পুরানো জরিপেই আছে জীববৈচিত্র্যের অস্তিত্ব

1

নিজস্ব প্রতিবেদক

চুনতি অভয়ারণ্য দেশের অন্যতম একটি সংরক্ষিত বনাঞ্চল ও বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য। ২০১৪ সালের সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী এই বনাঞ্চলে এক হাজার ২০০ প্রজাতির উদ্ভিদ, ১৭৮ প্রজাতির জীবজন্তু ও পাখির অস্তিত্ব ছিল। চুনতি অভয়ারণ্যের গভীরে বসতি বৃদ্ধি, বনদস্যুদের উৎপাত, বৃক্ষনিধন, রেললাইন, বিদ্যুৎ লাইন নির্মাণের কারণে হাতি ছাড়া অন্যকোন বন্যপ্রাণী আগের মতো চোখে পড়ে না। এ সংরক্ষিত বনাঞ্চলে এখন কী পরিমাণ জীববৈচিত্র্য আছে তার সুস্পষ্ট কোন জরিপ নেই। দশ বছর আগের পুরানো জরিপেই এখনো চুনতি অভয়ারণ্যের অস্তিত্ব টিকে আছে। যে কারণে নতুন করে অভয়ারণ্যে জরিপ পরিচালনা করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
চট্টগ্রামের বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মকর্তা নূর জাহান পূর্বদেশকে বলেন, ‘সর্বশেষ ২০১৪ সালে অভয়ারণ্য নিয়ে জরিপ হয়েছিল। আমরা একটি জরিপ চালানোর প্রস্তাবনা দিয়েছিলাম। নিয়মানুযায়ী ৫-৬ বছর পরপর জরিপ করা উচিত। গবেষণাধর্মী কাজগুলো নিয়ে কাজ করা উচিত। অনেকেই মনে করে হাতি, বানর ছাড়া কিছু দেখা যায় না। বাস্তবতা এমন নয়। বন্যপ্রাণী চলাচলের নির্ধারিত রাস্তা আছে, মৌসুম আছে। রোদ কিংবা বৃষ্টিতে বন্যপ্রাণী দেখা যায় না। বনে গেলে অনেক বিরল প্রাণীর দেখা মিলে। বনের পরিবেশ ফিরিয়ে দেয়া গেলে জীববৈচিত্র্য টিকে থাকবে। এখন বনের পরিবেশ ফেরাতে আমরা চেষ্টা চালাচ্ছি। তবে জরিপটা অবশ্যই দরকার।’
বন বিভাগ সূত্র জানায়, সারাদেশে ২৫টি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য আছে। এরমধ্যে চট্টগ্রাম অঞ্চলের পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারেই আছে আটটি অভয়ারণ্য। এগুলো হলো- পাবর্ত্য চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটি পাবলাখালী বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, চট্টগ্রামে চুনতি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, কক্সবাজারে ফাঁসিয়াখালী বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, চট্টগ্রামের দুধপুকুরিয়া-ধোপাছড়ি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, হাজারিখিল বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, বান্দরবানে সাঙ্গু বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, কক্সবাজারে টেকনাফ বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, বাইশারী ব্যাংডেপা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য।
আয়তনের দিক থেকে সুন্দরবনের পর দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাবলাখালী বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য। ১৯৮৩ সালে অভয়ারণ্য স্বীকৃতি পাওয়া এই বনাঞ্চলটির আয়তন ৪২ হাজার ৬৯ হেক্টর।
চুনতি ও পাবলাখালী অভয়ারণ্যের জরীপ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সর্বশেষ জরিপ অনুসারে রাঙ্গামাটির কাচালং নদীর পাশে পাবলাখালী অভয়ারণ্যে হাতিসহ হাজারের বেশি প্রজাতির বন্যপ্রাণী ও পাখির বসবাস আছে। চুনতি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে ১২০০ প্রজাতির উদ্ভিদ, ছয় প্রজাতির উভচর, আট প্রজাতির সরীসৃপ, ১৩৭ প্রজাতির পাখি ও ২৭ প্রজাতির স্তন্যপায়ী জীববৈচিত্র্য পাওয়া যায়।
বন কর্মকর্তারা জানান, অভয়ারণ্যে এখন হাতি, বানর, শুকুর, রামকুত্তা, মায়া হরিণ, ধনেশ পাখি, ব্যাঙের নানা প্রজাতি, বনমোরগ, ফিঙ্গে পাখির বিরল প্রজাতি ভীমরাজের দেখা মিলে। সকালে বনে গিয়ে বিকালে ফিরলে পথিমধ্যে এরকম প্রচুর প্রাণীর দেখা মিলে। বনের ভেতরে বন্যপ্রাণী দেখলেও তা জনসম্মুখে বলতে চান না বন কর্মকর্তারা। তাদের মতে, শিকারিচক্র হরিণ, শুকুর শিকারের জন্য বসে থাকে। কোথাও এমন প্রাণীর অস্তিত্ব আছে জানলে তারা গিয়ে প্রাণী শিকার করে।

