পুলিশ সংস্কার কতটুকু আলোর মুখ দেখবে

1

অ্যাড. সালাহ্উদ্দিন আহমদ চৌধুরী লিপু

জনগণের করের অর্থে প্রতিপালিত দেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা হলো বাংলাদেশ পুলিশ। অন্যায় অপরাধ দমন করে নাগরিকদের জীবনযাত্রা সুনিশ্চিত ও নিরাপত্তা বিধান করা পুলিশের দায়িত্ব ও কর্তব্য। আবাহমান কাল ধরে পুলিশ আর জনগণের সম্পর্ক বিদ্যমান। পুলিশের যেমন ব্যর্থতা রয়েছে, তেমন সফলতা রয়েছে। মহান মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের বীরত্বগাথা অবদান আমাদেরকে গর্বিত করে। তাছাড়া বাংলাদেশ পুলিশ জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কমিশনবাহনীতে দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন দেশের জন্য সুনাম বয়ে এনেছে। এদেশে পুলিশ কখনো স্বাধীনভাবে কাজ করতে পেরেনি। প্রতিটি দলীয় সরকার পুলিশকে তাদের ক্রীড়ানক হিসেবে ব্যহার করেছে। বিরোধী দল দমনে সব সরকার পুলিশকে ব্যবহার করেছে। পক্ষান্তরে শাসক দলকে পুলিশকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করতে গিয়ে তাদের নৈতিক স্খলনকে প্রশ্রয় দিয়েছে। তদ্রæপ বর্তমানেও একরূপ দেখতে যাচ্ছে। ফলে সমাজও রাষ্ট্রে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা কঠিন ছিল। পুলিশকে শাসক দল রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করতে গিয়ে পুলিশের ঐতিহ্য, সুনাম ও সম্মান ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। এদেশে আমজনতা চায় পুলিশ রাজনীতি মুক্ত হোক। পুলিশকে রাজনীতি প্রভাবমুক্ত করতে না পারলে সংস্কার সম্ভব নয়। তাই রাজনৈতিকভাবে পুলিশকে ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। সাধারণ জনগণ রাষ্ট্রীয়বাহিনী নয় পুলিশবাহিনী হিসেবে দেখতে চায়। পুলিশের পেশাদারিত্বের উদ্ভব হলে রাজনীতির প্রভাব কমবে। স্বাধীনতার ৫৪ বছরে দেশের আর্থ সামাজিক, রাজনৈতিক পরিবর্তন হলেও পুলিশ বিভাগের কোনো পরিবর্তন হয়নি। শতাব্দী প্রাচীন পুলিশ সংস্কারের উদ্যোগ অতীতেও গৃহীত হয়েছিল কিন্তু রাজনৈতিক কারণে তা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। পুলিশবাহিনীর ব্যাপক সংস্কার এখন সময়ের দাবি। পুলিশবাহিনীর সংস্কারের লক্ষ্যে গত বছরের ১১ সেপ্টেম্বর সাবেক আমলা সফর রাজ হোসেনকে প্রধান করে ৭ সদস্য বিশিষ্ট পুলিশ সংস্কার কমিশন গঠন করেছে সরকার। তাই সরকারের এই উদ্যেগকে স্বাগত জানাই। তবে অতীতের মতো পুলিশ সংস্কার কতটুকু আলোর মুখ দেখবে তা সন্দিহান। পুলিশ ব্যবস্থার সংস্কার এবং দলীয় সরকারের লেজুড়মুক্ত স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার প্রয়োজন হলেও তা কতটুকু সম্ভব হবে। আমাদের প্রত্যাশা পুলিশ সংস্কারের বিষয়টি যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে আইন প্রণয়ন করবে। যাতে ভবিষ্যতে কোন সরকার উহা পরিহার করতে না পারে।
বাংলাদেশ পুলিশের সুনামের চেয়ে দুর্নাম বেশি। একটি কথা প্রচলিত আছে, বাংলাদেশে পুলিশে চাকরি করে অতি সহজে বিত্তবান হওয়া যায়। সে আদিকাল থেকে পুলিশ ও ঘুষ দু’টি শব্দ পরম্পরায় জড়িত। থানা যেন আজ পুলিশের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। পুলিশের নৈতিক স্খলন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। পুলিশের বিরুদ্ধে পর্বতসম অভিযোগ। প্রায় সময় সংবাদ মাধ্যমে দেখা যায়, পুলিশ অবৈধ সম্পদ অর্জনসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িত। পুলিশের শীর্ষ পদ থেকে নিম্নস্তর পর্যন্ত অনেকে দুর্নীতির রেকর্ড গড়েছেন। বিশ্লেষকরা মনে করেন অধিকাংশ পুলিশ কর্মকর্তা কোনো কোনোভাবে দুর্নীতি করছে। থানায় ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের ১৫৪ ধারার এজাহার দায়ের করতে, আবার এজাহারে গুরুদন্ডের ধারা সংযোজন বা বিয়োজন করতেও পুলিশকে মোটা অংকের উৎকোচ দিতে হয়। পুলিশ ফৌঃ কাঃ ১৬৭ ধারার পুলিশ হেফাজত বা রিমান্ড (Police Remand), রিমান্ডকে অন্যতম বাণিজ্যে পরিণত করেছে। বিনা প্রয়োজনেও পুলিশ আদালতে রিমান্ডের আবেদন করে থাকে। তাই বাণিজ্যরোধে যেকোনো আসামির রিমান্ড কোনো ম্যাজিস্ট্রেট, এক বা একাধিক আইনজীবী অথবা নিরপেক্ষ সংস্থার লোকজনের উপস্থিতিতে হওয়া উচিত। আটক ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য প্রতি থানায় স্বচ্ছ কাচঘেরা কক্ষ তৈরি করা প্রয়োজন, তাছাড়া ফৌঃ কাঃ ১৭৩ ধারার মামলার তদন্ত (Inquiry)-তে ব্যাপক দুর্নীতি হয়। তাই দুর্নীতিরোধে যেকোনো মামলা তদন্তে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ সংস্থার মাধ্যমে তদন্ত কার্যক্রম পরিচালিত করতে হবে। পুলিশ শুধু দেশের আইন শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পালন করবে। এতে পুলিশের দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা ও আইনের অপপ্রয়োগ বন্ধ হবে। পুলিশের চাকরি যেন এক সোনার হরিণ। পুলিশের চাকরিতে নিয়োগ, পদোন্নতি ও বদলির জন্য পদ অনুযায়ী বিভিন্ন হারে বিশাল অংকের উৎকোচ দিতে হয়। পুলিশ বাহিনীর স্বচ্ছতা, জবাবদিহি সুনিশ্চিত, দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার রোধ ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা বা একটি শক্তিশালী স্বতন্ত্র কমিশন গঠনের কোনো বিকল্প নেই। আপিল বিভাগের একজন বিচারপতির নেতৃত্বে সরকারি ও বিরোধী দলীয় সংসদ সদস্য, দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান, অবসরপ্রাপ্ত মহাপরিদর্শক পদমর্যাদার পুলিশ কর্মকর্তা, আইনজ্ঞ ও মানবাধিকার কর্মী রাষ্ট্রপতি বাছাই কমিটির তালিকা থেকে নিয়োগ দিয়ে স্বতন্ত্র পুলিশ কমিশন গঠন করবেন। উক্ত কমিশন আমূল পরিবর্তন করে পুলিশের নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতি, পদবনতি, অপসারণ, পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ বা অপরাধ তদন্ত করবেন। এতে পুরোনো সংস্কৃতির অবসান ঘটিয়ে পুলিশ স্বরাষ্ট্র বা অন্য কোনো মন্ত্রণালযের কাছে দায়বদ্ধ না থেকে স্বতন্ত্র কমিশনের কাছে দায়বদ্ধ থাকবে। এতে রাজনৈতিক আনুগত্য বিবেচনায় বা অবৈধ অর্থের বিনিময়ে নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতির পথ রুদ্ধ এবং শতভাগ স্বচ্ছতার ভিত্তিতে হবে। কমিশনকে পুলিশের ক্ষমতার অপব্যবহার এবং দুর্নীতি বন্ধের কার্যকর প্রশাসনিক ও বিধিগত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। জনপ্রত্যাশা পূরণে পুলিশ কমিশন যুগোপযোগী ও নতুন আইন বিধি পরিকল্পনা ও নীতিমালা প্রণয়ন করে পুলিশের জবাবদিহিতা সুনিশ্চিত করবেন।
দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি করে একটি রাজনেতিক প্রভাবমুক্ত, জবাবদিহিমূলক, মর্যাদাবান, দুর্নীতিমুক্ত, আধুনিক, চৌকস, সুসজ্জিত, জনবান্ধব এবং আন্তর্জাতিক মানদন্ডে পুলিশবাহিনী গড়ে তোলা হবে পুলিশ কমিশনের মূল লক্ষ্য। কমিশনকে উল্লেখিত বিষয়ে পরিবর্তন আনতে হবে যেমন, রাজনৈতিক যোগ্যতা গুরুত্ব না দিয়ে মেধা এবং দক্ষতার ভিত্তিতে পদোন্নতি ও পদায়ন, দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের পদোন্নতি, পদায়ন ও পুরস্কার বন্ধ করা, উপ-পরিদর্শক থেকে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিয়োগ প্রাপ্তির পর তাদের ও পোষ্যদের সম্পদের হিসাব এবং ফি বার্ষিক সম্পদ বিবরণী হালনাগাদ করে জমা দেয়া বাধ্যতামূলক করা, পরিদর্শক থেকে উচ্চতর পদের কোনো পুলিশ কর্মকর্তাকে একই স্থানে এক বা দুই বছরের অধিক না রাখা, পুলিশকে উন্নত বিশ্বের মতো অভিযান বা তল্লাশীর সময় জিপিএস ট্রাকিং সিস্টেম ও ভিডিও রেকর্ডিং ডিভাইস সহ ইউনিফর্ম পরিধান বাধ্যতামূলক করা ও রেকর্ডিং সংরক্ষণ করা, ভুয়া, গায়েবি মামলা, বলপ্রয়োগ ও ভয়ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে আর্থিক লেনদেন অবসান, বৃটিশ শাসক কর্তৃক প্রণীত ১৮৬১ সালের “Police Regulation of Bengal” সংক্ষেপে PRB এবং পাকিস্তান শাসক প্রণীত কর্তৃক ১৯৪৩ সালের পুলিশ প্রবিধানমালা বেঙ্গল দ্বারা অনাদিকালব্যাপী বাংলাদেশ পুলিশ পরিচালিত হয়ে আসছে। তাই সেই ঔপনিবেশিক আমলের পুলিশ প্রবিধান অবশ্যই সংস্কার করতে হবে। PRB, ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধি আইন, ১৮৬০ ইংরেজি সালের দন্ডবিধি এবং তৎসংশ্লিষ্ট আইন সম্পর্কে পুলিশের তেমন সম্যক জ্ঞান নেই। তাই প্রতিটি থানায় আইনের বই সম্বলিত একটি ছোট লাইব্রেরি স্থাপন, পুলিশের কার্যক্রম নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ, তদারকি নিয়মিত মনিটর করা, আন্তর্জাতিক পদ্ধতি অনুসরণ, কর্মসময় নিধারণ, পেশাদারিত্ব ও দক্ষতা বৃদ্ধি, জনবল বৃদ্ধি, বিভাগীয় ও ক্ষেত্র বিশেষে জেলা পর্যায়ে ফরেনসিক র‌্যাব স্থাপন, সাইবার অপরাধসহ বিভিন্ন নিত্য-নতুন অপরাধ শনাক্ত ও দমনে দেশ বিদেশে উন্নত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে পুলিশকে দক্ষ করে তোলা, পুলিশের উৎকর্ষসাধনে তথ্য প্রযুুক্তিতে দক্ষ করে গড়ে তোলা, সেবা ডিজিটালাইজড করা, জনগণকে দ্রুত সেবা সুনিশ্চিত করার জন্য জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ এর সক্ষমতা বৃদ্ধি প্রয়োজন। সেবা গ্রহীতাদের নানাবিধ সমস্যা তুলে ধরার জন্য বিভিন্ন থানায় প্রচলিত “ওপেন হউজ ডে” আরো অধিক কার্যকর করা। জনসম্পৃক্ততা গড়ে তোলার লক্ষ্যে কমিউনিটি পুলিশিং আরো জোরদার। পুলিশ হাসপাতালের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি, আবাসন, শিক্ষা, চিকিৎসা ইত্যাদি সুবিধা বৃদ্ধি। বাংলাদেশ পুলিশ আস্থার প্রতিক হয়ে উঠুক।

লেখক : কলামিস্ট ও গবেষক