মনিরুল ইসলাম মুন্না
সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় পরিবহনের আয়ুষ্কাল সংক্রান্ত বিষয়ে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। এ আয়ুষ্কাল নির্ধারণ নিয়ে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে মালিকদের মধ্যে। তাছাড়া ২০১০ সাল থেকে বেশ কয়েকবার পুরনো পণ্যবাহী পরিবহন চলাচল নিষিদ্ধ করা হলেও এখনও মূল সড়ক থেকে সরেনি এসব আনফিট বাস।
গত কয়েকদিন নগরীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এবং পরিবহন সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া যায়।
পরিবহন মালিকদের মতে, হঠাৎ করে হাজার হাজার পরিবহন কোথায় নিয়ে যাবে, এমন দুশ্চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। এতে একদিকে আর্থিকভাবে ক্ষতি এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে পরিবহন সংকটে পড়ে যাবে। ফলে পুনরায় একই পরিবহন সড়কে চলাচল করবে। গাড়ির অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল শুধুমাত্র বয়সের উপর নির্ভর করে না, বরং এর রক্ষণাবেক্ষণ, ব্যবহারের ধরন এবং পরিবেশগত অবস্থার উপরও নির্ভর করে।
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে যে, এই সিদ্ধান্ত সড়ক নিরাপত্তা এবং পরিবেশ সুরক্ষার জন্য অপরিহার্য। পুরনো ও ত্রুটিপূর্ণ গাড়িগুলো সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ, তাই এগুলোকে পর্যায়ক্রমে সরিয়ে দেওয়া প্রয়োজন।
তবে একটি বাস সর্বোচ্চ ২০ বছর ও পণ্যবাহী যান ২৫ বছর সড়কে চলতে পারবে। কিন্তু এরপর এসব বাস-ট্রাকের ভবিষ্যৎ কী হবে, তা নিয়ে পরিষ্কার কোন ধারণা তৈরি হয়নি। এমন পরিস্থিতিতে আয়ুষ্কাল নির্ধারণ জটিলতা আরও বেড়েছে।
সাধারণত মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়িকে ধ্বংস (স্ক্র্যাপ) করতে হয়। কিন্তু স্ক্র্যাপ নীতিলামা এখনও খসড়া পর্যায়ে রয়েছে। তাই স্ক্র্যাপ নীতিলামার অধীনে এসব গাড়ি ধ্বংস করার আনুষ্ঠানিক উপায় তৈরি হয়নি। তাহলে যেসব বাস ও ট্রাকের আয়ুষ্কাল শেষ হয়ে যাচ্ছে, এসব গাড়ি কী করা হবে, সে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। একই সঙ্গে স্বাভাবিক চলাচলের অনুপযোগী এসব যান সড়কে থেকে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার রাতে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সংস্থাপন শাখা একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে। এতে সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮-এর ধারা ৩৬ অনুযায়ী গণ ও পণ্য পরিবহনের আয়ুষ্কাল (ইকোনমিক লাইফ) নির্ধারণ করা হয়। এটি আগামী ১ জুলাই থেকে কার্যকর হবে বলে জানানো হয়েছে। তবে প্রজ্ঞাপনে ব্যক্তিগত গাড়িসহ অন্যান্য যানের আয়ুষ্কাল নিয়ে কিছু বলা হয়নি।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) পরিচালক শীতাংশু শেখর বিশ্বাস বলেন, ‘আপাতত এগুলো ড্যাম্পিং করতে বলা হয়েছে। স্ক্র্যাপ নীতিমালা আগাচ্ছে। ওইটা চূড়ান্ত হয়ে গেলে ইকোনমিক লাইফ টাইম শেষ হওয়া গাড়ির ভবিষ্যৎ আইনিভাবে নির্ধারিত থাকবে।’
পরিবহন সংগঠনের দাবি : বাণিজ্যিক মোটরযানের ইকোনমিক লাইফ এর স্থগিত পুনঃবিবেচনার দাবি জানিয়েছে পরিবহন সংগঠনগুলো। গত রবিবার বৃহত্তর চট্টগ্রাম গণ ও পণ পরিবহন মালিক ফেডারেশন আয়োজিত জরুরি সভায় চট্টগ্রামের বিভিন্ন রুটের বাস মালিক সমিতির নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