অভয়ারণ্যে ১৩ বাধা-নিষেধ অমান্য :বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন, ২০১২ অনুযায়ী অভয়ারণ্যে ব্যক্তি প্রবেশে ১৩টি বাধা-নিষেধ আছে। এগুলো হলো- চাষাবাদ করতে পারবে না, কোন শিল্প কারখানা স্থাপন বা পরিচালনা করতে পারবে না, কোন উদ্ভিদ আহরণ, ধ্বংস বা সংগ্রহ করতে পারবে না, কোন প্রকার অগ্নিসংযোগ করতে পারবে না, প্রধান ওয়ার্ড বা তৎকর্র্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোন কর্মকর্তার অনুমতি ব্যতীত কোন প্রকার আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না, কোন বন্যপ্রাণীকে বিরক্ত করতে বা ভয় দেখাতে পারবে না, কিংবা বন্যপ্রাণীর আবাস্থল বিনষ্ট হতে পারে এমন কোন কাজে ব্যবহৃত রাসায়নিক দ্রব্য, গোলাবরুদ বা অন্য কোন অস্ত্র বা দ্রব্য ব্যবহার করতে পারবে না। বিদেশি প্রজাতির প্রাণী বা উদ্ভিদ প্রবেশ করতে পারবে না, কোন গৃহপালিত পশু প্রবেশ করতে পারবে না, বন্যপ্রাণীর জন্য ক্ষতিকর পদার্থ বনে রাখা যাবে না, কোন খনিজ পদার্থ আহরণের জন্য অনুসন্ধান কিংবা গর্ত করতে পারবে না, উদ্ভিদের প্রাকৃতিক বংশ বিস্তারের উদ্দেশ্য ছাড়া অন্য কোন কারণে কোন উদ্ভিদ ও উদ্ভিদের অংশ কাটতে পারবে না, জলপ্রবাহের গতি পরিবর্তন, বন্ধ বা দূষিত করতে পারবে না, কোন এলিয়েন বা আগ্রাসী প্রজাতির উদ্ভিদ প্রবেশ করতে পারবে না।
আইনে থাকলেও এমন বাধা-নিষেধ মানা হয় না। এই আইন অমান্যের পেছনে বসতঘর নির্মাণ, বিদ্যুৎ লাইন স্থাপন, উন্নয়ন কাজ রয়েছে। এ বিষয়ে চট্টগ্রামের বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মকর্তা নূর জাহান পূর্বদেশকে বলেন, সামাজিক বনায়নে সুফল প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। এ প্রকল্পের অধীনে ২৫ শতাংশ আকাশমনি গাছ লাগানোর কথা থাকলেও আমরা একটি গাছও লাগাইনি। বিদ্যুৎ লাইন স্থাপন নিয়েও চিঠি দিয়েছি। বনের মধ্যে অনেকের নিজস্ব জায়গা থাকায় সমস্যা হচ্ছে। এসব সমস্যা নিরসনে সহসা উদ্যোগ নেয়া হবে।