পাক-ভারত যুদ্ধ হলে বাংলাদেশে কি প্রভাব পড়বে

1

মো. দিদারুল আলম

কাশ্মীরের পেহেলগামে ২২ এপ্রিল বন্দুকধারীদের হামলায় ২৬ পর্যটক নিহতের ঘটনায় ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে ব্যাপক উত্তেজনা বিরাজ করছে। এই ইস্যুতে দেশ দুটি পরস্পরকে দোষারোপের পাশাপাশি পাল্টাপাল্টি বেশকিছু শক্ত পদক্ষেপও নিয়েছে। কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণরেখাজুড়ে টানা তৃতীয় রাতের মতো ভারত ও পাকিস্তানের সেনাদের মধ্যে গোলাগুলির ঘটনাও ঘটেছে। উভয় দেশের শীর্ষ নেতাদের মনোভাবে এখনো সমাধান বা উত্তেজনা অবসানের কোনো ইঙ্গিত তো পাওয়া যাচ্ছেই না, বরং একে অপরকে হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন। দুই প্রতিবেশী দেশের ক্রমবর্ধমান বৈরিতা যুদ্ধের শঙ্কা তৈরি করছে। এ নিয়ে বাংলাদেশেও বাড়ছে অস্থিরতা, প্রশ্ন জাগে, যুদ্ধ যদি লাগে, আমরা কোথায় দাঁড়াবো? আমাদের দেশে কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে।
যুদ্ধ শুরু হলে শুধু বাংলাদেশ না, পুরো দক্ষিণ এশিয়াতেই একটি প্রভাব পড়বে। সাপ্লাই চেন, আন্তর্জাতিক ফ্লাইট, শিপিং সবকিছুতেই প্রভাব পড়বে। তবে ছোট হামলা হলে আমার মনে হয় না, বাংলাদেশে তেমন কোনো ইমপ্যাক্ট পড়বে। ব্যবসা-বাণিজ্যতে প্রভাব পড়বে। বিমান চলাচল নিষেধাজ্ঞা, সিন্ধু-সিমলা চুক্তি বাতিল, এই বিষয়গুলোর একটি সাইড ইফেক্ট পড়বে বাংলাদেশে।
কাশ্মীর নিয়ে ভারত-পাকিস্তানের যে দ্বন্দ্ব, এর সমাধান দুই দেশের জনগণই করতে পারে। ভারত ও পাকিস্তানের নাগরিকরা যতদিন বড় আকারে এর সমাধান না চাইবে, ততদিন সমাধানের পথ ক্ষীণ। ভারতের বিজেপির যে রাজনীতি, সেখানে নাগরিকদের একটা বড় অংশের সমর্থন আছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। নাগরিকদের প্রত্যাশা নিশ্চয় গুরুত্বপূর্ণ। এর একটা চূড়ান্ত সমাধান দ্রুতই হওয়া দরকার। এতে যত বিলম্ব ঘটবে ততই এ ধরনের অঘটন ঘটার আশঙ্কা থাকবে। সে জন্য নাগরিকদের ভালোভাবেই বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে। কাশ্মীর মূল ভারত থেকে কিছুটা দূরে বলে দেশটির যে ব্যবসা-বাণিজ্য, পর্যটন আছে, সেখানে বড় আকারে প্রভাব ফেলে না এসব ঘটনা। যে কারণে মানুষও হয়তো জোরালোভাবে এর সমাধান অনুভব করছে না।
ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার দ্ব›েদ্বর সমাধান হওয়া উচিৎ। কারণ দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে এমন অচলাবস্থা তো চলতে পারে না। এই ট্র্যাজেডি হয়তো নতুন কোনো মোড় নিতে পারে। তবে কাশ্মীরে আপাতত যে সমস্যা হয়েছে, সেখানকার পর্যটনে বড় প্রভাব পড়তে পারে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণে হামলাস্থল পেহেলগামসহ কাশ্মীরের বিভিন্ন পর্যটন স্পট অনেকের কাছে আকর্ষণীয়। এমনকি বাংলাদেশের পর্যটকরাও সেখানে পর্যটন শুরু করেছে। এই অঘটনে কাশ্মীরের সেই পর্যটনে তাৎক্ষণিক প্রভাব পড়বে। সেখানে স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরে আসার পরও পর্যটনে ভারতের এক ধরনের বিধিনিষেধ নিশ্চয় দেখা যাবে। সুতরাং তাৎক্ষণিক প্রভাবটা পর্যটনেই পড়বে বলে মনে করা হচ্ছে।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের প্রতি দিল্লির যে দৃষ্টিভঙ্গি, সেখানে ক‚টনৈতিক কোনো সহনশীলতা যেমন নেই, তেমনি কোনো দূরদৃষ্টিও নেই। ফলে এটা বাংলাদেশকে অনিশ্চিত পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে দিবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। ভারত-পাকিস্তানের এই উত্তেজনায় পুরো অঞ্চলে সামরিকায়নের প্রতিযোগিতা শুরু হতে পারে। তারা যেহেতু পাল্টাপাল্টি প্রতিদ্বকি›দ্বতা করে সামরিক ব্যয় বাড়াচ্ছে, বাংলাদেশের ওপরও সামরিক ব্যয় বাড়ানোর একটা চাপ তৈরি হতে পারে। এখন দরিদ্র দেশগুলোতে সামরিক ব্যয় বাড়া মানেই হলো গরিব মানুষের হিস্যা থেকে কিছু বরাদ্দ ওই দিকে চলে যাওয়া। এটা একটা বিপদের দিক।
কাশ্মীরে এমন বড় হামলা এবং এর জেরে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে পাল্টাপাল্টি দোষারোপ ও পদক্ষেপের প্রভাব প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশেও পড়তে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের উচিত হবে এর মধ্যে না জড়ানো। ইতোমধ্যে ভারতের কাশ্মীরে পর্যটকদের ওপর সন্ত্রাসী হামলার নিন্দা জানিয়েছেন বাংলাদেশের অন্তর্র্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। হামলায় ২৬ জনের প্রাণহানির ঘটনায় তিনি গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে তিনি বাংলাদেশের দৃঢ় অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেছেন। এই নিন্দা জানানো পর্যন্ত আপাতত ঠিক আছে। তবে ভারত-পাকিস্তান সমস্যার সমাধানে প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশ যে ভূমিকা রাখতে পারত, তা সে রাখতে পারছে না। কারণ দেশে যারাই ক্ষমতায় যায়, হয় তারা কিছুটা ভারতমুখী হয়ে পড়ে অথবা পাকিস্তানের দিকে হেলে পড়ে। তারা যদি শুধু বাংলাদেশপন্থিই হতো, তবে হয়তো দুই দেশের মধ্যে আস্থা তৈরি করতে পারত। যেহেতু বাংলাদেশের রাজনীতিকরা ক্ষমতায় থাকার জন্য একদিকে ঝুঁকে পড়েন; তারা সেই নিরপেক্ষতা কিংবা ভারসাম্য বজায় রাখতে পারেন না। এ কারণে আমাদের সেই পেশাদারিত্ব তৈরি হয় না।
তবে এ সংকটে বাংলাদেশের উচিত হবে সরকারের পেশাদারিত্ব বাড়ানো। সরকারের বাইরে অন্যেরা হয়তো কথা বলতে পারে। সরকারকে এর মধ্যে না জড়ানোই ভালো। এ অঞ্চলে বড় ধরনের যুদ্ধ যেন না হয়, সেটাই আমরা দেখতে চাইব। চলমান ট্যারিফ যুদ্ধের কথা উল্লেখ করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ক এই গবেষক বলেন, বিশ্বে চলমান ট্যারিফ-যুদ্ধে এখন প্রয়োজন ছিল দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর নিজেদেও ভেতর বাণিজ্য বাড়ানো। কিন্তু ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনায় তো এইটাও হবে না। ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার নেতিবাচক প্রভাব গোটা দক্ষিণ এশিয়াতেই পড়তে পারে। এই প্রেক্ষাপটে বৈশ্বিক রাজনীতি ও অর্থনীতি নিয়ে বাংলাদেশকেও সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের আশা, এই দু’দেশ বড় ধরনের যুদ্ধে জড়াবে না। যৌক্তিক কারণ ছাড়া যুদ্ধ বিশ্বে গ্রহণযোগ্য হবে না। এ পরিস্থিতিতে দুই দেশকে সংযত আচরণ করতে বলেছে জাতিসংঘ। এরই মধ্যে উদ্বেগ জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশ কয়েকটি দেশ। ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা নিয়ে উদ্বিগ্ন ঢাকাও। ভারত, বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিবেশী হলেও কাউকে সমর্থন দেবে না অন্তর্র্বর্তী সরকার। দুই দেশের দ্ব›দ্বকে রাজনৈতিক কূটচালের ফসল বলছেন বিশ্লেষকেরা। তবে বড় যুদ্ধের আশঙ্কা করছেন না তাঁরা।
পাক-ভারত যুদ্ধ হলে বাংলাদেশের প্রতি ভারতের মনোযোগ কিছুটা কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ ছাড়া দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ হলে বিচ্ছিন্নতাবাদী কিংবা জঙ্গি দলগুলোর তৎপরতা বেড়ে যেতে পারে। কাশ্মীর, আসাম, অন্ধপ্রদেশসহ বেশকিছু এলাকায় ভারতের অনেকগুলো বিচ্ছিন্নতাপন্থি সংগঠন আছে। পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে ভারত স্বাভাবিকভাবেই এই সংগঠনগুলোর ওপর দৃষ্টি দিতে পারবে না। তখন চাপে পড়বে বাংলাদেশ। কারণ বিচ্ছিন্নতাবাদী বা জঙ্গি সংগঠনগুলোর একটি বহিরাগমন পথের দরকার হয়। ভারত সীমান্তবর্তী বাংলাদেশকে এই পথ হিসেবে বেছে নিতে পারে সংগঠনগুলো। তাছাড়া পাকিস্তান এই সংগঠনগুলোকে নিয়মিতভাবে অস্ত্র-অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করে বলে অভিযোগ আছে। পাক-ভারত যুদ্ধ শুরু হলে, দিলিস্নকে চাপে ফেলতে ইসলামাবাদ এই জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোকে অর্থ সাহায্য বাড়িয়ে দেবে। এতে করে বাংলাদেশেও জঙ্গি তৎপরতা বেড়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন বিশ্লেষকরা।
যুদ্ধ কেউ চায় না। কখনো কখনো তা অনিবার্য হয়ে পড়ে। যুদ্ধে কেউ জিতে না। মানবতা হেরে যায়। পাকিস্তান-ভারত দু’দেশই পারমানবিক বোমার অধিকারী। তাই হয়তো ঠিক এ কারণে বড় ধরনের যুদ্ধের আশংকা নেই বললেই চলে। সকলের চাওয়াই এটা।

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষক