পাখির বন্ধু বঙ্গবন্ধু

137

 

-বাবা, আমার আর্ট কম্পিটিশনের ফাইনাল রাউন্ড কাল। বিষয় বঙ্গবন্ধু। আমি ঠিক করতে পারছিনা কী আঁকবো। এই কম্পিটিশনে আমি ফার্স্ট হতে চাই।
বাবা হেসে বললো,
– ফার্স্ট হওয়া জরুরি? তবে হ্যাঁ, প্রতিযোগিতায় জেতার আগ্রহ থাকা খুব ভালো।
-বাবা, আমি এতো কষ্ট করে ফার্স্ট রাউন্ড, সেকেন্ড রাউন্ড জিতে ফাইনাল রাউন্ডে এসেছি। কেন ফার্স্ট হবোনা! শিফার কথায় আবদার।
বাবা বললো,
– আচ্ছা বসো। তোমাকে আগে কিছু কথা বলি। ওই কম্পিটিশনে যারা অংশ নেবে তারা সবাই-ই তো ফার্স্ট হতে চাইবে মা! কিন্তু সবাই কি ফার্স্ট হবে? তবুও প্রতিযোগিতা হয়। সবাই আনন্দের নিয়ে অংশগ্রহণ করে। কেউ জেতে, কেউ হারে। সেটা নিয়ে মন খারাপ করতে নেই। আচ্ছা, একটি কথা বলতো-জিততে পারার খুশিটা অবশ্যই অনেক আনন্দের। যদি না-ও জেতে, তাহলে কি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করা বাদ দেবে?
-না বাবা। আমি পরে আরেকটি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করবো।
বাবা হলো শিফার প্রিয় বন্ধু। প্রিয় শিক্ষক। বললো,
-এই তো। এটাই হচ্ছে কথা। তুমি না জিতলেও জানবে অনেককিছু। তবে আমি জানি আমার মা-মণি খুব ভালো আঁকবে। বাবার কথায় সাহস পেয়ে শিফার হাসি আরো উজ্জ্বল হয়।
-তুমি বঙ্গবন্ধুর কথা বলো। সবাই বঙ্গবন্ধুর একা ছবি নয়তো ৭ মার্চের ভাষণের ছবি আঁকে। আমিও বঙ্গবন্ধুর ছবিই আঁকবো। কিন্তু অন্যরকম। তুমি আমাকে তাঁর কথা বলো না!
-আচ্ছা শোনো,
মুরগিটা মরেই গেলো। পিঁয়াজের রস, রসুনের রস, যে যা বলছে সবই খাওয়াচ্ছেন মুরগিটিকে বাঁচানোর জন্য। পরে তাঁর মনে হলো এতো অত্যাচার করলে ও শেষ হয়ে যাবে। তাই ঠিক করলেন, মাঝে মাঝে কিছু পানি, কিছু খাবার খেতে দেবেন। মাথা ধুইয়ে দেন ধুইয়ে দেন মুরগির মাথা। তবুও বাঁচানো গেলোনা তাকে। তিনটি মুরগির মধ্যে একটি চলে গেলো যত্নের শেকল ছিঁড়ে। ও চলেই গেলো। যেখান থেকে আর ফেরা যায় না।
বাবার দিকে তাকিয়ে রইলো শিফা। সারা মুখে মেঘের কালির মতো কষ্ট মাখা। মুরগিটার জন্যে মন কেমন করছে। কিন্তু বুঝতে পারছেনা বাবা হঠাৎ কোন মুরগির কথা বলা শুরু করলো!
-বাবা, আমি বঙ্গবন্ধুর কথা বলতে বলেছি।
-আমিও তাঁর কথাই বলছি মা। এই মুরগি যেমন তেমন মুরগি নয়। বঙ্গবন্ধুর আদরের মুরগি।
আশ্চর্য হয়ে শিফা জানতে চাইলো,
-বঙ্গবন্ধুর মুরগি!
-হ্যাঁ। শুধু মুরগি? বঙ্গবন্ধুর জীবনের বেশিরভাগ সময় তো জেলেই কেটেছে। তিনি বলতেন, “জেল তাঁর আরেকটা বাড়ি।” ওই বাড়ির ছোটো মাঠে ছিলো ঘাস। ছিলো লাউ ঝিঙে লতা। কবুতর ছিলো। মুরগি ছিলো। কাকদের বাসা করার জন্যেও ছিলো তিনটা আলাদা গাছ।
শিফা খুব মনযোগ দিয়ে শুনছে বাবার কথা। এ যেন এক রূপকথা। এক বন্দি রাজকুমার যেনো নিজের মতো করে রাজ্য সাজাচ্ছেন। শিফা মনের অজান্তে এঁকে চলছে রাজকুমারের রাজ্যের ছবি। বাবা বলছে,
-বঙ্গবন্ধু শুধু যে এই দেশের মানুষকে ভালোবাসতেন তা নয়। তিনি ভালোবাসতেন সবুজ ঘাস। বৃষ্টিতে ভেজা গাছের সতেজ পাতা। দুটো হলদে পাখি তাঁর খুউব প্রিয় ছিলো। ১৯৫৮-৫৯ সালে তিনি যখন জেলে ছিলেন, তখন তারা এসে বসতো আমগাছে। প্রতিদিন একই সময়ে। সকাল ১০টা, ১১টায়। তারা খেলতো। ঘুরে বেড়াতো এক শাখা থেকে আরেক শাখায়। পোকা ধরে খেতো মাঝে মাঝে। ওদের দেখার জন্যে বঙ্গবন্ধুৃ লেখাপড়া বন্ধ করে বাইরে যেতে বসতেন। পাখি দুটোকে তিনি খুব ভালোবাসতেন।
শিফা মুগ্ধ হয়ে শুনছে। কতবড় মানুষ ছিলেন বঙ্গবন্ধু। কিন্তু মনটা বাচ্চাদের মতো। শহরে পাখির ডাক শোনা যায়। কিন্তু কাক ছাড়া অন্য কোনো পাখি শিফা দেখেনা। চিড়িয়াখানায় গেলে খাঁচার ভেতর বন্দি পাখিগুলোই শুধু দেখা হয়। বাবার মুখে শুনে তারও ইচ্ছে করছে হলদে পাখি দুটো দেখার। সত্যি ঘটনাগুলো গল্পের মতো কী সুন্দর!
-ইস! পাখি দুটো যদি উনার কাছে বসতো! তারপর বলো বাবা।
-ছোটোবেলা থেকেই পশুপাখির প্রতি ছিলো গভীর মমতা। ছেলেবেলায় তিনি শালিক আর ময়না পুষতেন। ধানমন্ডির বাসায় একটি কুকুর ছিলো টমি নামের। কবুতরের ঝাঁক ছিলো সে বাসায়। তিনি বানরও পুষতেন। বৃষ্টি পছন্দ করতেন। বৃষ্টিতে সবুজ হয়ে ওঠা গাছ দেখে মুগ্ধ হতেন তিনি। বর্ষাকালে কাদা পানিতে খেলতেন বন্ধুদের সঙ্গে। সারা গায়ে কাদা মেখে ঘরে ফিরতেন।
কারাগারের যে ওয়ার্ডে তাঁকে আটক করে রাখা হতো, তার বাইরে ছিলো ছোটো ছোটো মাঠ। সেই মাঠে তিনি বাগান করতেন। মাঠে ঘাস লাগাতেন। লাউ ঝিঙার বীজ লাগাতেন। লতাগুলো যতোই বড়ো হয়ে উঠতো, তাঁর চোখ খুশিতে ভরে যেতো। ফুলের বাগান করতেন। নিজ হাতে যতœ করতেন বাগানের গাছের।
১৯৬৬ সালে আবার যখন বন্দি হলেন। তিনি খুঁজলেন সেই হলদে পাখি দুটোকে। ওগুলো আর আসেনা। ওদেরকে না দেখে দুঃখ পেলেন। তাঁর মনে হলো অভিমান করে ওরা অন্য কোথাও চলে গেছে। দেখলেন মাঠের দূর্বাঘাস বৃষ্টি পেয়ে কেমন সতেজ হয়ে উঠেছে। ঘরের সামনে লাগানো কামিনী, শেফালী ফুলের গন্ধে মৌ মৌ করতো বাতাস। একবার, খাবারের টাকা জমিয়ে কিনলেন দুটো মুরগি। সন্ধ্যা হলে ওদের খাঁচায় রেখে বলতেন, আরামে থাক। চোর ডাকাতের ভয় নাই। খাওয়ার জন্যে কেনা একটা মুরগি ডিম পেড়েছিলো বলে ওটাকে আর জবাই করতে দেননি। মুরগি তিনটি ঘুরে বেড়াতো ওয়ার্ডের ছোটো মাঠে। মোরগটা বাগান দিয়ে বেশ বুক ফুলিয়ে বেড়াতো। তার এই চলা বঙ্গবন্ধুর বেশ ভালো লাগতো। ওটাই মারা গিয়েছিলো অসুস্থ হয়ে। বাবুর্চি জবাই করে দিতে চেয়েছিলো। তিনি নিষেধ করলেন।
আরো মজার কী ছিলো জানো?
-কী বাবা?
-দাঁড়কাক আর ছোটো কাকে যুদ্ধ হতো। বঙ্গবন্ধু দেখতেন সেই যুদ্ধ। ছোটোরা ছিলো একজোট। তাই দাঁড়কাক হেরে যেতো। পাঁজি কাকগুলো বঙ্গবন্ধুর শখের বাগান নষ্ট করতো। তবুও তাদের এই একতা তিনি খুব পছন্দ করতেন।
মা ডাকছে। খাবারের টেবিল থেকে। বাবা বললো,
-বঙ্গবন্ধুর কথা বলতে গেলে রাত-দিন শেষ হয়ে যাবে। এখন খেতে চলো। কাল আবার নতুন কিছু কথা বলবো।
-ছবিটা আমার আঁকা হয়ে গেছে বাবা! তারার আলোর মতো ঝিকমিক করছে তার চোখের তারা। মুখের হাসি। বাবা হেসে বললো আমি জানি।