এ সভায় নেতারা বলেন, ২০১৮ সালের সড়ক পরিবহন আইনে বহু সাংঘর্ষিক ধারা রয়েছে, যা গণপরিবহন ব্যবস্থার জন্য প্রতিবন্ধক। এর ফলে পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হচ্ছেন। এ প্রজ্ঞাপনের ফলে চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার, চট্টগ্রাম-রাঙ্গামাটি, চট্টগ্রাম-কাপ্তাই, চট্টগ্রাম- রাউজান, চট্টগ্রাম-নাজিরহাট, চট্টগ্রাম-আনোয়ারা, বাঁশখালি, চট্টগ্রাম-শুভপুর চলাচলরত রুটে তিন হাজার এর অধিক বাস, পাঁচ হাজারের অধিক পণ্য পরিবহন গাড়ি স্ক্র্যাপ নীতির আওতায় বন্ধ হয়ে যাবে। বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা এই পরিস্থিতি আর্ন্তজাতিকভাবে যন্ত্রাংশের দামের ঊর্ধ্বগতির কারণে পরিবহন মালিকরা দিশেহারা। এই অবস্থায় প্রজ্ঞাপনটি বাস্তবায়ন হলে চরম ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে পরিবহন মালিক শ্রমিকগণ। উল্লেখিত সড়কগুলোতে চলাচলরত গাড়িগুলো স্ক্র্যাপ নীতির আওয়ায় বন্ধ হয়ে গেলে যোগাযোগ ব্যবস্থায় জনসাধারণের ভোগান্তির সৃষ্টি হবে।
তারা আরও বলেন, ১ জুলাই হতে প্রজ্ঞাপনটি কার্যকর হলে অতি অল্প সময়ে পরিবহন মালিকদের গাড়ি ক্রয় করে সড়কে নামানো সম্ভব নয়। সড়কে আরও বিশৃঙ্খলা ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিরূপ প্রভাব পড়বে। বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পরিকল্পিত পরিবহন মালিকবান্ধব ইকোনমিক লাইফ নির্ধারণ মোটরযান নীতিমালা প্রণয়নের জোর দাবি জানাই এবং ২০২৫, ২০২৬ বাণিজ্যিক গাড়ির অগ্রিম আয়কর কার্যকর না করা আরোপিত আমদানিকৃত যন্ত্রাংশের শুল্কহার কমানো এবং জারিকৃত প্রজ্ঞাপনটি স্থগিত করে পরিবহন মালিক সংগঠনের সাথে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বৈঠকের মাধ্যেমে উক্ত সংকট হতে উত্তোলনের দাবি জানাচ্ছি।
চট্টগ্রাম সড়ক পরিবহন মালিক গ্রুপের যুগ্ম সম্পাদক মো. শাহজাহান বলেন, ‘ফিটনেস যদি ঠিক থাকে, তাহলে একটি বাস ৩০ বছর পর্যন্ত চলতে পারে। বাসের লাইফ টাইম পাঁচ বছর পর্যন্ত বাড়ানোর দাবি জানিয়েছি আমরা। সে সাথে পরিবহন মালিকবান্ধব ইকোনমিক লাইফ নির্ধারণ মোটরযান নীতিমালা প্রণয়নের জোর দাবিও জানিয়েছি। সরকার চাইলে সে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। চেসিস ইঞ্জিন এগুলো আমাদের দেশে তৈরি হয় না। ফলে আমদানি ব্যয় বেড়ে যাবে। আর যদি লাইফ টাইম বাড়ানো না হয়, তাহলে যন্ত্রপাতির দাম কমানোর কথা বলেছি।’
১৫ বছরেও সরেনি আনফিট বাস : সর্বপ্রথম ২০১০ সালে ২০ বছরের বেশি পুরনো বাস এবং ২৫ বছরের বেশি পুরনো পণ্যবাহী পরিবহন চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়। এরপর ২০১৫ সালে একবার নির্বাহী আদেশ জারি করা হয়। ২০২৩ সালে আবার প্রজ্ঞাপন জারি হয়। কিন্তু কোনো কিছুতেই কিছু হয়নি। উল্টো একই বছরের আগস্টে প্রজ্ঞাপনটি প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। অভিযোগ রয়েছে, পরিবহন মালিকদের চাপে বিআরটিএ তখন পিছু হটে।
অটোমোবাইল প্রকৌশলী আনোয়ার হোসেন বলেন, ইকোনমিক লাইফ টাইম গাড়ির ফিটনেসের ওপর ওঠানামা করতে পারে। সব গাড়ি ২০ বছর টিকবে, তা নয়। আগেও বাতিল করে দেওয়া যায়। আবার ফিটনেস ঠিক থাকলে আরও কিছু দিন চালানো যেতে পারে। তবে স্ক্র্যাপ নীতিমালা দ্রুত চূড়ান্ত করা উচিত।