে পারে।
নতুন ল্যাবে স্বর্ণের বিশুদ্ধতা, পানি, গুঁড়ো দুধে মেলামিন, শিশু খাদ্য, টুথপেস্ট, ফায়ার এক্সটিংগুইশার, প্রসাধনী, কাগজ, সয়াবিন-সূর্যমুখী তেল, পেট্রোলিয়ামজাত পণ্যসহ নানা ধরনের মান পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকবে। এতে চট্টগ্রামের আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমের গতি বাড়বে এবং ব্যবসায়ীদের দীর্ঘদিনের নির্ভরতা কমবে রাজধানীর ওপর। এত কিছুর পরও চট্টগ্রাম বিএসটিআই অফিসে রয়েছে জনবল সংকট। বর্তমানে চারটি বিভাগে (টেস্টিং কেমিক্যাল, ফিজিক্যাল, মেট্রোলজি ও সার্টিফিকেশন মার্কস) সীমিত জনবল দিয়ে পুরো চট্টগ্রাম বিভাগ, এমনকি পার্বত্য জেলা রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি পর্যন্ত মনিটরিং করতে হচ্ছে। ফলে বাজারে এখনো অনুমোদনহীন পণ্যের ছড়াছড়ি, রয়েছে ভেজাল ও মেয়াদহীন পণ্য বিক্রির অভিযোগ।
অন্যদিকে এখনো শহরের বিভিন্ন এলাকায় বিএসটিআইয়ের অনুমোদনহীন লোগো ব্যবহার করে ভেজাল পণ্য বাজারজাত করা হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। উৎপাদনের তারিখ ও মেয়াদোত্তীর্ণের উল্লেখ ছাড়াই এসব পণ্য ভোক্তাদের হাতে পৌঁছাচ্ছে।
চট্টগ্রামে বিএসটিআই’র পূর্ণাঙ্গ ল্যাব প্রতিষ্ঠাকে সময়োপযোগী ও জরুরি পদক্ষেপ হিসেবে অভিহিত করেছেন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) চট্টগ্রামের সভাপতি এসএম নাজের হোসাইন। তিনি বলেন, বিভিন্ন খাতে ভেজাল পণ্যের প্রভাব প্রতিদিনই ভয়াবহ হয়ে উঠছে। অথচ এতদিন চট্টগ্রামে পূর্ণাঙ্গ মান পরীক্ষার ল্যাব না থাকায় ঢাকায় পাঠিয়ে পণ্যের মান যাচাই করতে হতো, যা সময়সাপেক্ষ, ব্যয়বহুল এবং ঝুঁকিপূর্ণ। তিনি বলেন, নতুন ল্যাব চালু হওয়ায় চট্টগ্রামের জনগণের জন্য নিরাপদ ও মানসম্পন্ন পণ্য নিশ্চিত করার পথ অনেকটাই সুগম হলো। তবে ল্যাব চালু করলেই হবে না, বিএসটিআই’র তদারকি ও মনিটরিং কার্যক্রমও জোরদার করতে হবে। বিশেষ করে অনুমোদনহীন পণ্য ও মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য বাজার থেকে তুলে দিতে নজরদারি বাড়ানো জরুরি। জনস্বার্থে এই প্রতিষ্ঠানকে আরও স্বচ্ছ, গতিশীল ও জবাবদিহিমূলক করতে হবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকল্পে গাফিলতির জন্য দায়ীদের জবাবদিহির আওতায় আনা না গেলে ভবিষ্যতেও এমন গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে একই চিত্র দেখা যাবে। তবে বর্তমান উদ্যোগ যদি সঠিকভাবে পরিচালিত হয়, তাহলে এটি হতে পারে চট্টগ্রাম অঞ্চলের শিল্প, স্বাস্থ্য ও নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ।