পহেলা বৈশাখ : অসাম্প্রদায়িকতার প্রতীক

1

মুহাম্মদ মুসা খান

বাংলা নববর্ষের প্রথমদিন পহেলা বৈশাখ। পহেলা বৈশাখকে ঘিরে দেশবাসির মনে অন্যরকম এক অনুভূতির জন্ম নেয়। শহর-গ্রাম সর্বত্রই যেনো উৎসবের আমেজ। বাংলা বর্ষ গণনা শুরু হওয়ার পর হতে জাতিগত সংস্কৃতি ও ধর্মীয় সংস্কৃতির মধ্যে সঙ্গে সংঘাতবিহীন অপূর্ব এক মিলনমেলার জন্ম হয়েছে। এ দিনটি বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা, ঝাড়খন্ড, ওডিশা, আন্দামান-নিকোবর, ধানবাদ, মানভূম, সাঁওতাল পরগনাসহ বিভিন্ন রাজ্যের প্রায় ২৮ কোটি বাংগালীর প্রানের উৎসব এই ‘পহেলা বৈশাখ’। শুধু তাই নয়, এশিয়া-আফ্রিকা- ইউরোপ-আমেরিকা-কানাডাসহ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বাঙালিরাও প্রবল উৎসাহ সহকারে এই নববর্ষ উদযাপন করে। (উল্লেখ্য যে, পৃথিবীজুড়ে মোট বাংলাভাষীদের সংখ্যা প্রায় ২৭ কোটি। পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার প্রায় তিন শতাংশ মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে)।
সে হিসেবে এটি বাঙালিদের একটি সর্বজনীন প্রাণের উৎসব। পহেলা বৈশাখকে অনেকে লোকজের সঙ্গে নাগরিক জীবনের একটি সেতুবন্ধও বলে থাকেন। ধর্ম, বর্ণ সব পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে বাঙালি জাতি এই নববর্ষকে সাদরে আমন্ত্রণ জানায়। বছরের প্রথম দিনটি বাঙালিরই শুধু নয়, বাংলা ভাষাভাষী আদিবাসী ও নৃতাত্তি¡ক জনগোষ্ঠী, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রত্যেকটি মানুষের জীবন-জগতে স্বপ্নময় নতুন বছরের শুভ সূচনা ঘটায়। জীর্ণ-পুরোনোকে পেছনে ফেলে সম্ভাবনার নতুন বছরে প্রবেশ করে বাঙালি জাতি। পহেলা বৈশাখে বর্ণিল উৎসবে মেতে থাকে পুরো জাতি। বর্তমানে নগরজীবনে নগর-সংস্কৃতির আদলে নববর্ষ উৎযাপিত হয়। পহেলা বৈশাখের প্রভাতে উদীয়মান সূর্যকে স্বাগত জানানোর মধ্য দিয়ে শুরু হয় নববর্ষের উৎসব।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’-গানের মাধ্যমে নতুন বর্ষকে বরণ করা হয়। এদিন সাধারণত: সব শ্রেণীর এবং সব বয়সের নারীপুরুষ ঐতিহ্যবাহী বাঙালি পোশাক পরিধান করে। বর্ষবরণের চমকপ্রদ ও জমজমাট আয়োজন ঘটে রাজধানীর রমনার বটমূলে। এখানে ছায়ানটের উদ্যোগে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান হয় [১৩৭২ বঙ্গাব্দে (১৯৬৫) ছায়ানট প্রথম এ উৎসব শুরু করে]। চট্টগ্রামের ডিসি হিল ও সিআরবিতেও বর্ষবরণের বর্ণাঢ্য আয়োজন হয়। লোকে লোকারণ্য থাকে এসব এলাকা। তাছাড়া দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের নববর্ষকে ঘিরে আয়োজন হয় গ্রামীণ মেলার। নববর্ষ উপলক্ষ্যে পার্বত্য অঞ্চলে আদিবাসীদের (চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চজ্ঞা প্রভৃতি) বৈসাবি উৎসব শতশত বছর ধরে চলে আসছে।
বাঙালির এই প্রাণের উৎসবের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত আছে আবহমান বাংলার কৃষি। গ্রামীণ মেলাগুলো পরিণত হয় উৎসবে। এই উৎসবের রং একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গড়তে বাঙালি জাতিকে এগিয়ে নিয়েছে বারবার। দেশ স্বাধীনের পর বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রতীকে পরিণত হয় বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠান। উৎসবের পাশাপাশি স্বৈরাচার অপশক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদও এসেছে পহেলা বৈশাখের আয়োজনে। নব্বইয়ে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ‘অমঙ্গলকে দূর করে মঙ্গলের আহ্বান’ জানিয়েই ১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে বের হয়েছিল প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রা। (প্রথমে এই শোভাযাত্রার নাম ছিল ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’)। ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর ইউনেসকো এ শোভাযাত্রাকে বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মর্যাদা দেয়। এ মর্যাদা দেওয়ায় আমরা গৌরববোধ করি। নব্বইয়ের মতো এবারও ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানে ‘গণতান্ত্রিক স্বৈরাচারের’ পতনের ঘটনা ঘটেছে। এবার মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রতিপাদ্য ঠিক করা হয়েছেÑ ‘নববর্ষের ঐকতান, ফ্যাসিবাদের অবসান’। তবে আমাদের প্রত্যাশা হলো-পহেলা বৈশাখ ও মংগল শোভাযাত্রা যেনো রাজনৈতির ঊর্ধ্বে থাকে।
প্রসংগত উল্লেখ্য যে, এই উপমহাদেশে ধর্মীয় ভাবাবেগ একটু বেশি। সুফিবাদের শক্তিশালী অবস্থানও রয়েছে এখানে। এখানে ইসলাম, হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের চর্চাই বেশি ( যদিও সামান্য কিছু অন্যান্য ধর্মের লোকজন আছে)। বিগত দেড় হাজার বছর যাবৎ ভারতবর্ষ হিন্দু ও মুসলিম শাসকরা পালাক্রমে শাসন করেছে। এদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সবসময় বিরাজমান ছিল। মানুষের মধ্যে সহমর্মিতা-সহনশীলতা ছিল, শ্রদ্ধাবোধ ছিল। তিন ধর্মের মানুষই শান্তিপূর্ন সহাবস্থান করতো। তাঁরা একত্রে বসবাস করেছে, একত্রে বাজারে গিয়েছে, একজনের সুখে-দুঃখে অন্যজন এগিয়ে গেছে। কিন্তু পরিস্থিতি দিনদিন জটিল আকার ধারণ করছে। উন্নত বিশ্ব তথা ইউরোপ-আমেরিকা যেখানে প্রযুক্তি নির্ভর নিত্যনতুন আবিষ্কারে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে, সেখানে এই উপমহাদেশের কিছু মানুষ ধর্মচর্চাকে ‘বাড়াবাড়ির’ পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে। মানুষে-মানুষে বিভেদ তৈরি করছে। একশ্রেণির বক্তা ‘সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টির আশংকা’ সত্বেও উস্কানিমূলক ধর্মীয় বক্তব্য দিয়ে থাকেন, যা অনাকাঙখিত। অন্যদিকে ভারতের ‘নরেন্দ্র মোদি সরকার’ তো রীতিমতো সাম্প্রদায়িকতার উপর শতভাগ ভর করেই কার্যক্রম পরিচালনা করছে। স্বয়ং সরকারই যখন সাম্প্রদায়িক উস্কানিতে সামিল হয়, তখন মানবতা নীরবে কাঁদে। ‘ধর্মান্ধতার উন্মাদনার’ এই সময়ে আমরা ‘বাংলা নববর্ষকে’ এ অঞ্চলের ‘অসাম্প্রদায়িকতার প্রতীক’ বলে গণ্য করতে পারি। আমরা মনে করি, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির ব্যাপক চর্চার মাধ্যমে এই উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার ষড়যন্ত্র প্রতিহত করা যাবে। এ অঞ্চল হবে সম্প্রীতির তীর্থভূমি। একটু পেছনে গেলে আমরা দেখবো যে, ভারতবর্ষের রাজা-বাদশারা হিজরী সনানুসারে (চন্দ্র মাস) কৃষি পণ্যের খাজনা আদায় করতো। যা মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর মুঘল সম্রাটরাও অব্যাহত রাখেন। হিজরি সন চাঁদের উপর নির্ভরশীল হওয়ায় তা এই অঞ্চলের ‘ঋতু ভিত্তিক’ কৃষি ফলনের সাথে মিলতো না। অথচ অসময়ে (ঘরে ফসল না উঠলেও) কৃষকদেরকে খাজনা পরিশোধ করতে বাধ্য করা হতো। খাজনা আদায়ে সুষ্ঠুতা প্রণয়নের লক্ষ্যে মুঘল সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। সেসময় জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফতেহউল্লাহ সিরাজি ‘সৌর সন’ এবং ‘আরবি হিজরী সনের’ উপর ভিত্তি করে ‘বাংলা অঞ্চলের ঋতু অনুযায়ী’ নতুন ‘বাংলা সনের’ নিয়ম প্রবর্তন করেন। ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দের ১০ মার্চ বা ১১ মার্চ থেকে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। তবে এই গণনা পদ্ধতি কার্যকর করা হয় আরও আগে আকবরের সিংহাসন আরোহণের সময় (৫ নভেম্বর, ১৫৫৬) থেকে। প্রথমে এই সনের নাম ছিল ‘ফসলি সন’। পরে ‘বঙ্গাব্দ’ বা বাংলা বর্ষ নামে পরিচিত হয়। তখনও বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন করা হতো। কালক্রমে এই উৎসবটি একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয়, যার রূপ পরিবর্তন হয়ে বর্তমানে জাঁকজমকপূর্ণ পর্যায়ে এসেছে। তখনকার সময় এই দিনের প্রধান ঘটনা ছিল একটি ‘হালখাতা’ তৈরি করা। এই হালখাতা হলো বাংলা সনের প্রথম দিনে (দোকানপাটের হালখাতার দিনে) দোকানদাররা তাদের ক্রেতাদের মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়ন করে থাকে। যা শতশত বছর ধরে ব্যবসায়ীদের অন্যতম আনন্দের দিন।
‘নববর্ষ’ শুধু বাঙালি বা বাংলা ভাষাভাষীরা উদযাপন করেন, তা নয়। পৃথিবীর সব দেশের সব জাতিই মূলত তাঁদের ‘নিজস্ব জাতীয় নববর্ষ’ পালন করে। খ্রিস্টানরা নববর্ষ উদযাপন করে পহেলা জানুয়ারি। বলা বাহুল্য যে, ইংরেজি নববর্ষ প্রায় সমগ্র পৃথিবীতে উদযাপিত হয়। কারণ সমগ্র পৃথিবীব্যাপী ইংরেজি ভাষার দাপট রয়েছে। যার ঢেউ হতে আমরাও মুক্ত নই। মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম সম্প্রদায় চন্দ্র মাস অনুযায়ী মহরমের প্রথম দিন অর্থাৎ আশুরার দিনে নববর্ষ উদযাপন করে থাকে। ইরানীদের নববর্ষ হচ্ছেন ‘নওরোজ’, ভিয়েতনামীদের নববর্ষ হচ্ছে ‘তেতা’। নববর্ষ উদযাপনে এগিয়ে আছে ‘চীন’ দেশ। তাঁরা নববর্ষের জন্য সপ্তাহ ব্যাপী সরকারি ছুটি ঘোষনা করে। সমগ্র পৃথিবীতে যে নামেই নববর্ষ উদযাপন করা হোক না কেন, নববর্ষের মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে- আগামী দিনে পরস্পরের শুভকামনা ও আনন্দ উৎসব। পারস্পরিক সৌহার্দ্য বৃদ্ধি করা। বিগত দিনের ব্যর্থতা, জীর্ণ-শীর্ণতা, সব অন্যায়-অবিচার যেন ধুয়ে মুছে যায়, আর আগামী দিনে যেন সফলতা আসে, সার্থকতা আসে, জীবন যেন সুন্দর হয়, দেশ যেন সুন্দর চলে, হানাহানি- মারামারি- রাহাজানি-দুঃখবোধ যেন দেশ থেকে দূর হয়। মূলত নববর্ষে এসব শুভ কামনাই করা হয়। যাতে খারাপ কিছু দেখা যায় না।
প্রসঙ্গক্রমে বলা যেতে পারে যে, ধর্ম এবং জাতীয়তা এক নয়। দুটো সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। এদেশের মানুষের ধর্মীয় জাতীয়তা- মুসলিম বা হিন্দু হলেও, নৃতাত্তি¡ক জাতীয়তার দিক হতে আমরা বাঙালি। আমাদের ভাষা বাংলা। বলা যায়- আমরা ‘বাঙালি মুসলমান’ বা ‘বাঙালি হিন্দু’, ‘বাঙালি বৌদ্ধ’। বাংলা নববর্ষকে ভিন্নধর্মীয় উৎসব বলে আখ্যায়িত করা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও একান্তই মনগড়া। বরং বাঙালি জাতীয়তাবাদকে ‘মানবতাবাদ’ বলে আখ্যায়িত করা যায়। আজ এই সত্যই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, বাঙালি জাতীয়তাবাদ এই অঞ্চলের মানুষকে অসাম্প্রদায়িকতা শিখিয়েছে, মানবতাবাদী হতে শিখিয়েছে। বাঙালির প্রাণের উৎসব বাংলা নববর্ষের সূচনায় পহেলা বৈশাখে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই উচ্চারণ-
‘নিশি অবসান প্রায়, ওই পুরাতন বর্ষ হয় গত,
আমি আজি ধূলিতলে জীর্ণ জীবন করিলাম নত।
বন্ধু হও, শত্রু হও, যেখানে যে রও,
ক্ষমা কর আজিকার মত,
পুরাতন বরষের সাথে,পুরাতন অপরাধ যত।’
-এই কথাগুলো যেনো অবচেতনে প্রতিটি বাঙালির মনে উচ্চারিত হয়।
এমন পরিস্থিতিতে কায়মনে প্রার্থনা করবো-
‘তাপস নিঃশ্বাস বায়ে
মুমুর্ষূরে দাও উড়ায়ে
বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক।
মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা/
অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা।’
‘বাংলা নববর্ষকে’ আমরা এ অঞ্চলের ‘অসাম্প্রদায়িকতার প্রতীক’ বলে গণ্য আমরা করতে পারি। আমরা মনে করি, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির ব্যাপক চর্চার মাধ্যমে এই উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার ষড়যন্ত্র প্রতিহত করা যাবে। এ অঞ্চল হবে সম্প্রদায়িক সম্প্রীতির তীর্থভূমি।
লেখক: কলামিস্ট ও সমাজকর্মী