মিঞা জামশেদ উদ্দীন
প্রকৃতি-পরিবেশ, সমাজ ও রাষ্ট্র নিয়ে আমাদের এ জীবনাচার, তা কোনোভাবেই এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই, অনেকটা নিশ্চয়তা পেতে প্রকৃতি ও পরিবেশের কাছে দ্বারস্থ হতে হয়। এসব অনুষঙ্গের একটিও অনুপস্থিত, অর্থাৎ একে অন্যের পরিপূরক। আর এ বিপর্যয় ঠেকাতে জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। অন্যদিকে টানা দীর্ঘ বছর ধরে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে কথা বলে আসছেন সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি ‘বেলা’ নামে পরিবেশ বিষয়ক একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার আইনি-সহায়ক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এবং বর্তমানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা। জনাবা সৈয়দা রেজওয়ানা হাসান অতিতেও এসব বিষয়ে গণমাধ্যমে খোলামেলা- নির্ভয়ে আলোচনা ও বাদ-প্রতিবাদ করে আসছেন। এক কথায় দৃঢ়চেতা মনোভাব ও স্পষ্ট কণ্ঠস্বরের কারণে তিনি প্রশংসিত হয়েছেন। এরপরও সমালোচনা যে নেই তা বলবো না- তাতেও তাঁর ভ্রæক্ষেপ ছিল না কখনো। অনেকটা সমানতারাল ধাবমান। তবে, দূর থেকে যেমনটা দেখা তাঁকে পরিবেশ বিষয়ক আইনি দিক নিয়ে মাঠে-ঘাটে সোচ্চার থাকতে বিশেষ করে চট্টগ্রামের স›দ্বীপ চ্যানেলের উপকণ্ঠে অবস্থিত জাহাজ ভাঙা শিল্প, শীপ ব্রেকিং ইয়ার্ড নিয়েও মাতামাতি-সরগম থাকতে দেখা যায়। সুদূর রাজধানী ঢাকা থেকে ছুটে আসতেন। কখনো গ্রীনপিস জাহাজ আমদানিতে বাঁধা দেয়া। এবং এসবে আইনগত বিধি-নিষেধ খতিয়ে দেখা। জাহাজ ভাঙা শ্রমিকদের অধিকার নিয়েও সোচ্চার ছিলেন। সঙ্গে জলাশয় ভরাট, দূষণ ও পাহাড় কর্তনসহ জলবায়ু পরিবর্তন বিষয় নিয়েও অগ্রণী ভ‚মিকা পালন করেন। তবে জাহাজ ভাঙা ইয়ার্ডের তেমন একটা পরিবর্তন আসেনি। বলতে হয়, সমস্যা যে তিমিরে সেই তিমিরে রয়ে গেল। মানব দেহের ক্ষতিকারক ও অতি ঝুঁকিপূর্ণ বর্জ্য বাহি জাহাজ কর্তন চলছে হরহামেশাই। এতে করে আশঙ্কা হারে শ্রমিকদের প্রাণহানির ঘটনা ঘটে চলেছে। সঙ্গে স্বাস্থ্যগত ঝুঁকিতেও রয়েছে শ্রমিকসহ এলাকাবাসীরা। ইতিমধ্যে দেশের রাসায়নিক ও তেজস্ক্রিয় পরীক্ষাগার জাহাজ ভাঙা ইয়ার্ডে আহত শ্রমিকদের ওপর পরীক্ষা চালিয়ে অতিমাত্রা কঠিন পদার্থ পারদ ও রেডিয়েশনের উপস্থিতি পেয়েছে। কিন্তু ওইসব ক্ষতিকারক পদার্থের নির্গম কোনোভাবেই বন্ধ করা যায়নি। এতে শুধু মানবদেহের ক্ষতি হচ্ছে না, জীববৈচিত্র্যেরও হুমকির সম্মুখীন। তবে পরিবেশবিষয়ক যেসকল সংস্থা রয়েছে, মুলত সেগুলো ঠুঁটো জগন্নাথ।
পরিবেশ অধিদপ্তর ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের ছাড়পত্র নিয়ে গুটিকয়েক সেপটি এজেন্সি শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড এলাকায় কাজ করে আসছে, কার্যত আমদানি নিষিদ্ধ জাহাজ কর্তনে তাদের কোনো ভুমিকা আছে বলে মনে হয় না। শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডগুলো দাপটের সাথে ওইসব নিষিদ্ধ জাহাজ কর্তন অব্যাহত রেখেছে। সেন্ট মার্টিন নিয়েও রাজনীতিকরা মাঠে চাপের মধ্যে রয়েছে। তারা এ নিয়ে চাপা ক্ষোভ প্রকাশ করছে। সোশ্যাল মিডিয়াতেও বেশ সোচ্চার দেখা যায়। হঠাৎ করে সেন্ট মার্টিন দ্বীপে পরিবেশের দূষণের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার গুঞ্জন শুনা যাচ্ছে। বিশেষ করে পরাশক্তিধর রাষ্ট্রের নজর পড়েছে দ্বীপটির ওপর। সাড়ে তিন হাজার বছরে পুরনো এ দ্বীপ। আয়তনে ১০-১৫ বর্গ কিলোমিটার। দ্বীপটির উত্তর ও দক্ষিণে প্রায় ৫.৩৩ কিলোমিটার লম্বা। প্রস্ত কোথাও ৭০০ মিটার, আবার কোথাও ২০০ মিটার। দ্বীপটির অদূরে ডুবন্ত অবস্থায় অগণিত শিলাস্ত‚প আছে। সম্ভাবনাও রয়েছে, এটি আয়তনে বিস্তৃতি পাওয়ারও। দ্বীপের চতুর্দিকে চোখ ও মন জোড়ানো নীল জলরাশি। পর্যটন বিকাশে অপার সম্ভাবনা রয়েছে। শুধু সেন্ট মার্টিনের পর্যটন খাত থেকে কোটি কোটি টাকা রাজস্ব আয়েরও সুযোগ রয়েছে। আর এ জন্য অনুক‚ল পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। প্রয়োজনে ২০-৩০টি সুপেয় পানির প্লান্ট বসানো যেতে পারে। এসবে একেকটি প্লান স্থাপনে সর্বোচ্চ লক্ষ টাকা ব্যয় হবে বলে সংশ্লিষ্টরা অভিমত প্রকাশ করেছে। চট্টগ্রামের হালিশহর- বড়পুল এলাকার বিএল ইন্টারন্যাশনাল-এর কর্ণধার ঝুলন রায় এমন সহনীয় উদ্যোগের কথা জানালেন। এতে পরিবেশ বিপর্যয় থেকে রক্ষা সম্ভব হবে প্রবাল দ্বীপটি। অর্থাৎ প্লাস্টিকজাত বোতল-জার ব্যবহার করার আর সুযোগ থাকবে না। এভাবে আরো ছোট ছোট একাধিক প্লান- প্রদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে। এছাড়া ছোট ছোট মাটির গর্তে মধ্যে ওইসকল বর্জ্য পুঁতে দেয়াসহ রিসাইক্লিন করার উদ্যোগও নিতে পারে। ওই সুপেয় ওয়াটার প্লানের উদ্যোক্তার সাথে দীর্ঘক্ষণ কথা বলে জানা গেছে, যেকোনো দুর্যোগেও মোবাইল প্লানের মাধ্যমে দ্রুত যেকোনো স্থানে সুপেয় পানির ব্যবস্থা করা যেতে পারে। গভীর নলক‚প ছাড়াও পুকুর, ঝিল, নদী-নালা ও সাগর-মহাসাগরের পানিকে বিশুদ্ধ ডিংকিং ওয়াটার বা সুপেয় পানির চাহিদা মিটানোর সক্ষম। সঙ্গে পচনশীল পণ্যসামগ্রি ব্যবহারে উৎসহ দিতে হবে ভোক্তাদের। এমনকি মাটির থালা-বাসন, মগ-পাত্র, কলশ ব্যবহারে উৎসহ দিতে হবে।
সেন্ট মার্টিন দ্বীপে ১০ হাজার অধিবাসী বাস করে। এছাড়া পর্যটকসহ লক্ষাধিক লোকের সমাগম হয় প্রতি বছর। ‘এনভায়রনমেন্ট অ্যাডভান্স’ নামের একটি বিজ্ঞান সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়, দ্বীপটি ২০ ধরনের বিপদের মুখে পড়েছে উল্লেখ করে বিশেষ এক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই গবেষণাপত্রে স্বাভাবিক চেয়ে তাপমাত্রা ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি পেয়েছে তারা। সঙ্গে জীববৈচিত্র্যও হারাতে বসেছে। দ্বীপটিতে বিলুপ্ত প্রজাতির প্রায় জলপাই রঙের কাছিমসহ চার প্রজাতির ডলফিন ও বিপন্ন প্রজাতির পাখি এবং নানা বন্য প্রাণীর বসবাস রয়েছে। বলা হচ্ছে, দ্বীপটির গাছ কর্তন ও প্লাস্টিকের জার-বোতল, কাটুন ও প্যাকেটজাত বর্জ্যস্তূপ অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে। এজন্য পর্যটক সীমিত করা হয়েছে । কোনোভাবেই হাজার- বারোশ’র বেশি পর্যটক যেতে দেওয়া যাবে না এবং রাত যাপনেরও বিধিনিষেধ জারি করা হয়েছে। তার মধ্যে ফেব্রæয়ারি মাস পর্যটক আসা-যাওয়া সম্পুর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টাদের এক সভায় এ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে বলে কয়েকটি গণমাধ্যমে তা প্রকাশিত হয়। এছাড়া দ্বীপসংলগ্ন বঙ্গোপসাগরে আশপাশে ১ হাজার ৭৪৩ কিলোমিটারকে সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণা করা হয়েছে। সব মিলেই একধরনের ধূ¤্রজাল-পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে সেন্ট মার্টিনকে নিয়ে। তবে খেয়াল রাখতে হবে, পরিবেশের নামে কোনো দূরবসন্ধি আমজনতা মেনে নেবে না। পরিবেশ বিপর্যয়ের জুজু ভয়ের কথা শুধু সেন্ট মার্টিন দ্বীপকে নিয়ে বলা হচ্ছে কেন। সত্যি যদি এমনই, দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে
অপতৎপরতা চালানো হয় আমজনতা কোনোভাবেই তা মেনে নিবে না। যদি পরিবেশ বিপর্যয়ের কথা ওঠে, তাহলে হাতির অভয়ারণ্য বা নিরাপদ করিডোরে কথা কেন বলা হচ্ছে না- ‘ডাল মে কুচ কালাহে’। এখন কেন পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো চুপচাপ রয়েছে; খাদ্য ও নিরাপদ করিডোরে খোঁজে হাতির পাল লোকালয়ে হানা দিচ্ছে। গত একমাসে আনোয়ারা-কর্ণফুলিতে ৪ জন নিরহ গ্রামবাসী হাতির আক্রমণে মারা যায়। তাছাড়া হাতির আক্রমণের আতঙ্কে গ্রামবাসী গ্রাম ছাড়া রয়েছে। এদিকে কক্সবাজার ঘুমধুম এলাকায় খাদ্য অভাবে লোকালয়ে এলে একটি হাতি ট্রেনের ধাক্কায় মারাত্মকভাবে আহত হয়। বনবিভাগ আহত হাতিটি উদ্ধার করলেও পরবর্তীতে হাতিটির অবস্থা বা তার আর কোনো খোঁজ-খবর পাওয়া যায়নি। তাহলে ধরে নিতে হবে, আমাদের জীববৈচিত্র্য ও প্রকৃতি-পরিবেশ রক্ষাকচব নীতি বড়ই দুর্বল। যে কেউ যেভাবে সেভাবে কোনকিছু ঘটিয়ে দিতে দ্বিধাবোধ করছে না।
মিয়ানমারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর আশ্রয়ের কারণে হাতিদের অভয়ারণ্য সম্পুর্ণ নিছিন্ন হয়ে পড়ে। হাতির সহ অন্যন্য পণ্য প্রাণী আরো উত্তরে সরে পাহাড়ি গভীর অরণ্য ভ‚মিতে আশ্রয় দিয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়ার একটি কোম্পানি, কোরিয়ান এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন (কেইপিজেড) নামে চট্টগ্রামের আনোয়ারা-কর্ণফুলির দেয়াং পাহাড়ে কয়েক হাজার একরের বিস্তীর্ণ পাহাড়ি বনাঞ্চল দখলে নেয়। এটি পাহাড়ি-ঢিলা বেষ্টিত সবুজ গণ অরণ্যভুমি। ওখানে আগে থেকে হাতির অভয়ারণ্য ছিল। ওই কেইপিজেড-এর লাগাওয়া পালকি চরের এলাকাটি অবস্থিত। জীববৈচিত্র্য রক্ষার্থে আরো অধিকতর সবুজ বনায়নে প্রদক্ষেপ নিতে হবে। প্রয়োজনে অবৈধ দখলদার ওই কোম্পানির সকল স্থাপনাকে উচ্ছেদ চালাতে হবে। প্রকৃতি- পরিবেশ ধ্বংস করার ছাত্রপত্র পাওয়ার এখতিয়ার কারো নেই। এধরনের কিছু হলে সেটি অবৈধ হিসেবে গণ্য হবে। কাজেই, কোম্পানিটি তাদের স্থাপনা নিজেদের উদ্যোগে গুটিয়ে নিয়ে যেতে পারে। প্রয়োজনে সেন্ট মার্টিন দ্বীপের ওপর বিশেষ জরিপ ও গবেষণা চালানো ওই বিদেশী সাময়িকীর গবেষকরা সরজমিনে ঘটনাস্থলে পর্যবেক্ষণে আসতে পারে। এতে কোন পক্ষের আপত্তি থাকতে পারে না। এখানে পক্ষপাতিত্ব বা বৈরী আচণ বলতে কিছু নেই।
২০২৩ সালের শেষে দিক পালকি চরে যাওয়া হয়। সঙ্গে বন্ধুবর সুদীপ্ত রায় ও তার বন্ধু জসিম সাহেবও সঙ্গে ছিলেন। সুদীপ্ত তার গাড়িটি ড্রাইভ করছিলেন। আমাদের যেতে হয় চট্টগ্রামের কোতোয়ালী, কর্ণফুলীর নতুন ব্রীজ হয়ে। কয়েক কিলোমিটার যাওয়ার পর বিশাল বিস্তীর্ণ ভ‚মির গণ সবুজের পাহাড়ি ঢিলা। আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে চলছে আমাদের গাড়ি- আশ্চর্য হলাম, গণ সবুজের এ পাহাড়ি-ঢিলা কি করে এসব স্থাপনা গড়ে ওঠার সুযোগ পেল। সুদীপ্ত বন্ধু জসিম সাহেব জানালে, সন্ধ্যা হলে এ পথে হাতির পাল চলাচল করে। আমরা মধ্যে প্রচÐ কৌতূহল জন্মায় বনের হাতির পাল দেখার। আমাদের দেশে বন্য প্রাণী হাতি যে আছে, সেটিও আশ্চর্যের বিষয় হতে পারে। যা কিনা এত বিশালতা, স্থলের সবচেয়ে বড় প্রাণী ঐরাবত। ভাবতেই কেমন পুলকিত হই। এখানে হাতি ছাড়াও শিয়াল, বানর, হরিণ, সাপসহ অন্যান্য প্রাণীও রয়েছে।
লেখক: মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক, কবি ও কলামিষ্ট