মোহাম্মদ মন্জুরুল আলম চৌধুরী
‘দেশের বেশিরভাগ এলাকায় তাপপ্রবাহের মধ্যে টানা দুদিন মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রার আঁচ পেলো চট্টগ্রামবাসী। বন্দরনগরীতে গত ০৯ মে শুক্রবার ও ১০ মে শনিবার থার্মোমিটারের পারদ উঠেছে ৩৫ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে, যাকে চট্টগ্রামে এ মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বলছেন আবহাওয়াবিদরা”[সূত্রঃ দৈ/পূর্বদেশ, ১১ মে’২৫]। ফলে নগরে প্রচÐ গরম অনুভূত হয়েছে। আগামী দু-তিন দিনের মধ্যে এই তাপমাত্রা কমার সম্ভাবনা নেই। চট্টগ্রামসহ সারা দেশে তাপপ্রবাহ ঊর্ধ্বমুখী। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর সারা দেশে মৃদু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহের সতর্কবার্তা জারি করেছে। সূত্র জানায়, দেশের ওপর দিয়ে চলমান মৃদু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকতে পারে।০৯ মে২৫ শুক্রবার বেলা দুইটা থেকে পরবর্তী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে কোথাও কোথাও তীব্র তাপপ্রবাহও বয়ে যেতে পারে।তাপমাত্রা আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণে তীব্র গরম অনুভূত হচ্ছে। ‘চৈত্রের শেষ আর বৈশাখের শুরুতে সাধারণত গরমের তীব্রতায় হাঁসফাঁস করতে হয়। তবে এবার তীব্র গরম দেখা যাচ্ছে বৈশাখের শেষ দিকে এসে। সূর্যের প্রখরতায় হাঁসফাঁস হয়ে উঠেছে জনজীবন। তীব্র তাপপ্রবাহে পুড়ছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল। সারাদেশের হিসেবে মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়। আর ঢাকায় বিরাজ করছে মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। গত ১০ মে’২৫ শনিবার আবহাওয়া অধিদপ্তর এসব তথ্য জানিয়েছে’ [সূত্র; আমাদের সময়, ১১ মে’২৫]। যদিও এপ্রিল মাসে দেশে তাপপ্রবাহ অপেক্ষাকৃত কম ছিল। মে মাসের শুরুতেও তাপমাত্রা মোটামুটি স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু গত ০৬ মে’২৫ বুধবার থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে মৃদু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহ বিরাজ করছে। গত ০৯ মে’২৫ শুক্রবার দেশের ৪৫টি জেলায় তাপপ্রবাহ বয়ে যায়। এর মধ্যে চুয়াডাঙ্গা ও রাজশাহী জেলায় তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে গেছে। ঢাকা ও চুয়াডাঙ্গা ছাড়াও দেশে বেশকিছু জেলার তাপমাত্রা আজ ৪০ ডিগ্রিতে উঠেছে। এর মধ্যে যশোরে তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪০ দশমিক ২, রাজশাহীতে ৪০ দশমিক ৭, মানিকগঞ্জের আরিচায় ৪০, ফরিদপুরে ৪০ এবং টাঙ্গাইলে ৪০ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এদিকে চুয়াডাঙ্গায় দাবদাহে জনজীবন কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। রোদের তীব্রতায় সড়কের পিচ গলে যাচ্ছে। সারাদেশে অস্বাভাবিক গরমের কারণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা। বিশেষ করে খেটে খাওয়া মানুষ, শিশু ও বৃদ্ধরা পড়েছেন চরম দুর্ভোগ এবং ভোগান্তিতে। তাছাড়া নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া, ঠাÐা-জ্বর ও সর্দি-কাশির প্রকোপ বাড়ার পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বেড়েছে রোগীর সংখ্যাও।