পুলিশকে পাশ কাটিয়ে দেশ গড়তে পারব না

3

পূর্বদেশ ডেস্ক

পুলিশকে উপেক্ষা করে সরকারের কোনো পরিকল্পনা বাস্তবায়ন যে কঠিন, সেই বাস্তবতা মানছেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেছেন, সরকার যাই কিছু করতে চায় না কেন, যে ভঙ্গিতেই করতে চায় না কেন, শেষ পর্যন্ত পুলিশের হাতেই বাস্তবায়ন করতে হয়। তারা করে দেবে না, তারা পরিবেশটা সৃষ্টি করে। ওই পরিবেশ না থাকলে তাহলে কোনো কাজই হয় না। গতকাল সোমবার তেজগাঁওয়ে নিজের কার্যালয়ে মাঠ পর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য দিচ্ছিলেন ইউনূস। খবর বিডিনিউজের।
তিনি বলেন, পুলিশকে অবহেলা করে বা পাশ কাটিয়ে গিয়ে দেশ গড়তে পারব না। তারাই সম্মুখসারির মানুষ। তারা ক্ষেত্র প্রস্তুত করলেই তখন বাকি জিনিসগুলো হয়।
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দিন দেশজুড়ে থানায় হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। আক্রমণের শিকার হতে থাকেন পুলিশ সদস্যরা। আগুন দেওয়া হয় থানা ও পুলিশের স্থাপনায়। লুট করা হয় অস্ত্র ও গোলাবারুদ। কয়েকদিন বাদে পুলিশ কাজে ফিরলেও হারানো সেই মনোবল ফেরেনি। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি।
ড. ইউনূস বলেন, পুলিশের কথা প্রসঙ্গে দুটি শব্দ বারবারই আমরা বলেছি, তা হলো আইন ও শৃঙ্খলা। এটিই হলো পুলিশ। আইন যদি না থাকে তাহলে সরকার কি, গণতন্ত্র কি, অধিকার কি, মানুষ-নাগরিক কি— কিছুই থাকে না। আইনশৃঙ্খলা ঠিক না থাকলে যত বড় চিন্তা থাকুক, যত টাকা ঢালুক, কোনো কাজে আসবে না।
জুলাইয়ে অভ্যুত্থানের ফলে সেই সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। এই সম্ভাবনার যে পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, সেটাকে যেন আমরা হারিয়ে না ফেলি। যেটুকু সময় আমাদের আছে, চেষ্টা করি। ভবিষ্যতেও যারা আসবে তারা চেষ্টা করবে, পথটা যেন আমরা সৃষ্টি করে দিই। এই পথে আমরা এগোলে সম্ভাবনাগুলো বাস্তবে পরিণত হবে।
সরকারপ্রধান বলেন, বাংলাদেশ পৃথিবীর যে সমস্ত অগ্রগামী দেশ, যারা পৃথিবীতে নেতৃত্ব দেয়- তাদের মধ্যে একটি হতে পারে। সেরকম সম্ভাবনা আছে। এটা কোনো আত্মতুষ্টির জন্য না। একটু বিচার করলেই মনে হয়, হ্যাঁ, এরকম সম্ভাবনা আছে।
পুলিশ বাহিনী দেশে ‘মস্ত বড়’ ভূমিকা রাখে মন্তব্য করে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, আইন যদি সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে পারি, শৃঙ্খলা যদি প্রতিষ্ঠিত করতে পারি, তাহলে যেকোনো যুদ্ধ জয় সম্ভব।
ভয়ংকর কর্মকান্ডের সঙ্গে পুলিশের সম্পৃক্ততার প্রসঙ্গ টেনে বাহিনীর কর্মকর্তাদের উদ্দেশে ইউনূস বলেন, পুলিশ বাহিনীর মুশকিল হলো, ওই অন্ধকার যুগের তারা একটিভ পার্টিসিপ্যান্ট ছিল। নিজের ইচ্ছায় না,সরকারি কাজ করতে হয়। কাজেই ‘আমরা কাজ করেছি, আমরা হুকুম পেয়েছি, করেছি; করতে করতে আমরাও ওরকম চিন্তার ওপর গেছি’। কাজেই নতুন বাংলাদেশ সৃষ্টি করার জন্য তোমাদের ওই চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে যে, আমরা নতুন বাংলাদেশ সৃষ্টি করব।
সরকারপ্রধান বলেন, আমাদের অনেক দোষ দেয়। আমরা দেখিয়ে দেব, আমরা মানুষ খারাপ না। আমরা খারাপ মানুষের পাল্লায় পড়েছিলাম। আমরা সেই খারাপ মানুষ থেকে বেরিয়ে এসেছি। ভালো মানুষ আমরা। আমরা দেখব, কী করতে পারি। সেই দৃঢ় চিন্তা মাথার ভেতরে রাখতে হবে। আমরা দেখিয়ে ছাড়ব-আমরা কী করতে পারি।
আমাদেরকে গালিগালাজ করে, মন্দ বলে। আমাদের কাজের মাধ্যমে দেখাব- আমাদের হাত দিয়েই নতুন বাংলাদেশ সৃষ্টি হবে।
তিনি বলেন, দেশ বদলাতে হলে একক নির্দেশে নয়, বরং সবাইকে নিয়ে এক একটি টিম হয়ে কাজ করতে হবে এবং ‘বাংলাদেশে যত টিম আছে, তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ টিম হলো পুলিশ।
পুলিশ হবে বন্ধু মন্তব্য করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এখন পুলিশ দেখলেই মানুষ ভয় পায়, কী সিস্টেমের মধ্যে আটকে ফেলে, একটা ভয়ংকর ক্যারেক্টার। আইন হলো আমাদের সবার আশ্রয়। পুলিশ হলো সেই আশ্রয়দাতা।
পুলিশ কর্মকর্তাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আইন আপনাকে সুরক্ষা দেবে। এই ইমেজ যদি প্রতিষ্ঠিত করতে পারি, অতীতের সব কথা মানুষ ভুলে যাবে।
পুলিশ বাহিনীর গায়ে গত ১৬ বছরের যে কালিমা মাখা আছে তা রাতারাতি পাল্টানো সম্ভব নয় মন্তব্য করে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এ বাহিনীর সদস্যদের সম্পূর্ণ নতুন ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠার আহবান জানান।
নির্বাচন প্রসঙ্গও উঠে আসে সরকারপ্রধানের বক্তব্যে। তিনি বলেন, এই সরকার অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, হাতে খুব বেশি সময় নাই, আমরা অলরেডি সাত মাস পার করে এসেছি। আমরা বলছি ডিসেম্বরে নির্বাচন হবে। কাজেই এর মধ্যে যা আমরা করতে চাই, যা আমাদের সামর্থ্য আছে, এগুলো করে ফেলা। এসময়ের মধ্যে যত সংস্কার দরকার তা করে ফেলার কথাও বলেন তিনি।
নির্বাচন আসছে, নানা রকম চাপ আসার আশঙ্কার কথা তুলে ধরে প্রধান উপদেষ্টা আইনের মধ্যে থেকে কাজ করার পরামর্শ দেন পুলিশ কর্মকর্তাদের। বলেন, আইনের ভেতরে থাকতে হবে, যাতে করে যে সরকার নির্বাচিত হয়ে আসবে, সে সরকার আইনের সরকার যেন হয়।
নারী ও সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, নারীদের সুরক্ষা দেওয়া, এটা একটা মস্ত বড় কাজ। আমাদের অবহেলার কারণেই এটা ক্রমেই সমাজের মধ্যে দ্রুত বিস্তার লাভ করেছে। আমাদের দেশের অর্ধেক মানুষ অসহায় হয়ে পড়েছে। তাদের দিকে দৃষ্টি দেবার কেউ নাই।
সংখ্যালঘু নিরাপত্তায় নাগরিক হিসেবে সংবিধান অনুসারে যত অধিকার দেওয়া আছে, সবগুলো নিশ্চিত করা আমাদের দায়িত্ব এবং সেই দায়িত্ব পুলিশের মারফতে আমাদের পালন করতে হয়।
অপপ্রচার থেকে সতর্ক থাকতে আবারও আহবান জানিয়ে ইউনূস বলেন, অপপ্রচারের কোনো একটা সূত্রপাত হলে, তোমার এলাকা যদি হয়, সঙ্গে সঙ্গে এটা রিপোর্ট করা যে এখানে একটা অপপ্রচার চলছে, এটাকে শিগগির পরিষ্কার করে ধরতে হবে, লোকে যেন ভুল ধারণার মধ্যে না থাকে। পুলিশের কাজে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানোরও নির্দেশ দেন তিনি।
স্টারলিংকের প্রসঙ্গও উঠে আসে প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যে। তিনি বলেন, স্টারলিংক আশা করি কিছুদিনের মধ্যেই শুরু হয়ে যাবে, হয়ে গেলে দেখবেন যে এই যে ফার্স্ট ইন্টারনেট এল, খুব দ্রæত গতির ইন্টারনেট হয়ে গেল, বর্তমান যে ইন্টারনেট আছে তার তুলনায় এটা এত গতি, তাতে সমস্ত কিছু হাতের মধ্যে চলে আসবে মুহূর্তের মধ্যে।