বর্ষার বৃষ্টিপাত বাড়লেই পাহাড়ধস আতঙ্কে ঘুমহীন রাত কাটে ঝুঁকিপূর্ণভাবে পাহাড়ে বসবাসকারীদের। প্রতিবারই প্রশাসনের পক্ষ থেকে পাহাড়ধস ঠেকাতে পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়। এবারও ১৮ ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে বসতি স্থাপন করা অবৈধ দখলদার উচ্ছেদে সহযোগিতা চেয়ে ১৯টি দপ্তরে চিঠি দিয়েছে পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি। গতকাল (৩১ মে) উচ্ছেদ সংক্রান্ত চিঠি পাঠানো হয়েছে দপ্তরগুলোতে। ইতোমধ্যে পানি, গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন এবং উচ্ছেদ তদারকিতে গঠন করা হয়েছে চার সদস্যের মনিটরিং টিম। একইসাথে দখলদারদের তালিকা হালনাগাদ করাসহ ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় নিয়ে একটি ডকুমেন্টারি তৈরির উদ্যোগ নেয়ার কথা জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) ও পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য সচিব মো. নাজমুল আহসান পূর্বদেশকে বলেন, ‘পাহাড়ধসে যাতে কোনো মানুষের ক্ষতি না হয়, পাহাড় কাটা যেন বন্ধ হয় সেই ব্যবস্থাই করা হচ্ছে। শুধু নগরীতে নয়, উপজেলাগুলোতেও পাহাড় নিয়ে সমস্যা আছে। ঝুঁকিপূর্ণ অবৈধ বসতি থাকা ১৮টি পাহাড়ের মধ্যে কিছু পাহাড়ে মামলা সংক্রান্ত জটিলতা আছে। যে কারণে আইনগত বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে এগোতে হচ্ছে। ইতোমধ্যে পাহাড়ের উচ্ছেদ কার্যক্রম তদারকিতে একটি সাব কমিটিও করা হয়েছে। উচ্ছেদে সহযোগিতা চেয়ে সংশ্লিষ্ট সকল দপ্তরে চিঠি পাঠানো হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়গুলোকে ঘিরে একটি ডকুমেন্টারি বানানো হবে। যেটা সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পাঠিয়ে দিক নির্দেশনা চাওয়া হবে।’
এদিকে গতকাল চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন, পুলিশ, পরিবেশ অধিদপ্তর, গণপূর্ত বিভাগ-১, ২, ৩, সড়ক ও জনপথ বিভাগ, জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ, ফায়ার সার্ভিস, বিদ্যুৎ বিভাগ, কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিভিউশন লিমিটেড, ওয়াসা, রেলওয়ে, র্যাব-৭, বিভাগীয় তথ্য অফিস, চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব, সকল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও নগরীর ছয়জন এসিল্যান্ডকে উচ্ছেদে সহযোগিতা চেয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে উচ্ছেদ অভিযান শুরুর কথাও এ চিঠিতে জানানো হয়।
সর্বশেষ ২০০৭ সালে ভয়াবহতম পাহাড়ধসের ঘটনার পর ঝুঁকিপূর্ণ ৩০টি পাহাড়কে চিহ্নিত করা হয়। পরবর্তীতে ২০১৯ সালে ১৮টি পাহাড়ে মানুষের বসতি থাকায় এগুলোকে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ বলে ঘোষণা করা হয়। যে পাহাড়গুলোতে বর্ষা মৌসুম আসলেই উচ্ছেদ অভিযান চালায় প্রশাসন।
এরই অংশ হিসেবে বর্ষার আগে পাহাড়ে ঝুঁকিরোধে গত ৯ মে পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির ২১ তম সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ঝুঁকিপূর্ণভাবে পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারীদের উচ্ছেদ, অবৈধ বসবাসকারীদের বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন, পাহাড়ধসের বিষয়ে জনসাধারণকে সচেতন করা ও অবৈধভাবে পাহাড় কাটা বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সর্বশেষ সভায় পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (মহানগর) মোহাম্মদ নুরুল্লাহ নুরী বলেন, ‘১৮টি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে উচ্ছেদ অভিযান চালাতে হয়। এরমধ্যে ফিরোজ শাহ পাহাড়ে অবৈধভাবে বসবাস করছে তিন হাজার মানুষ। অথচ এ পাহাড়টি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ের তালিকায় নেই। এটি তালিকাভুক্ত করতে গেলে হাইকোর্ট বিভাগের মামলাকে বিবেচনায় নিতে হবে। জেলা প্রশাসন কর্তৃক বিভিন্ন পাহাড়ে অবৈধ দখলদারদের যে তালিকাটি করা হয়েছে সেটি হালনাগাদ করা প্রয়োজন। জেলা প্রশাসনের তালিকায় মতিঝর্ণা ও বাটালি হিল পাহাড়ে ১৬২টি পরিবার দেখানো হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে সেখানে দুই হাজারের উপর পরিবার আছে। এ পাহাড়ে বড় বড় ভবন আছে। এ জমির মালিক জেলা প্রশাসন এবং রেলওয়ে হলেও কোনো পক্ষই এ জমির লিজ প্রদান করেনি।’
মনিটরিং টিম গঠন : অবৈধ পানি, বিদ্যুৎ এবং গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্নকরণ কার্যক্রম মনিটরিং করার জন্য অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে (রাজস্ব) আহŸায়ক করে চার সদস্যের মনিটরিং টিম গঠন করা হয়েছে। এ কমিটি সংযোগগুলো বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে কিনা সে বিষয়ে তদারকি করবে। এছাড়াও ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে কোনো অবৈধ সংযোগ থাকলে তা বিচ্ছিন্ন করে প্রতিবেদন দিতেও বলা হয়েছে পাহাড় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে।
পাহাড় কর্তন রোধ : যে প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন পাহাড় আছে তাদেরকেই পাহাড় কর্তন রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির গত সভায় এমন কথাই বলেছেন কমিটির সভাপতি ও সদ্য বিদায়ী বিভাগীয় কমিশনার এবিএম আজাদ। সভায় তিনি বলেন, যার যার পাহাড় রয়েছে তাকে দায়িত্ব নিতে হবে। পাহাড় কর্তন রোধে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে সজাগ থাকতে হবে। রাত্রিকালীন পাহাড় কাটা বন্ধে টহল পুলিশকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। একইসাথে পরিবেশ অধিদপ্তরকেও জোরালো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
গতকাল দুপুরে নিজ কার্যালয়ে পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য সচিব ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. নাজমুল আহসান পূর্বদেশকে বলেন, ‘আমার নেতৃত্বে গঠিত সাব-কমিটি অন্যান্য সদস্যদের নিয়ে ইতোমধ্যে পাহাড় পরিদর্শন শুরু করেছি। ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়গুলোতে একটি দুষ্টুচক্র আছে। যারা মুনাফাভোগী। এ পর্যন্ত ১৯ বার সংযোগগুলো কাটা হয়েছে। তবুও কিভাবে আবারো সংযোগ নেয় তারা। পাহাড়ধস ঠেকাতে পাহাড়ের কাছাকাছি থাকা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে বলা হয়েছে। কয়েকটি এনজিও ও সিপিপি সদস্যদের সহযোগিতা নিয়ে পাহাড়ের পাদদেশ থেকে যাতে এই বর্ষা মৌসুমে ঝুঁকিতে বসবাসকারীরা সরে যান সেজন্য প্রচারণা চালানো হচ্ছে।’