পাক-ভারত যুদ্ধ থামাতে বিশ্ব সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসতে হবে

1

কাশ্মীরে ভয়াবহ হামলায় ২৬ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হওয়ার পর ভারত ও পাকিস্তানের সৃষ্ট উত্তেজনা তাহলে কী যুদ্ধে রূপ নিতে যাচ্ছে? গতকাল মঙ্গলবার ভোর রাতে ভারতীয় বিমান বাহিনী কর্তৃক পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের শ্রীনগর এলাকায় নজিরবিহীন হামলার পর যুদ্ধের আশঙ্কা জোরদার হয়েছে। এ হামলায় হতাহতের সংখ্যা এখনও জানা না গেলেও জয়েশ ই মুহাম্মদীর প্রধান নেতার পরিবারের ১০ জন সদস্যের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। হামলার পর পাকিস্তান ভারতের এ অভিযানকে কাপুরুষোচিত হামলা হিসেবে আখ্যায়িত করে পাল্টা প্রতিশোধের কথা জানিয়েছেন। অপরদিকে ভারত পুরো দেশে রেড এলার্ট জারি করে প্রতিটি রাজ্য সরকারকে যুদ্ধ প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ দেন।
আমরা জানি গত মাসের শেষের দিকে কাশ্মীরের পেহেলগামে ভারতীয় একটি পর্যটক দলের উপর হামলা হয়। এসময় নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে বেশির ভাগই ছিলেন পর্যটক। নয়াদিল্লি সরাসরি অভিযোগ করেছেÑ পাকিস্তানের মদদেই এ হামলা হয়েছে। ইসলামাবাদ পাল্টা জানিয়েছে, তারা ভারতের প্রতিশোধমূলক হামলার আশঙ্কা করছে। এতেই দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনার পারদ চড়েছে। অথচ এই দুই প্রতিবেশীর মধ্যে যুদ্ধ শুরু হলে তার প্রভাব শুধু উপমহাদেশেই নয়, পড়বে বিশ্বজুড়ে। বিশেষ করে, বাণিজ্যিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বিশ্ব। প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশে যুদ্ধের প্রভাব পড়বে আরো বেশি। সূত্র জানায়, ভারতের ওষুধশিল্প এখন বৈশ্বিক বাজারে এক গুরুত্বপূর্ণ জোগানদাতা। তারা সস্তা জেনেরিক ওষুধের সবচেয়ে বড় রপ্তানিকারক। আবার ভারত অবস্থিত পাকিস্তানের উজানে। সিন্ধু নদের পানি নিয়ন্ত্রণ করে ভারত। পাকিস্তানের কৃষি ও বিদ্যুৎ উৎপাদনের বড় অংশ নির্ভর করে সিন্ধুর পানির ওপর। পেহেলগামে হামলার পর ভারত ৬৫ বছরের পুরোনো ‘সিন্ধু পানি চুক্তি’ সাময়িকভাবে স্থগিত করেছে। এর ফলে দুই দেশের মধ্যকার পরিস্থিতি আরও উদ্বেগজনক অবস্থায় পৌঁছেছে।
ভারতের সেনাবাহিনী যুদ্ধের জন্য কতটা সক্ষম সবকিছু ছাপিয়ে শঙ্কা হলোÑ এই দুই দেশের হাতেই আছে পারমাণবিক অস্ত্র। যদি দ্বন্দ্ব চরমে ওঠে তাহলে এই প্রথমবার ইতিহাসে পরমাণু যুদ্ধ ঘটে যেতে পারে। এই প্রেক্ষাপটে, ভবিষ্যদ্বাণী ও কৌশলগত বিশ্লেষণ নিয়ে কাজ করা ‘দ্য সুইফট সেন্টার’ নামে একটি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান বিশ্বের বিভিন্ন অভিজ্ঞ পূর্বাভাসদাতাকে দিয়ে মূল্যায়ন করিয়েছে যে এই উত্তেজনা আসলে কোথায় গিয়ে ঠেকতে পারে। তাঁরা পাঁচটি প্রশ্নে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। সেই বিবেচনায় দেখা যায়, যুদ্ধের দামামা যতই বাজানোর আওয়াজ হোক না কেন, বাস্তবে বড় ধরনের যুদ্ধের শঙ্কা নেই। দুই দেশের এই উত্তেজনার সম্ভাব্য গতিপথ ছোটখাট কিছু হামলার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে। কারণ ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বাঁধলে ফল গড়াবে বহুদূরে, যা নিয়ন্ত্রণ করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়বে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দুই সপ্তাহের মধ্যে বড় ধরনের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের শঙ্কা তুলনামূলকভাবে কম। যদিও সীমান্তে ছোটখাট হামলা পাল্টা হামলা হতেই পারে। তবুও ইতিহাস বলছেÑ দুই দেশের মধ্যে সরাসরি সেনা সংঘর্ষের ঘটনা খুবই বিরল। ১৯৯৯ সালের কারগিল যুদ্ধই ছিল সর্বশেষ বড় সংঘর্ষ, যেখানে হতাহতের সংখ্যা তিন অঙ্ক ছুঁয়েছিল। তবে এবারের হামলার পর পরিস্থিতি আগের চেয়ে গুরুতর বলেই অনেকে মনে করছেন। ভারতের সরকার প্রতিশোধের ঘোষণা দিয়েছে। পাকিস্তান সেনা মোতায়েন শুরু করেছে কাশ্মীরে। একই সঙ্গে দুই দেশের জাতীয়তাবাদী উত্তেজনা, পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সংকট এবং আন্তর্জাতিক মহলের নিরবতা মিলিয়ে একটি বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র এখনো পর্যন্ত কোনো সক্রিয় কূটনৈতিক ভূমিকা নিচ্ছে না। পাকিস্তান তার সামরিক কৌশলে ছোট আকারের ‘কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্র’ ব্যবহারের কথা বলে রেখেছে। তবে তা ঘটবে যদি তারা কোনো প্রচলিত যুদ্ধে হেরে যেতে থাকে।
একজন বিশ্লেষক বলেন, দুই দেশের যুদ্ধে হতাহতের সংখ্যা শতের উপরে ছাড়ালে দুই দেশের রাজনৈতিক আবহ অনেক উত্তপ্ত হয়ে উঠবে। তখন শান্তির পথ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তবে কেউ কেউ আশা করছেন যে দুই দেশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করবে। এ ছাড়া ভারত এবার প্রথমবারের মত সিন্ধু নদীর পানি বন্টনের যে চুক্তি তা স্থগিত করে পাকিস্তানকে বড় ধরনের চাপে রেখেছে বলে মত দেন বিশেষজ্ঞরা। অথচ এই চুক্তি ১৯৬০ সাল থেকে কার্যকর ছিল। এমনকি ১৯৬৫ ও ১৯৭১ সালের যুদ্ধেও তাতে প্রভাব পড়েনি। এবারই প্রথম তা স্থগিত করা হলো। বিশেষজ্ঞরা একমত যে যুদ্ধ হলেও পরমাণু অস্ত্র ব্যবহারের আশঙ্কা খুব কম। তবে সামান্য আশঙ্কাও চরম বিপজ্জনক।
বিশ্লেষকরা বলেন, পাকিস্তান তার সামরিক কৌশলে ছোট আকারের ‘কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্র’ ব্যবহারের কথা বলে রেখেছে। তবে তা ঘটবে যদি তারা কোনো প্রচলিত যুদ্ধে হেরে যেতে থাকে। আবার এই অস্ত্র ব্যবহারের সিদ্ধান্ত যদি মাঠপর্যায়ের কোনো এক পাগল মেজরের হাতে থাকে, তাহলে ভুল বোঝাবুঝির মাধ্যমে মারাত্মক কিছু ঘটেও যেতে পারে। তবুও অনেকেই আশ্বস্ত করেন, ‘কারগিল যুদ্ধেও বহু হতাহতের পরও পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার হয়নি। সুতরাং এই ধরনের যুদ্ধ ঠেকানো সম্ভব।’ তবে তাঁরা সতর্ক করেনÑ কাশ্মীরে যুদ্ধ যদি সীমান্তের মানচিত্র পাল্টানোর দিকে যায়, তখন পাকিস্তান হয়তো পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার করে ফেলতে পারে। ভারত-পাকিস্তান ব্যাপক উত্তেজনার মধ্যেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিরবতা নানা প্রশ্নের উদ্রেক করেছে। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার সাম্প্রতিক উত্তেজনা নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক। বকা যায়, আগুনও লেগে গেছে। এরমধ্যে বিশ্ব নেতারা আরেকটি যুদ্ধের ভয়াবহ পরিণতি উপলব্ধি করে এখনই সমাধানের উদ্যোগ না নিলে বিশ্ব এর নেতিবাচক পরিনতি থেকে রেহাই পাবে না। দুই দেশের সাধারণ মানুষের আশা সবকিছু নিয়ে টানাপোড়েন থাকলেও যেন বোমা না ফাটে। আর সেটা যদি হয় পরমাণু বোমাÑ তাহলে সেই আগুন শুধু উপমহাদেশে নয়, ছড়িয়ে পড়বে বিশ্বজুড়ে। যুদ্ধই একমাত্র সংকট নিরসনের সমাধান নয়। যুদ্ধের ওপিঠে রয়েছে চরম মানবতার বিধ্বংস। সুতরাং আলোচনায় হোক সংকট নিরসনের প্রধান উপায়- এমনটি প্রত্যাশা বিশববাসীর।