রূপম চক্রবর্ত্তী
মানুষ এখন প্রকৃতির বিভিন্ন কিছু সম্পর্কে জানতে চান। এই জানার কৌতুহল পৃথিবীর এক প্রান্তের মানুষ আরেক প্রান্তে ছুটে চলেছেন। ভিন্ন ভিন্ন দেশের প্রাচীন যুগের ইতিহাস ও শিল্প, সাহিত্য, কালচার ও প্রথার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ঐতিহাসিক স্থান দেখার জন্যও পর্যটকরা নিজ দেশের সীমানা পেরিয়ে দূর-দূরান্তে ছুটে চলে প্রতিনিয়ত।
নৈসর্গিক দৃশ্য দেখতে দেখতে মানুষ কিছু সময়ের জন্য বছরের অন্যান্য দিনের যে পরিশ্রম করেছে সে পরিশ্রমের ফলে সৃষ্ট ক্লান্তির ইতি টানতে চান। পৃথিবীর অনেক দেশের মানুষ বাংলাদেশের প্রকৃতির সাথে মিতালি করার জন্য ছুটে আসেন। কেননা প্রকৃতির বিচিত্র সম্ভারে সেজে আছে আমাদের প্রিয় বাংলাদেশকে। একদিকে পাহাড় অন্যদিকে কক্সবাজারের বিশাল সমুদ্র সৈকতের সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। কুয়াকাটার মনোরম সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের অপরূপ দৃশ্য অবলোকন করতে করতে সুন্দরবনের সবুজ বনের স্নিগ্ধ বাতাসে নিজের শরীরকে জুড়িয়ে নেওয়ার সুযোগ এই বাংলাদেশই আছে। সিলেটের জাফলং, বিছানাকান্দি আর সুনামগঞ্জের হাওরের জলরাশির সাথে মিতালী করা আমাদের দেশে সম্ভব। নদীমাতৃক বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রবাহিত হয়েছে ছোট বড় অনেক নদ নদী। এই সব নদী দেশের প্রাকৃতিক দৃশ্যকে সমৃদ্ধ করেছে। আবার সাথে সাথে দেশের মানুষকে সংগ্রামী হতে সাহায্য করেছে। দেশের এই প্রাকৃতিক সম্পদগুলো ব্যবহার করে বাংলাদেশকে আরো সমৃদ্ধ করতে হবে। প্রতি বছর অনেক পর্যটক দেশে আসেন তবে তা অন্যান্য পর্যটন শিল্প সমৃদ্ধ দেশের তুলনায় অনেক কম।
পৃথিবীর প্রায় সব দেশে পর্যটন এখন অন্যতম প্রধান অগ্রাধিকার খাত। ১৯৫০ সালে পৃথিবীতে পর্যটকের সংখ্যা ছিল মাত্র ২৫ মিলিয়ন; যা ২০১৬ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১২৩৫ মিলিয়নে। ধারণা করা হচ্ছে, এ বছর প্রায় ১৩৯ কোটি ৫৬ লাখ ৬০ হাজার পর্যটক সারা পৃথিবী ভ্রমণ করবেন। অর্থাৎ বিগত ৬৭ বছরে পর্যটকের সংখ্যা প্রায় ৫০ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। পর্যটকের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এ অর্থনৈতিক কর্মকাÐের পরিধি ব্যাপকতা লাভ করেছে। পর্যটনের মধ্যে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন সাধিত হয়ে থাকে। ২০১৭ সালে বিশ্বের জিডিপিতে ট্যুরিজমের অবদান ছিল ১০.৪ শতাংশ, যা ২০২৭ সালে ১১.৭ শতাংশে গিয়ে পৌঁছাবে। এছাড়া ২০১৭ সালে পর্যটকদের ভ্রমণখাতে ব্যয় হয়েছে ১৮৯৪.২ বিলিয়ন ডলার। আর একই বছর পর্যটনে বিনিয়োগ হয়েছে ৮৮২.৪ বিলিয়ন ডলার। পর্যটনের অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি খÐচিত্র আমরা এর থেকে পেতে পারি। বাংলাদেশের জিডিপিতে পর্যটন শিল্পের অবদান প্রায় ৪ শতাংশ এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে প্রায় ১.৭৮ শতাংশ। এ হার ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে।
