গত ১ অক্টোবর থেকে দেশের সুপারশপগুলোতে নিষিদ্ধ পলিথিনের বিকল্প হিসেবে ক্রেতাদের কেনার জন্য পাট ও কাপড়ের ব্যাগ রাখার নির্দেশ দিয়েছিল পরিবেশ অধিদপ্তর। সরকারের এ সিদ্ধান্তকে আমরা স্বাগত জানাই। এটি আনন্দের ও খুশীর সংবাদ বটে। তবে পলিথিনের ব্যবহার নিষিদ্ধে খুশি হলেও মাছ, মাংস, ডাল, চিনিসহ বেশ কিছু পণ্য কীভাবে পলিব্যাগ ছাড়া নেবেন তা নিয়ে চিন্তিত ক্রেতারা। যুক্তিযুক্ত বিকল্পও চান তারা। পরিবেশ অধিদপ্তর বলছে, পাট মন্ত্রণালয় সব সুপারশপের সঙ্গে সভা করে পাটের শপিং ব্যাগের সরবরাহ নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। গতকাল ১ নভেম্বর থেকে সব কাঁচাবাজারেও পলিথিন ব্যবহার নিষিদ্ধ হওয়ার কথা ছিল। একই সঙ্গে পলিথিন উৎপাদনকারীদের বিরুদ্ধেও অভিযান পরিচালানার সিদ্ধান্ত হয়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, পলিথিন নিষিদ্ধের আইন প্রণয়নের ২২ বছর হলেও এত বছর পলিথিনের ব্যবহার বন্ধ হয়নি। মাঝেমধ্যে অভিযানের নামে কিছু জরিমানা ও পলিথিন জব্দ করার কথা সংবাদপত্র সূত্রে জানা গেলেও পরিবেশ আইনের যথাযথ প্রয়োগ করা হয়নি। ফলে খাতায় পলিথিন নিষেধ থাকলেও বাস্তবে পলিথিন ও প্লাস্টিকের ব্যবহার চলেছে অবাধ। এখন যেহেতু সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে নির্দেশনা আসছে, আশা করা যায়, তা বাস্তবায়ন হবে, তবে জোর দিয়ে বলা চাই, সুপারশপগুলোতে পলিথিনের পর্যাপ্ত বিকল্প রাখতে হবে। ব্যাগের সর্বোচ্চ সাপ্লাই থাকতে হবে, না হলে মানুষকে ব্যাগ ব্যবহারে বাধ্য করা যাবে না।
আমাদের যে টিস্যু ব্যাগ, জালি ব্যাগ ছিল সেগুলো সরানো হয়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে পাটের তৈরি বিভিন্ন আকৃতির ব্যাগ দিয়েছে। যার মূল্য ৬ থেকে ১৭ টাকা পর্যন্ত। কাস্টমারদের সেগুলো কিনে মালামাল নিতে হবে। বেসরকারি উন্নয়ন ও গবেষণা চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের প্রধান নির্বাহী এম জাকির হোসেন খান গণ মাধ্যমকে বলেন, ‘সুপারশপ স্টোরগুলোতে পর্যাপ্ত ব্যাগ আছে কি না এটা পরিবেশ অধিদপ্তরকে তদারকি করতে হবে। ব্যাগের দাম কম নাকি বেশি সেটাও দেখতে হবে। এক্ষেত্রে তরুণদের মনিটরিংয়ে রাখা যায়। ব্যাগ ব্যবহার মানুষের অভ্যাসে পরিণত করতে হবে। যারা বাজারে জুট ব্যাগ তৈরি করবে, তাদের প্রথম দিকে ট্যাক্সমুক্ত রাখতে হবে। ‘যারা এখনো পিলিথিন ব্যবহার করবে তাদের পলিউশন ট্যাক্স দেওয়া উচিত। শপগুলোতে ব্যাগ রাখা বাধ্যতামূলক করতে হবে, তাহলে মানুষও কিনতে বাধ্য হবে।’ যা সুপারশপ মালিকদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে। আমরা এরই মধ্যে আমাদের শপের বিভিন্ন জায়গায় বিজ্ঞপ্তি দিয়েছি। আমাদের যে টিস্যু ব্যাগ, জালি ব্যাগ ছিল সেগুলো সরানো হয়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে পাটের তৈরি বিভিন্ন আকৃতির ব্যাগ দিয়েছে। যার মূল্য ৬ থেকে ১৭ টাকা পর্যন্ত। কাস্টমারদের সেগুলো কিনে মালামাল নিতে হবে। তবে সাধারণ ভোক্তারা মনে করছেন, দেশে প্রথম পলিথিন নিষিদ্ধ হয় ২০০২ সালে। এরপর থেকে আইনের প্রয়োগ না হওয়ায় ২২ বছর পলিথিনে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে মানুষ। বিশেষ করে শহরের মানুষ ব্যাগ ছাড়াই বাজারে যেতে অভ্যস্ত। বিকল্প সরবরাহ নিশ্চিত না করে নিষিদ্ধ করায় এটি কার্যকর করা যাবে কি না তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ ও সংশয় রয়েছে। তারা মনে করেন, পলিথিন পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর, কিন্তু তার যথাযথ বিকল্প আছে কি না সেটা সরকারকে ব্যবস্থা করতে হবে। যেখানে গ্রোসারি (মুদি) মাল প্রতিটি আইটেমের জন্য একটি করে পলিথিন দরকার হয় সেখানে হঠাৎ করে এত ব্যাগ থাকবে কি না সেটা একটা বিষয়। ব্যাগের দাম, ব্যাগ কতদিন টেকসই হবে এগুলোও খেয়াল রাখতে হবে। ব্যাগ ব্যবহার করতে আমাদের সমস্যা নেই, কিন্তু সেটি দামে মানে ঠিক থাকলে প্রশ্ন থাকবে না।’ অপরদিকে পলিথিন নিষিদ্ধ হলো, কিন্তু বিস্কুটের প্যাকেট থেকে শুরু করে দুধ, মসলাসহ যত প্যাকেটজাতীয় পণ্য রয়েছে সেগুলো নিষিদ্ধ হবে কবে। সুপারশপে মাছ, মাংস কীভাবে নেবে। নিরুপায় হয়ে পলিথিনে নিতে হয়, সেটার বিকল্প তৈরি করতে হবে। তবে বাজার বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সোনালি ব্যাগের তৈরি ও বাজারজাত করা গেলে পলিথিনের বিকল্প হিসেবে খুবই কার্যকর হবে। জানা যায়, সোনালি ব্যাগ দেখতে প্রচলিত পলিথিনের মতোই। এটি হালকা-পাতলা ও টেকসই। পাটের সূক্ষ্ম সেলুলোজ প্রক্রিয়াজাত করে এ ব্যাগ তৈরি করা হয়। পাটের তৈরি সোনালি ব্যাগ মাটিতে ফেললে তা মাটির সঙ্গে মিশে যাবে। ফলে পরিবেশ দূষিত হবে না। একটি ব্যাগ একাধিকবার ব্যবহার করা যায়।
জানা যায়, ২০২৫ সালের প্রথমার্ধে বাণিজ্যিকভাবে চালু হবে পাটের ব্যাগ তৈরির কাজ। এক কেজিতে গড়ে ১০০ ব্যাগ করা যায়। প্রাথমিকভাবে দৈনিক ৫ টন সোনালি ব্যাগ তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। জানা যায়, পরিবেশ মন্ত্রণালয় এবং পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয় যৌথভাবে পাটের ব্যাগ নিয়ে ক্যাম্পেইনটা করছে। পাটের ব্যাগ সম্প্রসারণে পরিবেশ অধিদপ্তর পাট মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করছে। আশার কথা হলো, শপিংশপগুলোর মালিকদের পক্ষ থেকে ‘পলিথিন নিষিদ্ধের ঘোষণার পর থেকে আমরা পাটের ব্যাগ বা পাট দিয়ে বিভিন্ন পণ্য তৈরি করে এমন উদ্যোক্তা ও সুপারশপ মালিকদের সঙ্গে বসেছি। স্বপ্ন, আগোরাসহ বড় শপগুলো উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে ব্যাগ বানিয়ে নিচ্ছে। তারা এভাবে চুক্তির মাধ্যমে দর-দাম করে ব্যাগ কেনাবেচা করছে। আমাদের ৯৭৫ জন উদ্যোক্তা রয়েছে যারা পাটজাতীয় পণ্য নিয়ে কাজ করে। আশা করি সংকট হবে না। তবে সুতা, ফেব্রিক্স অন্যান্য জিনিসের দাম বাড়লে অসুবিধা। আমরা চাই পাটজাতীয় পণ্যের বাজার সম্প্রসারিত হোক।’
জানা যায়, পলিথিন থেকে বিষফেনোল নামে বিষ নির্গত হয় এবং খাদ্যদ্রব্যের সঙ্গে মিশে যায়। পলিথিন মাটির সঙ্গে মেশে না, বরং মাটির উর্বরতা শক্তি নষ্ট করে। ব্যবহারের পর যত্রতত্র ফেলে দেওয়া হয় এসব পলিথিন ব্যাগ। ম্যানহোল, নালা, খাল, নদীতে পড়ে থাকা ব্যাগগুলো বৃষ্টি হলে পানি নিষ্কাশনে বিপত্তি ঘটায়। পানি নামার পথ রুদ্ধ হয়ে থাকায় দেখা দেয় জলাবদ্ধতা। পলিথিন নিষিদ্ধের আইন করার ২২ বছর হলো তবুও বাজারে পলিথিন বন্ধ করতে পারেনি প্রশাসন। এ জন্য দায় না ছাপিয়ে বরং এখন যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে তা কার্যকর করার যথার্থ ব্যবস্থা নিতে হবে। এছাড়া নাগরিকদের মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে। মানুষ অভ্যাসের দাস, তাদের সাময়িক অসুবিধা হতে পারে। তবে আমাদের স্বার্থে এ অভ্যাস বদলাতে হবে।