মুহাম্মদ আনোয়ার শাহ আজহারী
আজ মানবজাতির জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হলো পরিবেশগত সংকট, যা মানুষের দ্বারা পরিবেশব্যবস্থার ওপর আগ্রাসনের ফলাফল।
এই কারণেই আধুনিক যুগে পরিবেশবিজ্ঞানকে বৈজ্ঞানিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক মহলে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এর প্রতিফলন দেখা যায় স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সচেতনতামূলক উদ্যোগে- যারা ধারাবাহিকভাবে জনগণকে পরিবেশ সংরক্ষণের প্রতি সচেতন করে তুলছে।
এরই অংশ হিসেবে প্রতিবছর ৫ই জুন দিনটি “বিশ্ব পরিবেশ দিবস” হিসেবে পালিত হয়। যা জাতিসংঘ ঘোষিত একটি বার্ষিক আন্তর্জাতিক দিবস, যার উদ্দেশ্য হলো বিশ্বব্যাপী পরিবেশ বিষয়ক সচেতনতা বৃদ্ধি করা এবং ব্যক্তি, সরকার ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে আমাদের পৃথিবী রক্ষায় ইতিবাচক পদক্ষেপ নিতে উৎসাহিত করা।
১৯৭২ সালে সুইডেনের স্টকহোম মানব পরিবেশ সম্মেলনে ৫ জুন দিনটিকে “বিশ্ব পরিবেশ দিবস” হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এটি ছিল পরিবেশ বিষয়ক প্রথম বৈশ্বিক সম্মেলন।
১৯৭৪ সালে প্রথমবারের মতো এই দিবসটি উদযাপন করা হয়, তখনকার মূল প্রতিপাদ্য ছিল “ঙহষু ঙহব ঊধৎঃয” অর্থাৎ “শুধু একটি পৃথিবী”।
প্রতি বছর একটি নির্দিষ্ট বিষয় (ঞযবসব) নির্বাচন করা হয়, যা পরিবেশের কোনো গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে যেমন দূষণ, মরুকরণ, জলবায়ু পরিবর্তন, বা জীববৈচিত্র্যের হ্রাস, প্লাস্টিক দূষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ।
২০২৪ সালের প্রতিপাদ্য হলো: “ভূমি পুনরুদ্ধার, মরুকরণ রোধ এবং খরার বিরুদ্ধে সহনশীলতা বৃদ্ধি।” তবে এসব প্রচেষ্টা সত্তে¡ও বাস্তবতা হলো পরিবেশের সমস্যা এখনো রয়ে গেছে, বরং আগের চেয়ে বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে যদি বলি আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশে। আর যে সমাধানগুলো প্রস্তাব করা হচ্ছে, সেগুলো অনেক সময় আগের চেয়ে আরও জটিল ও কঠিন সমস্যা সৃষ্টি করছে।
কারণ, এই সমাধানগুলো মূল সমস্যার গভীরে পৌঁছায় না; বরং উপরিভাগে সাময়িক কিছু সমাধান যা দীর্ঘ মিয়াদি নয়। যদি গবেষণা ও উদ্যোগগুলো আল্লাহপ্রদত্ত দিকনির্দেশনার আলোকে পরিচালিত হতো যেখানে পরিবেশের প্রতিটি অংশকে সত্য, ভারসাম্য ও আল্লাহর বিধানের সঙ্গে সংযুক্ত করে দেখা হয় তাহলে মানবজাতি সত্যিকার অর্থেই এই সংকট থেকে মুক্তি পেতে পারত।
নিশ্চয়ই মহাগ্রন্থ পবিত্র কুরআনুল কারীম এই বিষয়টির প্রতিও এমন মনোযোগ দিয়েছে, যেমনটি অন্যান্য ধর্মীয় বিষয়ের প্রতি দিয়েছে। কুরআন এ বিষয়ে জ্ঞান অর্জনকে অপরিহার্য বলে ঘোষণা করেছে যাতে মানুষ পৃথিবীর স্থায়িত্ব ও তাতে বসবাসকারীদের সংরক্ষণ করতে পারে। এর ফলে জীবন এই পৃথিবীতে নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণভাবে অগ্রসর হতে পারে এবং মানবজাতি তার নানান কল্যাণ থেকে উপকৃত হতে পারে।
মূল ও প্রাথমিক পরিবেশ তো আল্লাহর সৃষ্টি, আর কুরআনই একমাত্র সেই গ্রন্থ যা পরিবেশবিজ্ঞান অধ্যয়নের জন্য স্থায়ী ও মৌলিক নীতিমালা নির্ধারণ করেছে। আল্লাহ তাআলা পরিবেশের নিয়ম ও কার্যাবলি এমনভাবে সাজিয়েছেন যা মানুষের কল্যাণের জন্য উপযোগী, কারণ মানুষকে তিনি অন্য সৃষ্টির উপর শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা দান করেছেন। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায় যে, মানুষই পরিবেশগত নকশার কেন্দ্রবিন্দু। প্রকৃতি ও পরিবেশ আল্লাহর পক্ষ হতে একটি বিশেষ নেয়ামত এই নেয়ামতের অপব্যবহার কোন মানুষের জন্য কল্যাণকর নয়। আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন “তিনিই ঐ সত্তা যিনি তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন যমীনে যাকিছু আছে” (সূরা আল-বাকারা: ২৯)
আল্লাহ তায়ালা পরিবেশে যে সমস্ত নিয়ামত দান করেছেন, তা মানুষের ব্যক্তিগত ও সামাজিক কল্যাণের জন্যই। কোনো জাগতিক বিজ্ঞানই মানুষকে এমন সম্মান ও মর্যাদা দেয় না, যেমনটি কুরআন প্রদান করেছে। পরিবেশ থেকে উপকার গ্রহণের ধারণা মানুষের দায়িত্বকে আরও বাড়িয়ে দেয়। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হলো—পরিবেশের কল্যাণ ও নিরাপত্তা রক্ষা করা, এর উপাদানগুলোর সঙ্গে অন্যায় আচরণ না করা এবং এর ব্যবস্থায় ও ব্যবহারে ফিতনা-ফাসাদ সৃষ্টি থেকে বিরত থাকা। এই কারণেই কুরআন সতর্ক করে বলেন “আর তোমরা যমীনে ফাসাদ সৃষ্টি করো না, যমীনকে সংশোধন করার পর।।” (সূরা আল-আ‘রাফ: ৫৬)
এছাড়াও জীবনের প্রয়োজনীয় বিষয়গুলোতে অপচয় ও অমিতব্যয়িতা থেকেও নিষেধ করেছে, যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন- “আর আহার কর এবং পান কর, তবে অপচয় কর না। ।” (সূরা আল-আ‘রাফ: ৩১)
মানুষের যাবতীয় প্রয়োজনীয় ব্যয় পরিবেশের সম্পদ থেকেই আসে। তাই জীবনের প্রয়োজনের অতিরিক্ত অপচয় আসলে পরিবেশের সম্পদের প্রতি অন্যায় আচরণ।
অতিরিক্ত ব্যয় (অপচয়) পরিবেশের এই সম্পদসমূহকে ধ্বংস করে ফেলে।
ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে পরিবেশের ধারণা : ইসলামী দৃষ্টিতে পরিবেশের ধারণা এমন এক আচরণমূলক অবস্থানের ওপর প্রতিষ্ঠিত, যা সঠিক আকীদার ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে আছে। মহাবিশ্বের সমস্ত নিয়ম ও পরিবেশব্যবস্থা এই আকীদার উপরই প্রতিষ্ঠিত। আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন – “যদি আসমান-যমীনে বিভিন্ন ইলাহ থাকতো আল্লাহ ছাড়া তাহলে আসমান-যমীন (ও তার ব্যবস্থাপনা) তছনছ হয়ে যেতো ।” (সূরা আল-আম্বিয়া: ২২)
অতএব, সমগ্র মহাবিশ্বের, তথা পরিবেশের স্থিতিশীলতা ও শৃঙ্খলা আল্লাহর একত্ববাদের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত। আল্লাহ তাআলা আরও বলেন- “হক যদি তাদের খেয়াল- খুশির অনুগামী হত, তবে আকাশমÐলী পৃথিবী এবং এতে বসবাসকারী সবকিছুই বিপর্যস্ত হয়ে যেত।” (সূরা আল-মু’মিনূন: ৭১)
অতএব, জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান মানুষের দায়িত্ব হলো আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত সত্যের অনুসরণ করা এবং তা যথাযথভাবে বোঝা। এবং মানুষ যেন তার জীবনে যে মহাজাগতিক সত্যগুলো থেকে উপকৃত হচ্ছে, সেগুলোর সঠিক উপলব্ধি অর্জন করে। কিন্তু যদি সে একগুঁয়েভাবে তার জেদ ও অবাধ্যতায় অটল থাকে, তবুও সত্য তো সত্যই থাকে। আর যদি সত্যকে মানুষের খেয়াল-খুশি ও লালসার অনুসারী করে দেওয়া হতো, তবে তার পরিণতি হতো সমগ্র মহাবিশ্বের বিনাশ।
পরিবেশের উপাদানসমূহে আল্লাহর নির্ধারিত ভারসাম্য :
পরিবেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো আল্লাহ তাআলা এর প্রতিটি উপাদানের মাঝে একটি নিখুঁত ভারসাম্য সৃষ্টি করেছেন। জীবনধারা ও প্রাণিকুলের অস্তিত্ব এই ভারসাম্যের ওপরই নির্ভরশীল। যদি এই ভারসাম্য নষ্ট হয়, তবে তা সকল জীবের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
পরিবেশের উপাদানসমূহে আল্লাহর এই ভারসাম্যের মূল ভিত্তি হলো আল্লাহ তাআলার এই বাণীঃ
“তাঁর মালিকানা (ও নিয়ন্ত্রণে) রয়েছে যাকিছু আসমানসমস্তে এবং যাকিছু যমীনে এবং যাকিছু তাদের মাঝে এবং যা কিছু ভূগর্ভে/পাতালে রয়েছে।।” (সূরা ত্বাহা: ৬)
আর পরিবেশের এমন কোনো উপাদান নেই যা এই আয়াতের অন্তর্ভুক্ত নয়-তা হোক জীবিত বা জড় পদার্থ – সবই এর আওতায় এসেছে, সীমা ও শৃঙ্খলাসহ।
এই উপাদানগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো পানি, যার সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
“আর আমি প্রতিটি প্রাণী পানি থেকে সৃষ্টি করেছি ।” (সূরা আম্বিয়া: ৩০)
কারণ, পানিই জীবনের ভিত্তি। তাই আল্লাহ তাআলা এর বণ্টনের জন্য একটি সুষম ব্যবস্থা নির্ধারণ করেছেন। তিনি বলেন : “আর আমি আসমান থেকে সঠিক পরিমাণে পানি নামিয়েছি। অনন্তর তাকে ভূমিতে (বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায়) স্থির করেছি, আর অবশ্যই, আমি তা বিলুপ্ত করে দিতেও সক্ষম।” (সূরা আল-মু’মিনূন: ১৮)
পরিবেশে পানিসম্পদ বিভিন্নভাবে বিভক্ত যেমন: মিষ্টি পানির উৎসসমূহ (নদী, হ্রদ ইত্যাদি) এবং লবণাক্ত পানির উৎসসমূহ (মহাসাগর ও সমুদ্র)।
তেমনি উদ্ভিদসম্পদ সম্পর্কেও কুরআনে পানিসম্পদের সঙ্গে সম্পর্কিতভাবে বলা হয়েছে, যেমন আল্লাহ
তাআলা বলেন : “তিনিই ঐ মহান সত্তা যিনি আসমান থেকে পানি/বৃষ্টি বর্ষণ করেছেন, যা থেকে তোমাদের জন্য পানীয় আসে, আর তা থেকেই বৃক্ষলতা উদাত হয়, যাতে তোমরা গবাদি চরাও। ঐ পানি দ্বারা তিনি তোমাদের জন্য ফসল উৎপন্ন করেন এবং যায়তুন, খেজুর, আঙুর ও সর্বপ্রকার ফল (উৎপন্ন করেন)। সত্যি সত্যি তাতে রয়েছে বড় নিদর্শন” (সূরা আন-নাহল: ১০-১১)
উদ্ভিদের এই বণ্টনও অত্যন্ত সূক্ষ ভারসাম্যের সঙ্গে সম্পন্ন হয়েছে, যেমন আল্লাহ বলেন : “আমি তাতে (পৃথিবীতে) সবকিছুই পরিমিতভাবে উৎপন্ন করেছি।” (সূরা আল-হিজর: ১৯)
পরিবেশের উপাদানসমূহে এই আল্লাহর নির্ধারিত ভারসাম্যর অংশ হলো, তিনি প্রতিটি প্রজাতির বৃক্ষ ও উদ্ভিদকে নির্দিষ্ট অঞ্চলে স্থাপন করেছেন, যাতে তা সেখানে টিকে থাকতে পারে। সব প্রজাতি সর্বত্র জন্মে না। উদাহরণস্বরূপ, “কোরম গাছ” (ম্যাঙ্গ্রোভ প্রজাতি) এটি এক ধরনের উষ্ণমন্ডলীয় বৃক্ষ যা জলাভূমি, সমুদ্রতট ও নদীর মোহনায় জন্মায়। এগুলো প্রায়ই খনিজ লবণসমৃদ্ধ এলাকায়ও দেখা যায় এবং এগুলোর কান্ড সাধারণত ছোট ও মোটা হয়। এগুলোর শিকড় পানির নিচে ঘনভাবে বিস্তৃত থাকে এবং এগুলো পরিবেশব্যবস্থার (ইকোসিস্টেমের) এক অনন্য বৈচিত্র্যময় উপাদান হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এগুলো অমেরুদন্ডী প্রাণীর (রহাবৎঃবনৎধঃবং) আশ্রয়স্থল, বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদের জন্মস্থল এবং বিরল মাছের নিরাপদ আবাসস্থল হিসেবেও কাজ করে।
পরিবেশে জৈব বৈচিত্র্য : আল্লাহ তাআলা এমনভাবে পরিবেশের উপাদানগুলোকে সাজিয়েছেন, যাতে এর জৈব বৈচিত্র্য (ইরড়-ফরাবৎংরঃু) বজায় থাকে। এই বৈচিত্র্য বলতে বোঝায় প্রত্যেক সৃষ্ট জীবের সেই বিশেষত্ব, যা তাকে অন্যদের থেকে আলাদা করে। এই বৈচিত্র্য কেবল জীবিত প্রাণীর মধ্যেই নয়, বরং জড় পদার্থেও (তরল ও কঠিন উভয় প্রকারে) বিদ্যমান।
উদ্ভিদ ও প্রাণিজগতের মধ্যেও এ বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়। প্রতিটি সৃষ্ট জীব তার নিজস্ব প্রকৃতি ও গুণ অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন কাজ সম্পাদন করে এই কার্যবৈচিত্র্যই পরিবেশের ভারসাম্য ও টেকসই সৌন্দর্য রক্ষা করে।
পরিবেশের উপাদানগুলোর এই বৈচিত্র্যও আল্লাহ তাআলার নিখুঁত সৃষ্টিশৈলীর প্রমাণ বহন করে। মানুষ যতই নতুন উদ্ভাবন বা প্রযুক্তি তৈরি করুক না কেন, সে কখনোই এমন নিখুঁতভাবে তা করতে পারে না যে, সেখানে কোনো ত্রæটি বা বিরোধ থাকবে না। মানুষের উদ্ভাবনগুলো নির্দিষ্ট সময় পর্যন্তই কার্যকর থাকে এবং কেবল সীমিত নিয়মের অধীনে পরিচালিত হয়; কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো পরিবর্তিত ও ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে যায়।
এই বৈচিত্র্য সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন : “আর তিনিই (ঐ মহান সত্তা) যিনি বাগবাগিচা ‘সাজিয়েছেন’, মাচানির্ভর ও মাচাহীন লতা-বৃক্ষ দ্বারা। এবং (সাজিয়েছেন) খেজুরবাগান ও ক্ষেতের ফসল, যেগুলোর স্বাদ ভিন্ন ভিন্ন। এক (সাজিয়েছেন) যায়তুন ও আনার, যা পরস্পর সদৃশ, আবার পরস্পর অসদৃশ।” (সূরা আল-আন‘আম: ১৪১)
উদ্ভিদজগতে এই বৈচিত্র্য তাদের সমস্ত ধাপজুড়ে দেখা যায় তাদের জন্ম, বৃদ্ধি, এবং ফলের স্বাদ ও গঠনে। কুরআন আরও ইঙ্গিত করেছে “ক্লোরোফিল” (সবুজ পদার্থ) নামক প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার দিকে, যা উদ্ভিদের প্রাণশক্তি বজায় রাখে এবং যার মধ্যেও বৈচিত্র্য রয়েছে।
আল্লাহ তাআলা বলেন : “তিনিই আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করেন, তারপর আমরা তা দ্বারা সব ধরনের উদ্ভিদ উৎপন্ন করি; তারপর আমরা তা থেকে সবুজ কচি অঙ্কুর বের করি, যার মধ্য থেকে আমরা থরে থরে বিন্যস্ত দানা উৎপন্ন করি।” (সূরা আল- আন‘আম: ৯৯)
কুরআন ইঙ্গিত দেয় যে, এই দানাগুলোর মধ্যেই উদ্ভিদের প্রকৃতি, বৈশিষ্ট্য ও বংশগত গুণাবলি নিহিত থাকে যা ক্লোরোফিল দ্বারা সক্রিয় হয়।
কুরআনের দৃষ্টিতে পরিবেশগত বিপর্যয় :
যদি মানুষ পরিবেশ সংরক্ষণের বিধান অবহেলা করে, তবে তার এই আচরণ পরিবেশের প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করে দেয়, যার ফলে পৃথিবীতে জীবনের অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে যায়। মানুষের নিজের কাজই তখন তার ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
আল্লাহ তাআলা বলেনঃ“বস্তুত যদি আল্লাহ্ লোকদেরকে তাদের কৃতকর্মের কারণে ধরতেই থাকতেন (তাহলে) ভূখন্ডের উপর কোন প্রাণী বহাল রাখতেন না, তবে কিনা তিনি সবাইকে একটি নির্ধারিত মেয়াদ (কেয়ামত) পর্যন্ত বিলম্বিত করছেন।” (সূরা ফাতির: ৪৫)
পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য আসমানী শিক্ষাসমূহ
কুরআনিক সংবিধান পরিবেশ ও তার উপাদানসমূহকে তাদের কার্যক্ষমতার পূর্ণ নিরাপত্তা প্রদান করে এবং তা থেকে মানুষের সুষম উপকার নিশ্চিত করে। এর শিক্ষাসমূহ এক বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে উদ্ভূত, যা মানব, প্রকৃতি এবং সৃষ্টিকর্তার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে।
এবং এই ধারণার ভিত্তি হলো- আল্লাহ তাআলা এমন একটি ব্যবস্থা সৃষ্টি করেছেন যেখানে সবকিছুই পারস্পরিক সম্পর্ক ও সহযোগিতার ওপর নির্ভরশীল, যেমনটি মানবসমাজেরও হওয়া উচিত। আল্লাহ বলেন : “আর ভূমিতে (জলে, ছলে) যত প্রাণী বিচরণ করে এবং ডানা মেলে যত পাখী ওড়ে, (হাশর ও পুনরুত্থানের ক্ষেত্রে) সবই তোমাদের মত প্রাণীপুঞ্জ/সৃষ্টি। ”(সূরা আল-আন‘আম: ৩৮)
আর যারা ধর্মীয় মূল্যবোধ ও দিকনির্দেশনাকে পদদলিত করে, তাদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেনঃ
“আর যখন সে (আপনার কাছ থেকে) ফিরে যায় (তখন) সে দৌড়ঝাঁপ করে। এলাকায়, সেখানে ফাসাদ (ও গোলযোগ) সৃষ্টি করার জন্য এবং ফসল ও ‘নসল’ বরবাদ করার জন্য। অথচ আল্লাহ্ ফাসাদ পছন্দ করেন না” । (সূরা আল-বাকারা: ২০৫)
নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পরিবেশবান্ধব শিক্ষা
গাছ হলো পৃথিবীর ফুসফুস, প্রতিটি গাছ পৃথিবীতে নতুন জীবন আনে।কথায় আছে যে, গাছ ধ্বংস করে, সে তার ভবিষ্যতকেও ধ্বংস করে।
তাই নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বৃক্ষরোপণ ও তার সংরক্ষণকে এমন এক সওয়াবের কাজ হিসেবে গণ্য করেছেন যার জন্য মানুষ পুরস্কৃত হয়। তিনি বলেছেনঃ
“যে কোনো মুসলমান একটি গাছ রোপণ করে বা শস্য বপন করে, তারপর তা থেকে কোনো পাখি, মানুষ বা পশু আহার করে তাহলে তা তার জন্য সদকা হিসেবে গণ্য হয়।” (সহীহ মুসলিম/১৫৫২ )
সহাবায়ে কিরামও এই নির্দেশনা অনুযায়ী আমল করেছেন।কারণ তারা মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন দূষণ মানুষ ও পরিবেশ উভয়ের জন্যই ক্ষতিকর। আমরা দেখি যে, প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর (রাঃ) মুসলিম
সেনাদের উদ্দেশে উপদেশ দিয়ে বলেছিলেন :
“খেজুরগাছ কেটো না, পুড়িয়ো না, কোনো ফলবতী বৃক্ষ কাটো না, কোনো ভেড়া, গরু বা উটকে অকারণে যবেহ করো না, এবং শস্য নষ্ট করো না।” (ইসলামের রাজনৈতিক, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ইতিহাস লেখক: ড. হাসান ইব্রাহিম হাসান: ১/২১৩)
এই নির্দেশনাগুলো আসলে একপ্রকার পরিবেশ-নিরাপত্তা আইন, যা পরিবেশের উপাদানসমূহকে সুরক্ষিত রাখার উদ্দেশ্যে দেওয়া হয়েছিল। রাসুলের হাদিস থেকে এটাও প্রতিমান হয় যে, পরিবেশের সুরক্ষা একটি সমষ্টিগত দায়িত্ব, ব্যক্তিগত নয়।একই সঙ্গে এটি ইসলামী বিজয়ের এক অনন্য সাংস্কৃতিক রূপকে প্রকাশ করে যার তুলনা বিশ্বের অন্য কোনো সাম্রাজ্যের ইতিহাসে নেই।
ভূমি উন্নয়ন সংক্রান্ত নববী শিক্ষা : উদ্ভিদ ও প্রাণী ছাড়া পৃথিবী মরুভূমিতে পরিণত হয়। সম্পদ পুনঃব্যবহার পরিবেশ রক্ষা করে এবং বর্জ্য কমায়। চাষাবাদ মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে। তাই নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ভূমির উন্নয়নের গুরুত্ব উল্লেখ করে বলেছেন যে, জমি চাষাবাদ ছাড়া ফেলে রাখা উচিত নয়, কারণ তা পরিবেশের উন্নয়নমূলক ব্যবস্থাকে অকেজো করে দেয়। তিনি বলেছেনঃ“যার কোনো জমি আছে, সে যেন তা আবাদ করে অথবা তার ভাইকে (চাষের জন্য) দিয়ে দেয়।” (সহীহ বুখারী /২২১৫)
আরও বলেছেনঃ“যে ব্যক্তি মৃত (অনুর্বর) জমিকে জীবিত (আবাদযোগ্য) করে তোলে, তা তারই অধিকারভুক্ত হয়।” (তিরমিজি/১৩৭৮)
ইসলাম মানবসমাজকে আহবান জানায় এক শান্তিপূর্ণ ও ভারসাম্যপূর্ণ জীবনের দিকে যেখানে মানুষ তার প্রয়োজন অনুযায়ী উপকৃত হয়, কিন্তু পরিবেশের প্রাকৃতিক ব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ করে না। মানুষ যদি এই সংরক্ষণ ও দায়িত্বশীলতার পথে চলে, তবে সে পরিবেশের কল্যাণ ভোগ করবে; কিন্তু যদি সে সীমালঙ্ঘন, স্বার্থপরতা ও ধ্বংসাত্মক আচরণে লিপ্ত হয় তবে তার কর্মের শাস্তিও সেই অনুপাতে ভোগ করতে হবে। ইসলাম সমাজকে এমন এক শান্তিপূর্ণ ও স¤প্রীতিময় জীবনযাপনের আহŸান জানায় যেখানে মানুষ প্রয়োজন অনুযায়ী সন্তুষ্ট থাকে, পরিবেশের উপাদানগুলোর ওপর আগ্রাসন চালায় না, বরং সেগুলোর সংরক্ষণ ও যতœ নেওয়ায় অঙ্গীকারবদ্ধ থাকে।
পৃথিবী ডাকে তোমায়, আমায় দয়া করো, ক্লান্ত আমি,
অত্যাচারে ভারী বুকে জমেছে যত বেদনা স্বামী।
কমাও আবর্জনা, রোপণ করো হাসি আমার বুকে,
ভালোবাসা যদি ফুটে ওঠে আমাতে, ফিরে পাবো সুখে।
চলুন আমরা সবাই আমাদের পৃথিবী রক্ষায় সচেতন হই, কারণ এই পৃথিবী আমাদের কাছে একটি অর্পিত দায়িত্ব (আমানত),আর আমরা সবাই মিলে একে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আরও পরিষ্কার, সবুজ ও সুন্দর করে তুলতে পারি।
লেখক : প্রধান, আরবি সাহিত্য বিভাগ
দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী