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য কেবল বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন নয়, স্থানীয় এবং মানবসৃষ্ট কিছু অনিয়মও দায়ী। উন্মুক্ত জলাশয় ও বনভূমির হ্রাস, পাহাড় নিধন, বন উজাড়, অপরিকল্পিত নগরায়ন, বিল ঝিল ডোবা পুকুর দখল-দূষণ সর্বোপরি অনিয়ন্ত্রিত শিল্পায়ন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের আবহাওয়াকে আরও উত্তপ্ত ও উষ্ণ করে তুলছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, পৃথিবীতে তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রধান কারণ মানুষের কিছু কার্যকলাপ। এগুলো হলো-১. জীবাশ্ম জ্বালানি দহনের ফলে বায়ুমÐলে গ্রিনহাউজ গ্যাসের নিঃসরণ বৃদ্ধি পায়। গ্রিনহাউজ গ্যাসগুলো বায়ুমÐলে তাপ আটকে রাখে, যার ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়।২. বন উজাড়ের ফলে গাছপালা কমে যায়, যা বায়ুমÐল থেকে কার্বন ডাইঅক্সাইড শোষণ করে। গাছপালা কমে গেলে বায়ুমÐলে কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়, যা পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি করে।৩. কৃষি কার্যক্রমের ফলে বায়ুমÐলে গ্রিনহাউজ গ্যাসের নিঃসরণ হয়। উদাহরণস্বরূপ, সার ব্যবহারের ফলে নাইট্রাস অক্সাইড নির্গত হয়, যা একটি শক্তিশালী গ্রিনহাউজ গ্যাস।৪. শিল্প কার্যক্রমের ফলে বায়ুমÐলে গ্রিনহাউজ গ্যাসের নিঃসরণ হয়। উদাহরণস্বরূপ, বিদ্যুৎ উৎপাদনের ফলে কার্বন ডাইঅক্সাইড নির্গত হয়।৫. যানবাহন থেকে নির্গত ধোঁয়া বায়ুমÐলে গ্রিনহাউজ গ্যাসের পরিমাণ বাড়িয়ে তোলে। ৬. পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির কিছু প্রাকৃতিক কারণও রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, সৌর ক্রিয়াকলাপ বৃদ্ধির ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়।৭. জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় প্রচুর গাছপালা কাটা হয়। এছাড়াও জলবিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে নির্গত বাষ্প বায়ুমÐলে মিশে তাপমাত্রা বৃদ্ধি করে।৮. পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে নির্গত তাপ বায়ুমÐলে মিশে তাপমাত্রা বৃদ্ধি করে।৯. আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতের ফলে বায়ুমÐলে গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গত হয়।১০. বরফ গলে গেলে তাপ গ্রহণ করে, যার ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়।১১. সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। এগুলোর মধ্যে জীবাশ্ম জ্বালানি দহন এবং বন উজাড় হলো পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কারণ। অব্যাহত অস্বভাবিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে বিভিন্ন ধরনের পরিবেশগত ও সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি হয়। এর মধ্যে রয়েছে-১. জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঝড়, বন্যা, খরা, তাপপ্রবাহ এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে, ২. পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে জীববৈচিত্র্য হ্রাস পাচ্ছে। অনেক প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণী তাদের আবাসস্থল হারিয়ে ফেলছে, ৩. মানুষের স্বাস্থ্যের সমস্যা-এর মধ্যে রয়েছে গরমের তাপপ্রবাহ, পানিবাহিত রোগ, খাদ্য ঘাটতি এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যা।
এক গবেষণা থেকে জানা গেছে যে, ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় উচ্চ তাপপ্রবাহের কারণে অনেকেই স্বাস্থ্য সমস্যায় ভোগেন কিন্তু এই সমস্যা মোকাবেলার বিষয়ে তাদের সচেতনতার অভাব রয়েছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে এরইমধ্যে উল্লেখযোগ্য ভাবে কৃষিখাতে ক্ষতিসাধন হয়েছে, যেমন ২০২১ সালের তাপপ্রবাহে ২১০০০ হেক্টরের বেশি ধান নষ্ট হয়েছে। পাশাপাশি দেশি এবং আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থাগুলো বলছে, শুধু ঢাকাতেই বছরে অসহনীয় গরম দিনের সংখ্যা গত ছয় দশকে অন্তত তিনগুণ বেড়েছে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্লানার্সের মতে গরম বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হচ্ছে — গত ২৮ বছরে ঢাকা থেকে ২৪ বর্গকিলোমিটারের সমআয়তনের জলাধার ও ১০ বর্গকিলোমিটারের সমপরিমাণ সবুজ কমে গেছে। উক্ত ইনস্টিটিউটের সভাপতির মতে, এটা শুধু ঢাকার চিত্র নয় বরং সারাদেশে জেলা-উপজেলা পর্যায়েও পুকুর বা জলাধার ভরাট করে অপরিকল্পিত ভবন উঠেই চলেছে। দেশের নগরগুলোতে পরিকল্পিত ভবন গড়ে তোলার পাশাপাশি সবুজের যথাযথ ভারসাম্যের পদক্ষেপ না নিলে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ কঠিন হবে। দেশে বৃক্ষ রোপণ কর্মসূচী একটি বিশেষ দিন বা সপ্তাহের গন্ডীর মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে সার্বজনীনভাবে সারাবছর কার্যকর করার উদ্যোগের পাশাপাশি পতিত বা অনাবাদী জমিতে চাষাবাদ বা গাছ লাগাতে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। দেশজ ফলজ বনজ ঔষধি গাছ লাগানোর জন্যে মানুষকে উৎসাহ দেয়াটাও জরুরি। তাই নগরগুলোয় পরিকল্পিত ভবন এবং তৎসংলগ্ন এলাকাগুলোয় ব্যাপক হারে বৃক্ষরোপণ করে ২৫-৩০ শতাংশ সবুজায়ন নিশ্চিত করতে হবে।পাহাড় কাটা বন্ধে ও বন উজাড়ে এবং প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার জন্যে পরিবেশ অধিদপ্তরকে নিছক জরিমানা বা কয়েকদিনের জেল জরিমানার হাস্যকর ব্যবস্থা থেকে সরে এসে দৃঢ়তার সাথে জিরোটলারেন্স প্রদর্শনের পাশপাশি বিদ্যমান আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধনীর মাধ্যমে কঠিন কঠোর দৃষ্টান্তমুলক শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
নদী দখল দূষণ বন্ধে আইনের প্রয়োগকে শক্তিশালী ও কার্যকর করার পাশপাশি পুকর ডোবা খাল বিল ঝিল রক্ষা করে পানি ধরে রাখার প্রাকৃতিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। অন্যদিকে ডিজেলচালিত গণপরিবহণ কমিয়ে মেট্রো রেলের মতো বিদ্যুৎচালিত গণপরিবহণ বাড়ানোর পাশাপাশি পরিবেশবান্ধব ভবন নির্মাণ করতে হবে। শহরের সুবিধাগুলোকে শহরের বাইরে ছড়িয়ে দিয়ে জনসংখ্যার ঘনত্ব কমিয়ে আনতে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।তাপদাহের তীব্রতা হ্রাসের মাধ্যমে শীতাতপ যন্ত্রের এবং কংক্রিটের ব্যবহারের পরিমাণ কমাতে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। মানুষের খাদ্যাভ্যাসে মাংসের পরিবর্তে সবজি এবং ফলের ওপর নির্ভরতা বাড়াতে হবে। ভাজাপোড়া, দুগ্ধজাত ও চর্বিজাতীয় খাবার কমাতে হবে কেননা এসব খাদ্যের উৎপাদন বিপণন প্যাকিং এবং পরিবহণে প্রচুর পরিমাণে গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন হয়। তাই হোটেল-রেস্টুরেন্টের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে ঘরে তৈরি খাবারের প্রতি মনোযোগ দিতে হবে। কিছুক্ষণ পরপর লবণ ও লেবুযুক্ত পানি খাওয়ার পাশাপাশি অন্তত আধা ঘণ্টা পরপর ছায়ায় বা গাছের নিচে বসে বিশ্রাম নেয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। সবার সম্মিলিত ও আন্তরিক প্রচেষ্টায় তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক বিষয়গুলো সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রচারে গুরুত্ব দিয়ে জন-সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।
দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যে গড়ে তুলতে হবে একটি নিরাপদ, বাসযোগ্য ও সহনীয় তাপমাত্রার সবুজ বসুন্ধরা। মনে রাখতে হবে, দেশের তাপমাত্রা হ্রাসের জন্যে সবুজ বনায়ন বৃদ্ধি, পাহাড় কাটা বন্ধ ও খাল নদী ভরাট এবং দূষণরোধে কঠিন কঠোর আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই।
লেখক : প্রাবন্ধিক