পাহাড়ের দুর্নীতির বরপুত্র দীপংকর

1

এম. কামাল উদ্দিন, রাঙামাটি

রাঙামাটির দুর্নীতির বরপুত্র দীপংকর তালুকদারকে অবশেষে ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সোমবার সন্ধ্যায় রাজধানী ঢাকার সোবহানবাগ এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। এতোদিন পলাতক ছিলেন তিনি।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে দীপংকর ছিলেন রাঙামাটির দুর্নীতির বরপুত্র। ছিলেন দোর্দন্ড প্রতাপশালী। ১৯৯৬ সাল থেকে টানা ২৯ বছর ধরে রাঙামাটি জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি পদে আসীন তিনি। রয়েছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য পদেও। দীপংকর আওয়ামী লীগের মনোনয়নে জাতীয় সংসদের ২৯৯- পার্বত্য রাঙামাটি আসন থেকে ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১, ২০০৮, ২০১৪, ২০১৮ এবং সবশেষ ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির দ্বাদশ নির্বাচনে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করেন। তার মধ্যে হেরেছিলেন ২০০১ সালে বিএনপির মণি স্বপন দেওয়ান এবং ২০১৪ সালে জনসংহতি সমিতির ঊষাতন তালুকদারের কাছে।
১৯৯৬ সালের নির্বাচনে তার দল ক্ষমতায় গেলে প্রতিমন্ত্রী মর্যাদায় ভারত প্রত্যাগত উপজাতীয় শরণার্থী ও অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু পুনর্বাসন টাস্কফোর্সের চেয়ারম্যান ছিলেন। ২০০৮ সালে দলটি আবার ক্ষমতায় গেলে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নিয়োগ পান। এছাড়া ২০১৮ সালের নির্বাচনে পর খাদ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি এবং ২০২৪ সালে পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পান তিনি। দীর্ঘকাল ধরে ক্ষমতায় থাকাকালে দীপংকরের বিরুদ্ধে রয়েছে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ। রয়েছে হত্যার অভিযোগও। ইতোমধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) তার বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগসহ একাধিক মামলা হয়েছে।
ক্ষমতার দোর্দন্ড প্রতাপে দীপংকর এমন ভয়ঙ্কর প্রকৃতির ছিলেন, তার বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ কেউ কিছু বলার সাহস করেননি। নিজ দলের নেতা-কর্মীরাও এই সাহস করতেন না। বিএনপি, জামায়াতসহ অন্য রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের আন্দোলনে মাঠে নামতে দেননি। কঠোর অবস্থানে ছিলেন জনসংহতি সমিতিসহ পাহাড়িদের আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর বিপক্ষে। জুলাই’২৪ বিপ্লবে নিজ দলীয় ক্যাডারদের লেলিয়ে দিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার ওপর হামলা চালিয়ে আন্দোলনকারীদের মাঠে নামতে দেননি। দীর্ঘ দিনের ক্ষমতার প্রতাপে দীপংকরের কথার বাইরে বলার বা চলার সাহস পাননি দলের লোকজনও। দলের কেউ তার কথার বাইরে যেতে চাইলে তার বিরুদ্ধে নিতেন কঠোর ব্যবস্থা। বের করে দিতেন দল থেকে। সরাসরি বাদ দিতেন কমিটি থেকেও।
সবশেষ ২০২২ সালের ২৪ মে জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে নিখিল কুমার চাকমা সভাপতি পদে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করতে চাইলে তাকে সমর্থন দেওয়ায় জেলা আওয়ামী লীগের ২০ জ্যেষ্ঠ নেতাকে কমিটি থেকে বাদ দেন দীপংকর। নিখিলকে তার বিপক্ষে দাঁড়াতেও দেননি দীপংকর। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনাকে দিয়ে ফোন করিয়ে বসিয়ে দিয়েছিলেন নিখিলকে। ক্ষমতার অহংকারে সব সময় নিজ দলের সাধারণ নেতা-কর্মীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার, অসদাচরণ, বঞ্চনা, নির্যাতনের মতো কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার গুরুতর অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। অনেক সময় সাধারণ মানুষ আবেদন নিয়ে গেলে দরখাস্ত ছিঁড়ে ফেলে দেওয়ার অভিযোগও আছে তার বিরুদ্ধে।
রাঙামাটি জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও কৃষক লীগের সভাপতি অনিলচন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যাকে হত্যার অভিযোগে দীপংকর তালুকদারের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন তার পরিবার। ২০১২ সালের ১০ জানুয়ারি অপহরণের শিকার হয়েছিলেন অনিল তঞ্চঙ্গ্যা। দীপংকরের ইন্ধনে অপহরণের পর তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয় বলে অভিযোগ অনিলের পরিবারের। দীপংকরের বিপরীতে দলীয় মনোনয়ন নিয়ে তদবির ছিল অনিল তঞ্চঙ্গ্যার অপরাধ।
অনিল তঞ্চঙ্গ্যার স্ত্রী সান্তনা চাকমা বলেন, হত্যা মামলা দায়ের করার পর দীপংকর তালুকদারের চাপে মামলাটি প্রত্যাহার করতে হয়েছিল। পরে আদালত মামলাটি একেবারে খারিজ করে দিয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ দুঃশাসনামলে রাঙামাটির সর্বোচ্চ প্রতাপশালী ও ক্ষমতাধর ব্যক্তি ছিলেন দীপংকর তালুকদার। তিনি ২০১৪ সালের নির্বাচনে হেরে গেলেও ব্যবহার করতেন সরকারি গাড়ি এবং উদ্বোধন ও ভিত্তিপ্রস্তুর স্থাপন করতেন সরকারি উন্নয়ন প্রকল্প। প্রধান অতিথি থাকতেন সরকারি বিভিন্ন কর্মসূচিতে। দলীয় ও প্রশাসনিক সব কাজে তার হাতেই ছিল মূল ক্ষমতা। তিনি নিয়ন্ত্রণ করতেন নিয়োগ, দরপত্র কাজের বন্টন, ঠিকাদারি, উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে মনোনয়নসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদির। যেখানে মুক্ত ছিল না স্থানীয় প্রশাসনও। বিস্তর অনিয়ম, দুর্নীতি, নিয়োগ বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, ভুয়া প্রকল্পে লুটপাট করেছিলেন সরকারের হাজার কোটি টাকা। বনেছেন অঢেল সম্পদ, অর্থ ও বিত্ত-বৈভবের মালিক।
ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) সূত্র জানায়, দীপংকর তালুকদার একাধিক মামলার আসামি। রাজধানীর সোবহানবাগে তার অবস্থান নিশ্চিত হলে ডিবি পুলিশের একটি দল তাকে গ্রেপ্তার করে। গত বছর ৫ আগস্টের পর রাঙামাটিতে দীপংকরের বিরুদ্ধে কোনো মামলা না হলেও চট্টগ্রাম ও রাঙ্গুনিয়ায় কয়েকটি মামলা হয় বলে জানা গেছে। অবশেষে ঢাকায় মহাসমাবেশে যুবদল নেতা শামীম হত্যা মামলায় সোমবার গ্রেপ্তার করা হয় দীপংকরকে। ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশের ডাক দেয় বিএনপি। একই দিনে আওয়ামী লীগও পাল্টা সমাবেশ ডাকে। পরে পুলিশের সহায়তায় বিএনপির মহাসমাবেশে হামলা চালানো হয়। হামলায় যুবদল নেতা শামীম নিহত হন। এ ঘটনায় ২০২৪ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর রাজধানীর পল্টন থানায় একটি মামলা করা হয়।