মানুষ এখন অনেক বেশি ভ্রমণ প্রিয়। ইন্টারনেট আর তথ্যপ্রযুক্তি কারণে অজানাকে জানার জন্য অনেকের আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। এই আগ্রহ যাতে বাংলাদেশমুখী করা যায় তার জন্য পদক্ষেপ নেওয়ার সময় হয়েছে। বাংলাদেশ এমন একটি দেশ যে দেশ, ঐতিহ্যগত, সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক এবং আত্মিক সকল সম্পদ দিয়েই সমৃদ্ধ। এ কারণে সুদূর প্রাচীনকাল থেকেই বাংলাদেশে পর্যটকদের আগমন ঘটছে। ইতিহাস খ্যাত পর্যটক ফা হিয়েন, হিউয়েন সাং, ইবনে বতুতার পর্যটক হয়ে আসার কাহিনী সবার জানা। বাংলাদেশে পর্যটন কেন্দ্রগুলো বৈচিত্র্যময় হওয়ার কারণে পর্যটকদের মধ্যেও বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়। কিছু পর্যটন কেন্দ্রের নাম তুলে ধরার চেষ্টা করছি। ১. সুন্দরবন পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন। ২. কক্সবাজার পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত। ৩. সিলেটের জাফলং, বিছানাকান্দি,লালাখাল ৪. সেন্টমার্টিন দ্বীপ বাংলাদেশের একমাত্র সামুদ্রিক প্রবাল দ্বীপ। ৫. কুয়াকাটা সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত দেখার জন্য বিখ্যাত স্থান। ৬. মহাস্থানগড় প্রাচীন এবং প্রত্মতাত্বিক নিদর্শনের জন্য বিখ্যাত। ৭. সোনরগাঁও লোকশিল্পের জন্য বিখ্যাত। ৮. পাহাড়পুর/সোমপুর বিহার বৌদ্ধ সভ্যতার নিদর্শনের জন্য বিখ্যাত। ৯. মাধবকুন্ড বাংলাদেশের একমাত্র প্রাকৃতিক জলপ্রপাত। ১০. শিলাইদহ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কুঠিবাড়ি রয়েছে। ১১. বাগের হাটের ষাটগম্ভুজ মসজিদ ১২. দিনাজপুরের কান্তজী মন্দির ১৩. সীতাকোট বিহার প্রাচীন বৌদ্ধ বিহার। ১৪. কুমিল্লা ময়নামতি প্রতœতাত্মিক স্থান। ১৫. বান্দরবান, রাংগামাটি,খাগড়াছড়ির নয়নাভিরাম পাহাড়িভূমি, ১৬. কাপ্তাই লেকের স্বচ্ছ জলরাশি
বিভিন্ন সময় কক্সবাজার যাওয়ার সুবাধে এই পর্যটন শহরের বেশ কিছু সমস্যা আমার চোখে পড়েছে। প্রথম যে সমস্যাটা দেখা যায় সেটি হচ্ছে সড়ক যোগাযোগের বেহাল অবস্থা। চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার যাওয়ার রাস্থাটির পরিধি বাড়ানো জরুরি প্রয়োজন। মহেশখালি আদিনাথ মন্দির, হিমছড়ি, ইনানী সৈকত, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি বান্দরবানসহ আরও অসংখ্য পর্যটন কেন্দ্রে যেতে হলে চট্টগ্রামসহ সারাদেশের মানুষকে তথা সারাবিশ্বের সমস্ত পর্যটকদের আরাকান সড়কটি ব্যবহার করা অত্যাবশক। এই সড়কটি চার লাইনে উন্নীত করা প্রয়োজন। পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতের শহর কক্সবাজার। দেশের এবং বাইরের অসংখ্য পর্যটক প্রতিনিয়ত এই শহরে আসছেন। ডলফিন মোড় থেকে কলাতলী সড়কটি ভালভাবে সজ্জিত করলে পর্যটকদের চোখে আকর্ষণীয় দেখাবে। এই সড়কের পাশে বিভিন্ন ধরণের ফুলের গাছ লাগানো যেতে পারে। এই সড়কে রাত্রিকালীন বাতির পরিমাণ বাড়াতে হবে।
প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অনেকে কক্সবাজার শিক্ষা সফর বা বনভোজনে আসেন। অনেক সময় দেখা যায় আগত কিছু দেশীয় পর্যটকদের মাইক আর সাউন্ড সিস্টেমের আওয়াজে রাতের বেলা ঘুমানো সমস্যা হয়ে পড়ে। রাত ১০ টা থেকে শব্দ নিয়ন্ত্রণে কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া খুব জরুরী। কক্সবাজার প্রশাসন অনেক সচেতন। তারপরও আমি অনুরোধ জানাব রাত ৮ টা থেকে সমস্থ প্রকার মাইক, সাউন্ড সিস্টেম সীমিত আকারে চলে। বায়ু দূষণ, শব্দ দূষণ থেকে কক্সবাজারকে মুক্ত রাখার দায়িত্ব শুধু সরকারের একার নয়। আমাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব আছে। এই শহরকে যত বেশি পরিষ্কার রাখতে পারব তত বেশি আমাদের সুনাম বৃদ্ধি পাবে। বাইরের পর্যটক যত বেশি আমাদের দেশে আসবে তত বেশি আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হবে।
বীচে ডাস্টবিনের পরিমাণ বাড়ানো দরকার বলে আমি মনে করি। কেউ যাতে বীচ ময়লা আবর্জনা ফেলতে না পারে তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সিসি ক্যামেরা দ্বারা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চালু করতে হবে। শহরের বিভিন্ন জায়গায় যেভাবে সুন্দর হোটেল তৈরী হচ্ছে সেভাবে সুন্দর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাস্থাও তৈরি করতে হবে। শান্ত আর স্নিগ্ধ পরিবেশে সকল পর্যটক কক্সবাজার এসে অনাবিল আনন্দ উপভোগ করার মাধ্যমে আমাদের দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা আরও ভালো হবে বলে আমি মনে করছি। শীত মৌসুমে পর্যটক বেড়ে যায়। এই সময় এক শ্রেণীর দালাল চক্রের যোগসাজশের কারণে পর্যটকদের হোটেল কক্ষের অতিরিক্ত ভাড়া প্রদান করতে হয় বলে জানা গেছে। কক্সবাজার প্রশাসন, হোটেল-মোটেল গেস্ট হাউজ মালিক সমিতির কাছে অনুরোধ জানাব এই ব্যাপারে সচেতন থাকার জন্য।
পর্যটনের অপার সম্ভাবনার আরেকটি নাম পার্বত্য চট্টগ্রাম। পার্বত্য চট্টগ্রাম মূলত তিনটি জেলা নিয়ে গঠিত। তিনটি জেলা, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম গঠিত। পাহাড়ে ঘেরা সবুজ প্রকৃতি ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন রূপে পর্যটকদের কাছে ধরা দেয়। এখানে শীতে যেমন এক রূপ ধরা দেয় ভ্রমণপিপাসুদের কাছে, ঠিক তেমনি বর্ষা কালে অন্য এক রূপে হাজির হয়। আবার বর্ষায় চারদিক জেগে ওঠে সবুজের সমারোহ। এ সময় প্রকৃতি ফিরে পায় আরেক নতুন যৌবন। বর্ষায় পর্যটকদের পদচারণা সবচেয়ে বেশি থাকে এ পার্বত্য অঞ্চলে। অন্যদিকে সুন্দরবন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনভূমি। সুন্দরবন ১৯৯৭ সালে ইউনেস্কোর ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যের স্থান হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। সুন্দরবনের প্রাকৃতিক সম্পদের সঙ্গে সঙ্গে এ বনের জীববৈচিত্র্য এটিকে পৃথিবীর অন্য যে কোনো পর্যটন কেন্দ্র থেকে স্বতন্ত্ররূপে উপস্থাপন করেছে। সুন্দরবনকে জালের মতো জড়িয়ে রেখেছে সামুদ্রিক স্রোতধারা, খাল, ও ছোট ছোট নদ নদী।সুন্দরবনের নামের সঙ্গে যে বিষয়টি নিবিড়ভাবে জড়িত, তা হল বিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার। বনভূমিটি রয়েল বেঙ্গল টাইগার ছাড়াও নানা ধরনের পাখি, চিত্রা হরিণ, কুমির, ডলফিন ও সাপসহ অসংখ্য প্রজাতির প্রাণীর আবাসস্থল হিসেবে পরিচিত।
বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে গেলে কিছু বিষয়ের উপর গুরুত্ব দিতে হবে। যে কোনো দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা পর্যটন শিল্পের জন্য বড় হুমকি। বাংলাদেশে রাজনৈতিক অঙ্গন যাতে উত্তপ্ত না হয় তার দিকে সবাইকে খেয়াল রাখতে হবে। প্রত্যেক পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে যাওয়ার মতো আরামদায়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার খুব প্রয়োজন। আভ্যন্তরীণ সড়কগুলো সব সময় ভালো রাখতে হবে। যাতায়াত অসুবিধা হলে পর্যটন কেন্দ্রগুলো আকর্ষণীয় হলেও পর্যটকরা যাওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। সৌন্দর্য পিপাসু মানুষ এসব আকর্ষণীয় স্থান সম্পর্কে যাতে জানতে পারে তার জন্য খুব প্রচারণা চালাতে হবে। বিদেশি পর্যটকদেরকে পর্যটন কেন্দ্র সম্পর্কিত ইতিহাস ঐতিহ্যের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য যে দক্ষ দোভাষী গাইডের সংখ্যা বাড়াতে হবে।
বাংলাদেশে যত বেশি বিদেশি পর্যটক আসবে বাংলাদেশের সরকার তত বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করবে। বাংলাদেশে যারা বেসরকারি উদ্যোক্তা আছেন তারা পর্যটন শিল্পের দিকে আরও বেশি মনোযোগ দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি । প্রায় সব দেশেই পর্যটন শিল্প সমৃদ্ধ হয়েছে সে দেশের বেসরকারি উদ্যোক্তাদের উদ্যোগে। বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা পর্যাপ্ত বিনিয়োগ করার মাধ্যমে এই শিল্পকে সমৃদ্ধ করতে পারবে পর্যটকদের আকৃষ্ট করার জন্য পর্যটন কেন্দ্রের সাথে সম্পৃক্ত সকল কর্মকর্তা এবং কর্মচারীদের উন্নত প্রশিক্ষণের আওতায় আনতে হবে।
বিভিন্ন সময় বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পে নিরাপত্তার অভাব পরিলক্ষিত হয়। খবরের কাগজে প্রায় দেখা যায় বিদেশীরা বিভিন্নভাবে প্রতারিত বা ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে পূর্ণ নিরাপত্তার যাতে অভাব না হয় তার দিকে খেয়াল রাখতে হবে। কেননা বাংলাদেশে পর্যটন শিল্পের অপার সম্ভাবনা বিরাজমান। কিন্তু এ বিশাল সম্ভাবনা থাকা সত্তে¡ও সঠিক পরিকল্পনার অভাবে আমরা পর্যটন শিল্পে পিছিয়ে আছি। এ শিল্পের উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন সমন্বিত পরিকল্পনা। পর্যটন শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত সবপক্ষকে একসঙ্গে কাজ করে যেতে হবে যাতে এই শিল্পের মাধ্যমে আমার সারা পৃথিবীতে পরিচিত হতে পারি। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক খাতকে শক্তিশালী করার জন্য পর্যটন শিল্পের উপর গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। এ শিল্পের বিকাশের পথের বাধাগুলোকে দূর করে একে শক্তিশালী ভিত্তির উপর দাঁড় করাতে হবে।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট