ড. মোঃ রফিকুল ইসলাম
সারা বিশ্বে পর্যটন শিল্প একটি অন্যতম প্রধান অর্থনৈতিক কর্মকাÐ হিসেবে সুপরিচিত। যা বাংলাদেশে একের পর এক অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে সংকট মোকাবেলা করছে পর্যটন শিল্প। গত জুলাই থেকে ছাত্র আন্দোলন, সরকার পরিবর্তন, বন্যা-পাহাড়ের অস্থিরতা ও সরকারি নিষেধাজ্ঞার কারণে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের পর্যটন খাতের কঠিন সময় পাড় করছে। যা এ পর্যটন নগরী কক্সবাজার ও তিন পার্বত্য জেলায় মিলছে না আশানুরূপ পর্যটক। এর ফলে এ শিল্পে জড়িতরা চরম সংকটে মধ্যে পড়ছে।
স্বাধীনতার পর ৫৫ বছর পেরিয়ে গেলেও দেশের পর্যটন শিল্প মোটেও এগোয়নি। বরং দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশ এখনও পিছিয়ে রয়েছে। অর্থাৎ ১৯৫০ সালে পৃথিবীতে পর্যটকের সংখ্যা ছিল মাত্র ২৫ মিলিয়ন। যা ২০১৬ সালে বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ১২৩৫ মিলিয়নে। আর বিগত ৬৭ বছরে পর্যটকের সংখ্যা প্রায় ৫০ গুণ বৃদ্ধি পায়। তাই এ পর্যটন শিল্প বর্তমান বিশ্বের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের প্রধান হাতিয়ার হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। তদ্রæপ, থাইল্যান্ড, মালদ্বীপ, ভারত ও নেপালের মতো বেশ কিছু দেশের পর্যটন শিল্পের উন্নয়নের ফলে অর্থনীতি কিন্তু শক্তিশালী হচ্ছে। অন্যদিকে পর্যটনকে আরও বেশি আকর্ষণীয় করার জন্য পিছিয়ে নেই দুবাই, কাতার, সৌদি আবর ও মিসরসহ মধ্যপ্রাচ্যেরও বিভিন্ন দেশগুলো। বিশেষ করে শুধুমাত্র ভারত, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর ও ভিয়েতনাম থেকে প্রায় ৮৬ শতাংশ পর্যটন শিল্পের আয় হয়েছে। যা পর্যটন শিল্পের সুবাদে দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও অব-কাঠামোর ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হচ্ছে। তবে পর্যটন কাঠামোগত দিক থেকে সারা বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৯তম। বিশেষত বিদেশি পর্যটক আগমনের তথ্যের ভিত্তিতে বিশ্বের কোনো দেশ পর্যটন শিল্পে কোনো অবস্থানে রয়েছে। তার একটি র্যাংকিং করছে মুন্ডি ইনডেক্স। তাদের এ তথ্যের ভিত্তিতে পর্যটন শিল্পে বিশ্বের ১৮৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪১তম। যা এশিয়ার ৪৬টি দেশের মধ্যে ৪২তম। অন্যদিকে মুন্ডি র্যাংকিং দক্ষিণ এশিয়ার আটটি দেশের মধ্যে ৬টি দেশ স্থান পায়। এর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। তবে বিশ্বের পর্যটন শিল্পের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান একেবারেই তলানিতে বলা যায়। তথাপি, অনেক উন্নত-উন্নয়নশীল দেশের আয়ের প্রধান উৎস কিন্তু পর্যটন শিল্প। তাই ইউরোপের দেশ চেক রিপাবলিক, যার রাজধানী প্রাহা ও ইনষ্টাগ্রামে প্রাহা ওয়াল্ড পেজের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে দেশটিতে নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করছে। আর সে সাথে আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নের জন্য পর্যটন শিল্পের ব্যাপক গুরুত্ব আরোপ করছে। উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তন হওয়ার পরও দেশের পর্যটন শিল্পের তেমন কোনো উন্নতি হয়নি। বরং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কারণে পর্যটন শিল্পের উপর বিরুপ প্রভাব পড়ছে। বিশেষ করে দেশের আইন-শৃঙ্খলার উন্নতির জন্য পার্বত্য জেলাগুলোতে কারফিউ জারি করেন স্থানীয় প্রশাসন। অর্থাৎ তিন পার্বত্য জেলায় অস্থিরতার কারণে গত ৮ অক্টোবর থেকে ৬ নভেম্বর পর্যন্ত পর্যটকদের উপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল প্রশাসন। তবে খাগড়াছড়ি জেলার পর্যটন কেন্দ্রগুলো ৫ নভেম্বর থেকে সবার জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে। সে সাথে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অপার মেলবন্ধন রাঙামাটি জেলার পর্যটন কেন্দ্র এখন সবার জন্য উন্মুক্ত। এমনকি এখনও কোনো কোনো স্থানে নিষেধাজ্ঞা বিদ্যমান রয়েছে বলে বিভিন্ন গণমাধ্যম থেকে জানা যায়। তাছাড়া রাজনৈতিক অস্থিরতা ও নানা কারণে দেশে কয়েক মাস যাবৎ পর্যটন খাতে বিরুপ প্রভাব পড়ছে। অর্থাৎ স্থানীয় আধিপত্তকে কেন্দ্র করে স্থানীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক পরিস্থিতি থমথমে ও আতস্ক বিরাজ করছে পর্যটন এলাকায়। এসব কারণে চরম লোকসানের মুখে পড়ছে পর্যটন শিল্প। তবে চুরি, ছিনতাই, হত্যা, রাহাজানি ও সহিসংতা আর রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাসী কার্যকলাপে মানুষ নির্বিঘেœ চলাচল করতে পারছে না কক্সবাজার আশপাশ এলাকায়। এ অস্থিতিশীল পরিবেশের কারণেও পর্যটকরা পরিবার-পরিজন নিয়ে দুরবর্তী স্থানে যেতে নিরাপদ বোধ করছে না। বিশেষত পর্যটন শিল্পের বর্তমান অবস্থার কারণে তাদের কাজ ও দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তাই পর্যটন খাতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সার্বিক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীল পরিবেশ। অর্থাৎ যে কোনো মূল্যে পর্যটকদের জন্য নিরাপদ ও সাশ্রয়ী এবং সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টির আপ্রাণ চেষ্টা করছে কর্তৃপক্ষ। এজন্য পর্যটকদের সুবিধার্থে সব ধরনের আবাসিক হোটেল ৩৫ শতাংশ, রিসোর্ট ২৫ শতাংশ, চান্দের গাড়ি ও সিএনজি ট্যাক্সি ২০ শতাংশ ও রেস্টুরেন্টগুলোতে ১০ ভাগ ছাড় দিচ্ছে মালিকপক্ষ। এ ছাড় দেওয়া সত্তে¡ও আশানুরূপ পর্যটক আসছে না। এর মূল কারণ এখনও অস্থিতিশীল পরিস্থিতির বিরাজ করছে। তাই বিশাল লোকসানের মুখে পড়তে হচ্ছে হোটেল ও মটেলের মালিকপক্ষ। প্রকৃতপক্ষে অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের পর্যটনের ব্যয় অনেকটাই বেশি। সে অনুপাতে পর্যটকদের সুযোগ-সুবিধা নেই বললেই চলে। বরং ভোগান্তিতে পড়তে হয় পর্যটকদের। কেননা এর চেয়ে কম ব্যয়ে ভালো সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশগুলো। যা আমাদের দেশে সম্ভব নয় কেন ? এ বিষয়ে সুশীল সমাজ জানতে চায়।
উল্লেখ্য যে, পৃথিবীর দীর্ঘতম অবিচ্ছিন্ন ও প্রাকৃতিক সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার। বাংলাদেশে পর্যটন শিল্পের অপার সম্ভাবনা বিরাজমান। কিন্তু বিশাল সম্ভাবনা থাকা সত্তে¡ও সঠিক কর্ম-পরিকল্পনার অভাবে পর্যটন শিল্প অনেক পিছিয়ে রয়েছে। এ শিল্পের উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন সুষ্ঠু ও সমম্বিত পরিকল্পনা। আর পর্যটন শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত সকল পক্ষকে নিয়ে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। এছাড়া দেশীয় পর্যটন বিকাশের পাশাপাশি বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণের জন্য প্রচার-প্রচারণার উপর বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। এর পাশাপাশি এ শিল্পের উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে পেশাদার দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। আর সঠিক কর্ম-পরিকল্পনার মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা গেলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে পর্যটন শিল্পের অন্যতম নিয়ামক হিসেবে ভূমিকা রাখবে। তাই এ শিল্পের যদি উন্নয়ন করা যায়। সেক্ষেত্রে একদিকে যেমন দেশের বেকারত্ব সমস্যা কিছুটা হলেও দূর হবে। অন্যদিকে এর থেকে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রাও আয় করা সম্ভব। তাছাড়া ঢাকা থেকে কক্সবাজার নতুন রেলপথ সংযোজন হয়েছে। যা কক্সবাজারবাসীদের জন্য রেল যোাগাযোগ মাইলফলক বলা যায়। এক্ষেত্রে কম খরচে দ্রুত সময়ের মধ্যে পর্যটন গন্তব্যে পর্যটকরা পৌঁছাতে পারবে। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে যে, যেন রেলওয়ের শিডিউল বিপর্যয় না ঘটে আর যাত্রীরা বিড়ম্বনা শিকার না হয়। এজন্য রেলওয়ের কর্তৃপক্ষকে রেলপথের যাত্রীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে।
বিশেষ করে অপূর্ব সৌন্দর্যের আধার বাংলাদেশ যার প্রাকৃতিক রূপবৈচিত্র্যের কোনো অভাব নেই। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন। পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার ও পার্বত্য চট্টগ্রামের অকৃত্রিম সৌন্দর্যসহ আরও অনেক প্রাকৃতি সৌন্দর্যের লীলাভূমি আমাদের বাংলাদেশ। তাই এ কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত পৃথিবীর একমাত্র দীর্ঘতম অবিচ্ছিন্ন সমুদ্র সৈকত। যা আর পৃথিবীর অন্য কোথাও নেই। তবে ১২০ কিলোমিটার দীর্ঘ সৈকতটিতে কাদার কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। সম্প্রতি কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সাগরের পাড়ে ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ মেরিন ড্রাইভ নির্মাণের ফলে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে পর্যটন নগরী কক্সবাজারের আকর্ষণ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং বাংলাদেশ ভ্রমণে এসে উচ্ছাসিত হয়ে বলেন, এ ¯িœপিং বিউটি এমার্জিং ফ্রম মিস্টস অ্যান্ড ওয়াটার। অর্থাৎ এ উচ্ছ¡াসিত প্রশংসাকে সর্বদা ধরে রাখার মাধ্যমে পর্যটন শিল্পের বিকাশে দায়িত্ব আমাদেরই। তাই সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগও বিকাশ ঘটাতে হবে পর্যটন শিল্পের। এদিকে হোটেল ও মটেল মালিকপক্ষ বলছে ধীরে ধীরে পরিস্থিতি উন্নতির দিকে যাচ্ছে। আর শীতের আগমন ও শিক্ষার্থীদের বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হলে পর্যটক বাড়তে পারে। আর দেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, চুরি, ছিনতাই, হত্যা, রাহাজানি ও সহিসংতা বন্ধসহ রোহিঙ্গাদের চলাচল সীমিত করতে হবে। অর্থাৎ দেশি বা বিদেশি পর্যটকদের নিরাপত্তা ও নির্বিঘেœ চলাফেরা করার নিশ্চয়তা নিশ্চিত করতে হবে। এমনকি বিদেশি পর্যটকদের সুরক্ষা ব্যবস্থা করতে হবে। এজন্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে সবসময় তৎপর থাকতে হবে। এদিকে বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণীয় করার জন্য বেশি বেশি প্রচার-প্রচারণা চালানোসহ সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা জরুরি। নতুবা বিদেশি পর্যটকেরা তো দূরের কথা বরং আমাদের দেশের পর্যটকরা বিদেশে ভ্রমণের প্রবণতা বৃদ্ধি পাবে। তাই পর্যটন শিল্প উন্নয়নে অভ্যন্তরীণ পর্যটন অব-কাঠামো সৃষ্টি ও দেশে-বিদেশের পর্যটনের ইতিবাচক ভাবমূর্তি ফিরে আনার জন্য সংস্কার জরুরি। এর সাথে পর্যটন উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ এবং সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে পর্যটন শিল্পের সম্প্রসারণ করা বিশেষ প্রয়োজন। তথাপি, একটি দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির যাত্রায় অন্যন্য অবদান রাখতে পারে পর্যটন শিল্প। তাই পর্যটকের সংখ্যা বৃদ্ধির মানে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাÐের পরিধিও বৃদ্ধি পাবে। সর্বোপরি, পর্যটন খাতকে আরও উন্নত করতে হলে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়কেই উদ্যোগ নিতে হবে।
লেখক : গ্রন্থাগার বিভাগের প্রধান
সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, চট্টগ্রাম