কাজী আবু মোহাম্মদ খালেদ নিজাম
সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে পুকুরে ডুবে মৃত্যুর হার বেড়ে চলেছে যা খুবই উদ্বেগজনক। পাশাপাশি সাগর, নদীতে ডুবেও মৃত্যুর সংখ্যা কম নয়। প্রতিবার ঈদের সময় সড়ক দুর্ঘটনার পাশাপাশি পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঘটনা বেড়ে যায়। এবার সড়কের চেয়ে পানিতে ডুবে মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে। ঈদের পরের দুই দিনেই (রবিবার ও সোমবার) অন্তত ৩০ জন পানিতে ডুবে মারা গেছেন। এর মধ্যে বেশির ভাগই শিশু। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঈদের সময় অনেকে বেড়াতে যান। তারা সাঁতার কাটার চেষ্টা করেন। এতে দুর্ঘটনা ঘটে। এছাড়া অসতর্কতার কারণে পানিতে ডুবে শিশুদের মৃত্যুর খবর প্রায়ই পাওয়া যায়।
এই ঈদের ছুটিতেও কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে ঢেউয়ের মধ্যে স্নান করতে গিয়ে মৃত্যুকে আলিংগন করেছে কয়েকজন পর্যটক। চট্টগ্রামেও এই পবিত্র ঈদুল আযহার দিনগুলোতে পুকুরে ডুবে মারা গেছে বেশকয়েকজন।
চট্টগ্রামের পটিয়ায় পুকুরে ডুবে চাচা-ভাতিজার মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। সোমবার (৯ জুন) দুপুর ১২টার দিকে স্থানীয় একটি পুকুরে এ দুইজন মারা গেছেন। নিহত ব্যক্তিরা হলেন পটিয়া উপজেলার আশিয়া ইউনিয়নের মধ্যম বাথুয়া ৭ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা বজল আহমদের ছেলে মোহাম্মদ নাছির (৫৫) ও তার ভাতিজা মোহাম্মদ আইরিয়ান (১৫)। সে চুয়েট স্কুল এন্ড কলেজ এর অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। যিনি বাহার উদ্দিনের ছেলে। এছাড়া জেলার লোহাগাড়ায় ইটভাটার পুকুরে ডুবে মোহাম্মদ তানজিম (৪) নামে এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। রোববার (৮ জুন) সন্ধ্যায় উপজেলার পদুয়া ইউনিয়নের বার আউলিয়া কলেজ সংলগ্ন বার আউলিয়া ব্রিকস নামের ইটভাটার পুকুরে শিশুটি ডুবে যায়। তানজিম উপজেলার পদুয়া ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের মীর পাড়ার মাওলানা কাইছারের ছেলে। তানজিম হেফজখানায় পড়তো। রাংগুনিয়ায়ও পুকুর, নদীতে ডুবে কয়েকজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এছাড়া, সিলেট, লক্ষীপুর, গাইবান্ধাসহ দেশের অনেক এলাকায়ও পুকুর ডুবির ঘটনা ঘটেছে।
পুকুর ডুবির ঘটনা রোধে পারিবারিক ও সামাজিকভাবে মানুষের মাঝে সচেতনতা বাড়াতে হবে। অনেকসময় মা, বাবা, অভিভাবকের খামখেয়ালিপনার কারণে নিকটস্থ পুকুরে ডুবে পরিবারের ছোট সদস্যের (শিশু) মৃত্যুর ঘটনা অনেক। সাঁতার শেখাতে গিয়ে অথবা পুকুরে হঠাৎ তলিয়ে গিয়েও মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। দুপুরের নির্জন সময়টা সবচেয়ে ভয়ের। এসময় পরিবারের সদস্যরা ঘুমিয়ে পড়ে বা কাজে ব্যস্ত থাকতে গিয়ে শিশু সন্তানদের কথা ভুলে যাওয়ার কারণে; কাছের পুকুরে সন্তানের মৃত্যু দেখতে হয় যা খুবই মর্মান্তিক। এজন্য সচেতনতার কোন বিকল্প নেই। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সাঁতার জানা। এটি অনেকক্ষেত্রে জীবন বাঁচিয়ে দেয়। গ্রামের অনেকেই সাঁতার জানলেও শহরের অনেক মানুষ সাঁতার জানেনা। যে কারণে বিভিন্ন পর্যটন এলাকায় লেকে, পুকুরে ডুবে মৃত্যুর সংখ্যায় এগিয়ে শহুরে লোকজন। তাছাড়া, শহরে তো পুকুরই নেই; সাঁতার শিখবে কই? সুইমিং পুলে তো আর সবার যাওয়া সম্ভব হয়না।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ২০১৬ সালের সমীক্ষা অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১ থেকে ৯ বছরের শিশুর মৃত্যুর অন্যতম কারণ পানিতে ডুবে যাওয়া। ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। সাধারণত বাড়ির ২০ মিটারের মধ্যে অবস্থিত জলাধারে এবং দিনের প্রথম ভাগে পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঘটনা বেশি ঘটে। গ্রামাঞ্চলে পানিতে ডুবে মারা যাওয়ার এই হার শহরের চেয়ে বেশি। এর সম্ভাব্য কারণ হচ্ছে, গ্রামে পুকুর এবং ডোবার মতো ছোট ছোট জলাধারের সংখ্যা বেশি।
জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় উঠে আসে, পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধ করা সম্ভব এবং তা হ্রাসের হার শতকরা ৮৮ ভাগের বেশি হতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৪ সালের প্রতিবেদনে পানিতে ডুবে মৃত্যু রোধে তিনটি কৌশল সবচেয়ে কার্যকরী বলে উল্লেখ করা হয়। এগুলো হচ্ছে, ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য নিরাপদ ও সাশ্রয়ী শিশুযতেœর সুযোগ সৃষ্টি করা। পানিতে সুরক্ষা ও নিরাপদ উদ্ধারের ওপর জোর দিয়ে ৬ থেকে ১০ বছরের শিশুদের সাঁতার শেখার সুযোগ বৃদ্ধি করা। শিশুদের নিরাপত্তা ঝুঁকি এবং তা হ্রাস করার পদ্ধতি সম্পর্কে জনসাধারণ ও মা-বাবাদের সচেতনতা বাড়ানো।
বিশেষজ্ঞদের মতে, পুকুরে ডুবে মৃত্যু রোধে সাঁতার শেখানোর ওপর জোর দেওয়া হয়। কিন্তু বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, ৩ থেকে ৫ বছরের শিশুরা পানিতে ডুবে বেশি মারা যায়। ওই বয়সী শিশুদের তো সাঁতার শেখানো সম্ভব না। এর চেয়ে কম বয়সীও যারা আছে, তারা হামাগুড়ি দিয়ে পুকুরে চলে যেতে পারে। তাই আমরা পুকুরে বেষ্টনী দিতে উৎসাহিত করি। শিশু হামাগুড়ি দেওয়া শিখলে অভিভাবক তাদের বাড়ির আশপাশের পুকুরে বাঁশের বা টিনের ঘেরা দিতে পারে। এতে একটা প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়, যেটা পেরিয়ে শিশু পুকুরে যেতে পারবে না। হয়ত এটা বাস্তবায়ন কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়। তাই আমাদের বার্তা হচ্ছে, সাঁতারের পাশাপাশি পুকুরে যেন ঘেরা দেওয়া হয়।
তবে সবচেয়ে বড় কথা সচেতনতা তৈরি করা। সচেতনতাই পারে পুকুর ডুবি থেকে অনেকাংশ রক্ষা করতে। তাই আসুন, পরিবার ও সমাজে সচেতনতা সৃষ্টি এবং সাঁতার শেখার মাধ্যমে পুকুরে ডুবে মৃত্যু থেকে বাঁচার চেষ্টা করি।
লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট