ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী
এটি সর্বজনবিদিত যে, আধুনিক জ্ঞান সভ্যতার কিংবদন্তী অবেক্ষক দর্শনশাস্ত্রের জনক মহাজ্ঞানী সক্রেটিসের মতানুসারে মূল্যবান পোশাক-পরিচ্ছদ বাইরের আবরণ মাত্র। মানুষের সত্যিকার সৌন্দর্য হচ্ছে হৃদয়ের গভীরে প্রোথিত পরিশুদ্ধ জ্ঞান। তিনি বলেছিলেন, ‘জ্ঞানই সর্বোত্তম গুণ’, ‘জ্ঞানই শক্তি’। শিক্ষা ও জ্ঞানের নিগূঢ় বিভাজন গর্বিত উপলব্ধিতে আনা না হলে প্রত্যয় দু’টির ব্যাখ্যা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। প্রকৃত অর্থে জ্ঞান হলো শিক্ষার পরিশীলিত-পরিমার্জিত অনুধাবন। যে শিক্ষা অন্যের কষ্টে বা অন্য-হৃদয়ের রক্তক্ষরণ নিজের বিবেককে তাড়িত ও বোধকে বেদনাকাতর করে না, সে শিক্ষা কখনো জ্ঞানে রূপান্তরিত হয় না। জ্ঞানের আরেক মহানসাধক এরিষ্টটল সম্পর্কে মহাবীর আলেকজান্ডার বলেছিলেন, ‘আমার জীবনের জন্য হয়ত আমি আমার জন্মদাতা পিতার কাছে ঋণী। কিন্তু আমাকে পৃথিবীতে বেঁচে থাকার জন্য সত্যিকার মানুষ করে গড়ে তুলেছেন আমার শিক্ষাগুরু এরিষ্টটল’। বিশ্বখ্যাত বরেণ্য জ্ঞানসাধকসহ প্রায় সকল মনীষীর জীবনপ্রবাহের পথ পরিক্রমায় শিক্ষাই ছিল অতীন্দ্রিয় পাথেয়। ‘শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড’ এই প্রচলিত প্রবাদবাক্য শুধু বাচনিক প্রকরণে নয়, প্রয়োগিক বিবেচনায় সর্বকালেই সভ্যতার গুরুত্বপূর্ণ বাহন হিসেবে বিবেচ্য।
উন্নত বিশ্বে উন্নয়নের পিছনে প্রণিধানযোগ্য বিনিয়োগ হচ্ছে শিক্ষা। শিক্ষার আধুনিক ও যুগোপযোগী পাঠ্যক্রম, জ্ঞানসৃজনে সমৃদ্ধ গবেষণা, মেধাসম্পন্ন যোগ্যতর শিক্ষা প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনার যথার্থ নৈর্ব্যত্তিক মূল্যায়ন ব্যতীত গুণগত শিক্ষার বাস্তবায়ন সমধিক কল্পনাপ্রসূত। শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতিটি স্তর; প্রাথমিক-মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক-স্নাতক-স্নাতকোত্তরসহ অধিকতর উচ্চশিক্ষায় প্রতিভা-দীপ্ত ব্যক্তিদের প্রজ্ঞা ও জ্ঞানের অনুশীলননির্ভর উৎকর্ষ ফলাফলই নির্ধারণ করতে পারে গুণগত শিক্ষার মানদন্ড। আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক তথ্য-প্রযুক্তি-মনন-সৃজনশীল জ্ঞানের উন্মেষই ‘মানবপুঁজি’ বা সমৃদ্ধ মানবসম্পদ উৎপাদনে সুষ্ঠু ভূমিকা পালন করতে পারে। মেধাবী শিক্ষার্থী ও রাষ্ট্রের জন্য মানবসম্পদ-সমৃদ্ধ উন্নততর পরিবেশ তৈরিতে উৎকৃষ্ট জ্ঞানসৃজন ও বিতরণে ব্যত্যয় ঘটলে জাতিকে ভবিষ্যতে কঠিন মূল্য দিতে হবে। কদর্য অন্ধকারের পথ নির্ণয় ও প্রদর্শনে অপকৌশল, ছলচাতুরী, প্রতারণা, জালিয়াতি, অনৈতিক অর্থ-বিনিময়ে প্ররোচিত ঘৃণ্য ব্যক্তিদের শুধু স্বীয় বিবেকের আদালতে নয়, দেশবাসীর প্রচন্ড ক্ষোভ-নিন্দা-ঘৃণা-আক্রোশের কাঠগড়ায় দাঁড়ানোর সময় খুব দ্রুত এগিয়ে আসছে বলে অনুমান করা যায়।
আমাদের সকলের জানা, চলতি বছরের মার্চ মাসে দেশের সকল রাষ্ট্রায়ত্ত-স্বায়ত্তশাসিত বা সমজাতীয় সংস্থার নতুন কর্মকর্তা-কর্মচারীর জন্য সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচির আওতায় নতুন স্কিম ‘প্রত্যয়’ চালুর প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। সরকারের ঘোষণার পর থেকেই এর বিরোধীতা করে আন্দোলন করছেন বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ফেডারেশন। প্রত্যয় পেনশন স্কিম বর্তমান সুযোগ-সুবিধা কাটার মাধ্যমে শিক্ষকসমাজের মর্যাদা হনন, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা ও মনস্তাত্তি¡ক সংকট তৈরির অভিযোগে এটি প্রত্যাহারের আহবানও জানানো হয়েছিল। সরকারের পক্ষ থেকে আশানুরূপ কোনো বক্তব্য না আসায় শিক্ষকগণ ১ জুলাই থেকে সর্বাত্নক আন্দোলনে নেমেছেন। শ্রেণি কার্যক্রম ও পরীক্ষাসহ প্রায় সকল কার্যক্রম বন্ধ ঘোষিত হলে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীরা চরম বিপাকে পড়ে। সম্প্রতি শিক্ষার্থীদের সরকারি চাকরিতে কোটার যৌক্তিক সংস্কার আন্দোলনকে পুঁজি করে দেশ-স্বাধীনতাবিরোধী সন্ত্রাসী-জঙ্গী অপশক্তি ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপে লিপ্ত হয়। আন্দোলনে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে সরকারি-বেসরকারি অবকাঠামো ও যানবাহন ভাংচুরসহ দেশব্যাপী অগ্নিসন্ত্রাসের মাধ্যমে এক নৈরাজ্যকর-অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। সারা দেশে সড়ক-মহাসড়কে প্রতিবন্ধকতা তৈরির ফলে জনজীবন নানামুখী দুর্ভোগে নিপতিত হয়।
কোটা সংস্কার আন্দোলনে নজিরবিহীন সহিংসতার কারণে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা বিবেচনায় পর্যায়ক্রমে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। চলমান এইচএসসি পরীক্ষার তারিখ কয়েক দফা পিছানো হয়েছে। সংঘাত বাড়তে থাকলে জারি করা হয় কারফিউ। আন্দোলনের ফলে দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় একধরনের স্থবিরতা নেমে এসেছে। এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব উচ্চশিক্ষাসহ সকলক্ষেত্রে গভীর ক্ষত তৈরি করবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। শিক্ষার্থীদের পড়ালেখাসহ সামগ্রিকভাবে যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। এমনিতে বছরের শুরু থেকে বেশকিছুটা সময়জুড়ে শৈত্য প্রবাহ-তীব্র দাবদাহ-অতিবৃষ্টি ও বন্যায় শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছিল। উল্লেখ্য চ্যালেঞ্জসমূহ মোকাবেলা করে যখন পুরোদমে পাঠদান ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল ঠিক ঐ সময়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনে শিক্ষাব্যবস্থায় পুনরায় অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। একের পর এক অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের পাঠ্যক্রমের ঘাটতি পূরণে ছাত্রছাত্রী-অভিভাবক-শিক্ষকগণের মাঝে উদ্বেগ-উৎকন্ঠা গভীর অনুভূত। পেনশন স্কিম নিয়ে শিক্ষকদের কর্মবিরত-বিক্ষোভ ও কোটা সংস্কার আন্দোলন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দীর্ঘ সেশনজটের চক্রে পড়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়াও বারবার শ্রেণি কার্যক্রম থেকে বিচ্ছিন্নতা প্রাথমিক বা মাধ্যমিক শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনাগ্রহ-অনীহা বাড়িয়ে তুলতে পারে। বার্ষিক মূল্যায়ন-পরীক্ষায় এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা অতি উচ্চকিত।
দেশজুড়ে আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে কোটা সংস্কারে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায় এবং সরকারের নির্বাহী বিভাগের প্রজ্ঞাপন জারির মধ্য দিয়ে ইতিমধ্যেই শিক্ষার্থীদের দাবি পূরণ করা হয়েছে। পুরো দেশে জারি হওয়া কারফিউ ধীরে ধীরে শিথিল করা হচ্ছে। সাধারণ ছুটি শেষে সচল হচ্ছে অফিস-আদালত। সাধারণ জনগণের মাঝে স্বস্তি ফিরে আসছে। সড়কসহ বিভিন্ন স্থানে জনসমাগম বৃদ্ধি পাচ্ছে। এরই মধ্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কোটা সংস্কার আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছে। এক ভিডিও বার্তায় বলা হয়, ‘আমাদের প্রধান দাবি কোটার যৌক্তিক সংস্কার সরকার ইতিমধ্যে পূরণ করেছে। এখন শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ রক্ষার্থে দ্রুত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি জোর আহŸান জানাই।’ যদিও কোটা আন্দোলনের সমন্বয়কারীদের মধ্যে মতবিরোধ অতি সুস্পষ্ট। প্রায় সকলেই আন্দোলন প্রত্যাহার করলেও কতিপয় আন্দোলনকারী এখনো নানাভাবে বিভ্রান্ত। তাদের অভিযোগ অনুসারে, কোনো একটা মহল চাপ প্রয়োগ করে এ কাজ করিয়েছে। তাদের আট দফা দাবি না মানলে, তারা আবারও মাঠে নামার ঘোষণা দিয়েছে।
এহেন পরিস্থিতিতে সমগ্র দেশে জীবনযাত্রা দ্রুততর সময়ে স্বাভাবিক হয়ে আসলেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ পরিলক্ষিত নয়। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ঢাকা ও আশেপাশের জেলাগুলো বাদে অন্যান্য এলাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দ্রুত খুলে দিতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। দেশের শিক্ষাব্যবস্থা সুরক্ষায় সকল পক্ষের আলোচনা-সমঝোতা সাপেক্ষে সকল স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া অতি জরুরি বলে বিজ্ঞমহলের ধারণা। সম্ভাব্য ক্ষতি পুষিয়ে নিতে তাঁরা প্রয়োজনে সময় বাড়িয়ে অতিরিক্ত ক্লাস-পরীক্ষা নেওয়ার প্রয়াস গ্রহণে সরকার ও পরিচালনা পর্ষদের প্রতি উদাত্ত আহŸান জানিয়েছেন। অনেকের মতে, শিক্ষার্থীদের আন্দোলন যে পরিণতি এনেছে তাতে শিক্ষার সবক্ষেত্রই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের সহযোগিতামূলক মানসিকতার মাধ্যমে এই পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠা সম্ভব। অনেক শিক্ষার্থীই এক ধরনের ট্রমার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সেই পরিস্থিতি থেকে ফিরিয়ে আনতে সবাইকে ইতিবাচক ভূমিকা রাখাতে হবে। সবাই আন্তরিক থাকলে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব। শিক্ষার্থীদেরও এর গুরুত্ব অনুধাবন করতে হবে।
দেশবাসী সম্যক অবগত আছেন, যেকোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় পবিত্র সংবিধান সম্মত আইনের শাসন প্রতিষ্ঠাই সরকারের অন্যতম দায়িত্ব ও কর্তব্য। আপামর জনগণের জানমালের নিরাপত্তা, রাষ্ট্র বা জনগণের সম্পদ সুরক্ষা, উন্নয়ন কর্মকান্ডের গতিপ্রবাহ সচল রাখা, বিশেষ করে সামগ্রিক অর্থব্যবস্থাকে যথাযথ চালু রেখে জনদুর্ভোগ সংহার করাই সরকারসহ দেশপ্রেমিক সকল নাগরিকের বিবেকপ্রসূত ব্রত। সম্প্রতি যেসব সহিংসতা-ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ড গোচরীভূত হচ্ছে তা কোনভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। সচেতন মহলের সুদৃঢ় ধারণা যে, আন্দোলনরত মেধাবী শিক্ষার্থীদের কেউ এতে সম্পৃক্ত ছিল না। আন্দোলনকে সুসংগঠিত করে দাবিসমূহের সার্থক প্রতিফলন কাক্সিক্ষত ছিল। দুর্ভাগ্যবশত আন্দোলনের চালিকা শক্তি তৃতীয় পক্ষের করায়ত্ত হয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যাচ্ছে। শিক্ষার্থীদের উপলব্ধিতে এটুকু ধারণ করতে হবে প্রতিটি দিনক্ষণ তাদের পঠন-পাঠনের জন্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। সময়মত সিলেবাস সম্পন্ন, পরীক্ষায় অংশগ্রহণ, ফলাফল প্রকাশ এবং উত্তীর্ণদের শিক্ষার পরবর্তী পর্যায়ে প্রবেশ করে যথাসময়ে পাঠের সমাপ্তি ও সনদ অর্জন তার জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এর ব্যত্যয় ঘটলে সে শুধু পিছিয়ে পড়বে না; জাতি সময়োপযোগী মানবসম্পদ তৈরিতে ব্যর্থ হবে। ইতিমধ্যেই এইচএসসি পরীক্ষার সম্ভাব্য তারিখ ঘোষিত হয়েছে। দেশের সাধারণ মানুষ শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে শিক্ষার্থীদের ইতিবাচক ভূমিকা ও সহযোগিতা প্রত্যাশা করছে। একইসাথে সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকেও পর্যাপ্ত পদক্ষেপ গ্রহণ বাঞ্চনীয়। কোন ধরনের অসংলগ্ন অতিকথনে অসন্তোষ বা রাগ অভিমানের প্রকাশ না ঘটিয়ে সকল রাজনৈতিক-সামাজিক শক্তির ঐক্যবদ্ধতায় সকল বিরোধ-বিচ্ছেদের প্রশমন অনিবার্য। জাতিকে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছুনোর অবারিত সুযোগ অন্তরায়-প্রতিবন্ধকতাহীন করা সময়ের জোরালো দাবি।
লেখক : শিক্ষাবিদ, সমাজ-অপরাধবিজ্ঞানী, সাবেক উপাচার্য চ.বি