পুলিশের তৎপরতা জোরদার করতে হবে

1

গত ১৫ নভেম্বর নোবেল বিজয়ী ড. মোহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের ১০০ দিন অতিক্রান্ত হয়েছে। এরমধ্যে সরকারের বেশকিছু উদ্যোগ যেমন রাষ্ট্রের বিভিন্ন বিভাগ ও দপ্তরের সংস্কারের বিষয়গুলো প্রশংসিত হলেও সরকারের সামনে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও বাজার নিয়ন্ত্রণের মত অনেক চ্যালেঞ্জ প্রায় একই রকম রয়ে গেছে। সরকারের ১০০ দিনের মাথায় এসেও পুলিশের স্বাভাবিক কার্যক্রম দৃশ্যমান না হওয়ার ঘটনা দেশের জন্য বিরল। অনেক জায়াগায় দেখা যাচ্ছে দেশ প্রেমিক সেনাবাহিনী ও বর্ডার গার্ড অব বাংলাদেশ (বিজিবি) আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় দায়িত্ব পালন করছেন। কিন্তু সাময়িক এ ব্যবস্থাপনা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় মোটেই কার্যকর নয়। ফলে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিনিয়ত পরিস্থিতির আরো অবনতি হচ্ছে। প্রতিদিনই ঘটছে বহু খুনের ঘটনা। সেই সঙ্গে বেড়েছে ছিনতাই, চুরি-ডাকাতি। বাড়ছে হুমকি-ধমকি ও চাঁদাবাজির ঘটনা। পথে-ঘাটে মানুষ যেমন নিরাপত্তাহীন, তেমনি নিরাপত্তাহীন নিজের বাসার ভেতরেও। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দফায় দফায় বৈঠক করছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী। নেওয়া হচ্ছে নানামুখী পদক্ষেপ। বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিনে দেশে সহিংসতার ঘটনায় সাড়ে সাত শর বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বর্তমানে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির যে অবনতি ঘটছে, তা গভীর উদ্বেগজনক। সাধারণ মানুষের মধ্যে অপরাধের ভয় কমে গেছে, আইন মান্য করার মানসিকতাও ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। এমনকি কিছু মানুষ যাকে পাচ্ছে, তাকে মারধর করছে, আইন হাতে তুলে নিচ্ছে, অথচ এর কোনও সঠিক বিচার হচ্ছে না। বিচারহীনতার এই সংস্কৃতি ক্রমাগত বেড়েই চলেছে এবং এর ফলে সমাজে নৈতিকতার সংকট দিন দিন গভীর হচ্ছে।
দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এখন প্রায় প্রতিদিনই ঘটছে এমন ঘটনা যেখানে মানুষ নিজ হাতে আইন প্রয়োগ করে চলছে। কৌশল হিসেবে গণপিটুনি বা লোককে শারীরিকভাবে আক্রমণ করে নিজের ফায়দা আদায় করার চেষ্টার ঘটনা বাড়ছে। কোথাও চুরির অভিযোগে, কোথাও সম্পত্তি বিরোধের জেরে, আবার কোথাও ব্যক্তিগত আক্রোশের কারণে মানুষ আইনকে উপেক্ষা করে প্রতিশোধ নিচ্ছে। এই ধরনের আচরণ শুধু অপরাধকেই উস্কে দিচ্ছে না, বরং সমাজে আরও বিশৃঙ্খলা ছড়াচ্ছে।
অনেকেই বলেন, দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সক্ষমতা কমেছে। অপরাধীদের দ্রুত গ্রেফতার ও বিচার না হওয়ায় সাধারণ মানুষ আইন হাতে তুলতে বাধ্য হচ্ছে। জনগণ মনে করে, বিচার ব্যবস্থার ধীরগতি ও দুর্নীতির কারণে তারা ন্যায়বিচার পাচ্ছে না। আর এ কারণেই তারা নিজেরাই বিচার করার চেষ্টা করছে, যা দীর্ঘমেয়াদে সমাজের জন্য মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করছে।
একদিকে যেমন অপরাধের সংখ্যা বাড়ছে, অন্যদিকে বিচারহীনতার মাত্রাও বাড়ছে। অতীতের মত অপরাধীরা ভাবছে, তারা অপরাধ করেও পার পেয়ে যাবে। কেননা, অনেক ক্ষেত্রেই অপরাধীদের সঠিক শাস্তি নিশ্চিত করা হচ্ছে না। বিচার ব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রতা, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর নতুন গেজে উঠা রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের বেপরোয়া করে তুলছে। সা¤প্রতিককালে দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা বিচারহীনতার এই সংস্কৃতির চরম দৃষ্টান্ত। একটি ঘটনার উদাহরণ হলো, এক ব্যবসায়ীকে চাঁদা না দেওয়ার অভিযোগে প্রকাশ্য দিবালোকে মারধর করা হয়। জনসমাগমের মধ্যেই তাকে রাস্তায় ফেলে নির্মমভাবে প্রহার করা হয়। আশেপাশে অনেক মানুষ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘটনা প্রত্যক্ষ করলেও কেউ তাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসেনি।
বাংলাদেশের সংবিধানে প্রতিটি নাগরিকের অধিকার এবং নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, মানুষ আজ নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত। বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায় এই ধরনের আইনবহির্ভূত বিচারিক কার্যক্রম বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। গ্রামের মানুষ নিজেরাই অপরাধীকে ধরে শাস্তি দেওয়ার চেষ্টা করছে, যা একটি সুস্থ সমাজের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এই প্রক্রিয়ায় অনেক নিরপরাধ মানুষও শিকার হচ্ছে ব্যক্তিগত প্রতিহিংসার। কেউ কেউ আবার রাজনৈতিক স্বার্থে এমন ঘটনায় মদত দিচ্ছে, যা সমাজে বিশৃঙ্খলা ছড়াচ্ছে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, এ ধরনের আইন হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা রোধ করতে হলে বিচার ব্যবস্থার সংস্কার অপরিহার্য। বিশেষ করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যকারিতা বৃদ্ধি করা এবং অপরাধীদের দ্রুত শাস্তি নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর একটি দীর্ঘ সময় পুলিশের নিয়মিত কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে। পুলিশের বহু গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়ায় তাদের চলাচলেও সমস্যা রয়েছে। থানা থেকে লুট হওয়া আগ্নেয়াস্ত্রের একটি বড় অংশ এখনো উদ্ধার করা যায়নি। ধারণা করা হচ্ছে, সেসব আগ্নেয়াস্ত্র সন্ত্রাসীদের হাতে চলে গেছে। ফলে দেশব্যাপী অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার বাড়ছে।
মানুষ নিরাপদে মান-সম্মান নিয়ে বাঁচতে চায়। তাই সারা দেশে পুলিশি কর্মকান্ড দ্রুত স্বাভাবিক করতে হবে। যৌথ অভিযানে মানুষ কিছুটা হলেও স্বস্তি পেয়েছে। এর পরিধি আরো বাড়াতে হবে। যেকোনো মূল্যে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হবে।