
অমল বড়ুয়া
পানি মানুষের জীবনের জন্য অপরিহার্য। কিন্তু বিশ্বের অনেক মানুষ এখনও পর্যাপ্ত বিশুদ্ধ পানির অভাবে রয়েছে। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার ছয় নম্বর লক্ষ্যমাত্রায় রয়েছে ২০৩০ সালের মধ্যে সব মানুষের জন্য সুপেয় বা বিশুদ্ধ পানি ও স্যানিটেশন নিশ্চিত করার অঙ্গিকার। বিশ্বব্যাংক, বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা এবং ইউনিসেফের বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের ৯৮ ভাগ মানুষের আওতার মধ্যে পানির কোনো না কোনো উৎস রয়েছে। কিন্তু এর সবটাই পানযোগ্য নয়। বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, পাইপলাইনের মাধ্যমে সরবরাহ করা ৮০ শতাংশ পানিতে ক্ষতিকর জীবাণু ই-কোলাই রয়েছে। পুকুরের পানিতেও একই মাত্রায় এই ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। যথাযথ স্যানিটেশন সুবিধা না থাকাকে পানি দূষিত হয়ে পড়ার অন্যতম একটি কারণ বলে বিভিন্ন প্রতিবেদন বলছে। আর সুপেয় পানির অপর্যাপ্ততার সাথে আরও সংযুক্ত হয়েছে নতুন ভিন্ন একটি বিষয় বৈশি^ক উষ্ণায়ন। প্রসঙ্গত বায়ুমন্ডলে অতিমাত্রায় কার্বন নিঃসরণের ফলে ক্রমাগত বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, দ্রæত জলবায়ুর পরিবর্তন হচ্ছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন সুপেয় পানিকে ক্রমেই দুস্প্রাপ্য করে তুলছে। সমস্যাটা হলো, পৃথিবী পৃষ্ঠের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই পানি দ্বারা আচ্ছাদিত। তবে জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, এর মাত্র শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ ব্যবহারযোগ্য মিঠা বা পানযোগ্য পানি। বাড়তি তাপমাত্রা ও খরার কারণে সেটাও আবার দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে।
তাছাড়া বিশ্বব্যাপী সুপেয় পানির সংকটের মূলে আরও কিছু কারণ নিহিত রয়েছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- জনসংখ্যা বৃদ্ধি, নগরায়ণ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানির অপরিকল্পিত ব্যবহার। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৃষ্টিপাতের ধরন পরিবর্তিত হচ্ছে, যার ফলে কোথাও দেখা যাচ্ছে অতিবৃষ্টির প্রাবাল্য আবার কোথাও সৃষ্টি হচ্ছে নিদারুণ খরা। নগরায়ণের কারণে ভরাট হচ্ছে পুকুর, ডোবা, জলাশয়, দীঘি, খাল, বিল ও নদী। এতে করে পানির উৎসগুলো ক্রমশ সংকীর্ণ ও শুকিয়ে যাচ্ছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে পানির মারাত্মক দুষণ। শিল্প বর্জ্য, পয়ঃনিষ্কাশন, গৃহস্থালীর ব্যবহৃত বর্জ্য এবং রাসায়নিক পদার্থের সংমিশ্রণে নদী ও অন্যান্য পানির উৎসগুলো দূষিত হচ্ছে, যার ফলে সুপেয় পানির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। কৃষি ও অন্যান্য কাজে অপরিকল্পিতভাবে এবং বেশি পরিমাণে পানি ব্যবহারের কারণে সুপেয় পানির ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। কৃষিতে সেচের কাজে পানির ব্যবহার বাড়ছে।
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) হিসাব অনুযায়ী, দেশের প্রায় ৫৫ লাখ হেক্টর জমি সেচের আওতায় রয়েছে। বোরো মৌসুমে সেচের পানির প্রায় ৭৫ ভাগের উৎস ভূগর্ভস্থ পানি। প্রতিবেদন মতে, সেচের জন্য ১৯৮৫ সালে দেশে নলকূপের সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৩৩ হাজার ৮০০। ২০১৯ সালে এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ। বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। ফলে এই দেশের কৃষি থেকে শুরু করে ব্যবসা-বাণিজ্য, যাতায়ত, পরিবহণসহ বিভিন্নভাবে নদী ও তার পানি ব্যবহৃত হচ্ছে। পরিজার তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশে ছোট-বড় ৪০৫টি নদী রয়েছে। এর মধ্যে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে অভিন্ন নদীর সংখ্যা ৫৭টি। ৫৪টি ভারতের এবং ৩টি মিয়ানমারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। দেশের নদীগুলোর ৪৮টি সীমান্ত নদী, ১৫৭টি বারোমাসি নদী, ২৪৮টি মৌসুমি নদী। মানুষের অত্যাচারে নদীগুলো আজ মৃতপ্রায়। বর্তমানে কৃষি, শিল্প ও গৃহস্থালী কাজে অপরিকল্পিত পানীয় জলের উত্তোলনের কারণে ভূগর্ভস্থ পানিতে লবণাক্ততা বাড়ছে। একই সাথে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলেও উপকূলীয় অঞ্চলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রতি বছর ১ সে.মি করে বৃদ্ধি পাচ্ছে, যার কারণে পানিতে লবাক্ততা বাড়ছে।
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে বর্তমানে ২ দশমিক ২ বিলিয়ন মানুষ বিশুদ্ধ পানীয় জল থেকে বঞ্চিত এবং এদের সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্ব জনসংখ্যা ২ মিলিয়ন বাড়বে অর্থাৎ ৯৩০ কোটি হবে এবং বিশ্বব্যাপী পানির চাহিদা ৩০ শতাংশ বাড়বে। তথ্যমতে, আগামী ২০৫০ সালের মধ্যে ৯৩০ কোটি মানুষের মধ্যে ৭০০ কোটি মানুষই পানির সমস্যায় পড়বে। গ্লোবাল কমিশন অন দ্য ইকনমিক্স অব ওয়াটারের প্রতিবেদন ২০২৩-এ সতর্ক করে বলা হয়েছে যে, ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বে পানির সরবরাহে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত ঘাটতি দেখা দিতে পারে। অন্যদিকে ২০৫০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক জনসংখ্যা পৌঁছাবে ৯৭০ কোটিতে। আসন্ন এই সুপেয় পানি সংকটের মোকাবেলায় আমাদের করণীয় কি হতে পারে ? বিশ্বের মোট পানির ৯৫ শতাংশের বেশি সাগরে থাকায় অনেকেই মনে করেন, সমুদ্রের পানি একটি সম্ভাব্য সমাধান হতে পারে, যদিও বর্তমানে বিশ্বব্যাপী মোট পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে এর মাত্রা খুবই নগণ্য। গ্লোবাল ওয়াটার ইন্টেলিজেন্স (জিডব্লিউআই)’র তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে প্রায় পাঁচটির মধ্যে চারটি দেশ পানীয় ও অন্যান্য কাজে সমুদ্রের পানি লবণমুক্ত করে ব্যবহার করছে, আর এই সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। কুয়েত, ওমান ও সৌদি আরবে এখন সরবরাহকৃত মোট পানির ৮০ শতাংশের বেশি আসে লবণমুক্তকরণ থেকে- হয় তা সমুদ্রের পানি অথবা আধা-লবণাক্ত ভূগর্ভস্থ পানির উৎস থেকে। সম্প্রতি ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা লক্ষ্য করে চালানো হামলার সময় উপসাগরের পানি দূষিত হতে পারে বলে উদ্বেগ জানিয়েছিলেন কাতারের কর্মকর্তারা। কারণ এটিই এখন কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও কুয়েতের পানির প্রধান উৎস। গবেষণায় দেখা গেছে, বর্তমানে বিশ্বজুড়ে ২০ হাজারেরও বেশি স্থানে লবণমুক্তকরণ প্ল্যান্ট রয়েছে, যা এক দশক আগের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। গ্লোবাল ওয়াটার ইন্টেলিজেন্স (জিডবিøউআই)’র তথ্যমতে, বিশ্বের প্রায় ১৬০টি দেশে এখন সমুদ্রের পানি প্রক্রিয়াজাত করার জন্য লবণমুক্তকরণ প্ল্যান্ট রয়েছে। গড়ে উৎপাদিত পানির প্রায় ৬০ শতাংশ জনসাধারণের পানীয় জল সরবরাহে ব্যবহৃত হয়। জিডব্লিউআই অনুমান করছে, এই খাত প্রতিবছর ১০ শতাংশেরও বেশি হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সংস্থাটি বলছে, গত ১৫ বছরে বিশ্বের সব অঞ্চলের ৬০টিরও বেশি দেশে খাবার পানির লবণমুক্তকরণ উৎপাদন উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। অনেক দেশেই উৎপাদন দ্বিগুণ, তিনগুণ বা চারগুণ বেড়েছে (যেমন সিঙ্গাপুরে বেড়েছে ৪ দশমিক ৬৭ শতাংশ), আবার কিছু দেশে ১০ থেকে ৫০ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। জিডব্লিউআই’র হিসেবে, সৌদি আরব বিশ্বের সবচেয়ে বেশি লবণমুক্ত সমুদ্রের পানি উৎপাদন করে। প্রতিদিন হিসেব করলে এর পরিমাণ ১৩ বিলিয়ন লিটার। এই পরিমাণ পানি দিয়ে ৫ হাজার ২০০টি অলিম্পিকমানের সুইমিং পুল ভরাট করা সম্ভব। তবে লবণমুক্তকরণ প্রক্রিয়ার একটি অন্যতম বড় অসুবিধা হলো লবণাক্ত পানি নিষ্কাশন। মূলত দুইভাবে লবণমুক্তকরণ করা হয়। প্রথম ও সবচেয়ে প্রচলিত এবং শক্তি-সাশ্রয়ী পদ্ধতি হলো রিভার্স অসমোসিস বা বিপরীত অভিস্রবণ। এর মাধ্যমে চাপ প্রয়োগ করে পানি অর্ধেক ভেদ করা যায় এমন পর্দার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত করা হয়, যা লবণ ও অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থ আটকে রাখে। দ্বিতীয় পদ্ধতি হলো তাপীয় লবণমুক্তকরণ। এতে সমুদ্রের পানি বা আধা-লবণাক্ত পানি গরম করা হয়, যা পরে বাষ্পে রূপান্তরিত হয় এবং সেই বাষ্প ঘনীভূত করে মিষ্টি পানি হিসেবে সংগ্রহ করা হয়। এই লবণাক্ত পানি আবার সমুদ্রে ছাড়লে পানির লবণত্ব ও তাপমাত্রা বেড়ে যায়, যা সামুদ্রিক পরিবেশের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে এবং মৃত অঞ্চল (ডেড জোন) তৈরি করতে পারে।
জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচি- ইউএনইপি’র মতে, ‘অধিকাংশ লবণমুক্তকরণ প্রক্রিয়ায়, প্রতি লিটার পানির জন্য প্রায় দেড় লিটার ক্লোরিন ও তামা দূষিত তরল উৎপন্ন হয়। যদি এটি সঠিকভাবে পাতলা করা ও ছড়ানো না হয়, তবে এটি বিষাক্ত লবণপানির ঘন মেঘ তৈরি করে যা উপকূলীয় ও সামুদ্রিক পরিবেশের অবনতি ঘটায়। মিসর ও সৌদি আরবের মধ্যে অবস্থিত আকাবা উপসাগরের প্রবালপ্রাচীর এবং শৈবালের উপর গবেষকরা উল্লেখযোগ্য নেতিবাচক প্রভাব পর্যবেক্ষণ করেছেন। তবে পরিবেশগত এই ব্যয় সত্তে¦ও দ্রুত উষ্ণায়নশীল ও পানির জন্য তৃষ্ণার্ত এই পৃথিবীর প্রায় সব অঞ্চলে লবণমুক্তকরণের প্রবণতা বাড়তেই থাকবে বলে মনে হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ১৯৭০ সালের পর থেকে লবণমুক্ত পানি উৎপাদনের খরচ প্রায় ৯০ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। ইডব্লিউডব্লিউআই’র গবেষণা অনুযায়ী, ২০৪০ সালের মধ্যে উপকুলীয় অনেক এলাকায় সৌরশক্তির সঙ্গে লবণমুক্তকরণ প্রযুক্তি মিলিয়ে ব্যবহার করলে এটি আরও সাশ্রয়ী হতে পারে। বাংলাদেশও সুপেয় পানির সংকটে আছে, যা ভবিষ্যতে আরও প্রকট হবে মূলত বিপুল জনসংখ্যা ও উপকুলীয় অঞ্চল হওয়াই। বাংলাদেশের এই বিশাল জনগোষ্ঠীর বিশুদ্ধ পানি সংকট মোকাবেলায় পানির বিকল্প উৎসের সন্ধান ও বঙ্গোপসাগরের বিশাল নীল জলরাশিকে ব্যবহার করে লবনমুক্তকরণে প্রয়োজনীয় কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের এখন সময় এসেছে।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট











