পরিত্যক্ত ওয়্যারলেস টাওয়ার সংস্কারের উদ্যোগ মেয়রের

56

 

কালোরাত্রি একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাক হানাদার বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে দেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে গেছেন। সেই বার্তা দ্রæতই দেশের বিভিন্নস্থানে প্রেরণের পরিকল্পনাও করেন। কিন্তু এরই মধ্যে পাকিস্তানি শাসকেরা টেলিফোন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। তাই তিনটি মাধ্যমে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচারের ব্যবস্থা করেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার একটি অন্যতম মাধ্যম হিসেবে কাজ করে সীতাকুন্ডের সলিমপুরে অবস্থিত ওয়্যারলেসের টাওয়ার। যেটির মাধ্যমে ঢাকা থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার বার্তা গ্রহণ করে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা বহির্বিশ্বেও প্রচার করেছিলেন।
জাতির জনকের সেই স্বাধীনতার বার্তা প্রেরণের স্মৃতিবিজড়িত টাওয়ারটি পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে আছে দীর্ঘদিন। সেটিকে সংস্কার করে দর্শনীয় স্থানে রূপ দিতে চায় চট্টগ্রাম সিটি কপোরেশন। মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী এই প্রসঙ্গে পূর্বদেশকে জানান, যে ওয়্যারলেস টাওয়ারটির মাধ্যমে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা চট্টগ্রামে প্রেরণ করেছিলেন। মোবাইল প্রযুক্তির প্রসার ঘটায় কালক্রমে টাওয়ারটি প্রয়োজনীতা হারিয়ে অকেজো হয়ে পড়েছে। এটি কেবল প্রযুক্তির একটি টাওয়ার নয়, স্বাধীনতার ইতিহাস, বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার বার্তা প্রেরণের স্মৃতিচিহ্নও। বর্তমান প্রজন্মকে এই ওয়্যারলেস টাওয়ারটির ইতিহাস সম্পর্কে জানাতে হবে, দেখাতে হবে। না হয় তারা মুক্তিযুদ্ধের কথা জানবে, বলবে কিন্তু অনুধাবন-ধারণ করতে পারবে না। ইতোমধ্যে সলিমপুরের ওয়্যারলেসের টাওয়ারটি আমি দেখতে গিয়েছি। টিএনটি’র জায়গাটি সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। তাছাড়া এটি সিটি এলাকার মধ্যে পড়েনি। তবুও সংশ্লিষ্ট সকলের সাথে কথা বলে পরিত্যক্ত টাওয়ারটিকে টিকিয়ে রাখতে এবং নতুন প্রজন্মকে এটির ইতিহাস জানাতে সংস্কারের মাধ্যমে একটি দর্শনীয় স্থানে রূপ দেওয়ার প্রাথমিক পরিকল্পনা হাতে নিয়েছি। যাতে এ প্রজন্ম, আগামি প্রজন্ম সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে গিয়ে স্বাধীনতার ইতিহাসকে ধারণ করতে পারে।
যুক্তি তথ্য-প্রমাণ প্রেক্ষাপট বঙ্গবন্ধুই স্বাধীনতার ঘোষক’ বইটির লেখক ও সাংবাদিক মুহাম্মদ শামসুল হক জানান, একাত্তরের পঁচিশে মার্চ রাতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাক বহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং তা ওয়্যারলেসের মাধ্যমে চট্টগ্রামে তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা জহুর আহমদ চৌধুরীর কাছে প্রেরণ করেন এবং তাঁর ঐ বাণী চট্টগ্রামের কালুরঘাট স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে প্রথমে ২৬ মার্চ দুপুরে আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নান ও পরে ২৭ মার্চ তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান (বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা) তা পাঠ করে শোনান। একথা আজ ইতিহাস এবং এ বাণী প্রচারের মধ্য দিয়ে কালুরঘাট বেতারও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র হিসেবে ইতিহাসের অংশ হয়ে আছে। কিন্তু কীভাবে, কখন বঙ্গবন্ধু এই বাণী প্রচার করলেন বা পাঠালেন, কে তাঁর এই বাণী গ্রহণ করলেন ও কিভাবে তারা প্রচারের ব্যবস্থা নিলেন এবং কারা নেপথ্যে থেকে জীবন বাজি রেখে বঙ্গবন্ধুর বাণী দেশের অভ্যন্তরে ও বহির্বিশ্বে প্রচারে কাজ করেছেন, তার সঠিক তথ্য প্রকাশিত না হওয়ায় বঙ্গবন্ধু আদৌ এই ঘোষণা দিয়েছিলেন কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ থাকে। আর এই অস্পষ্টতার কারণে মহল বিশেষ স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে প্রশ্ন তুলে জনগণ বিশেষ করে নতুন প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করার এবং ইতিহাসকে বিকৃত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত হওয়ার সুযোগ পায়। তাই কোনো গালগল্প নয়, এই ওয়্যারলেস টাওয়ারসংশ্লিষ্ট কর্মকতা-কর্মচারী, সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে আমার লেখা বইয়ে সবটা তুলে ধরা হয়েছে।
এ ইতিহাস গবেষক আরও বলেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে পরিকল্পিতভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন এবং টেলিফোন ও ওয়্যারলেসের মাধ্যমে সে ঘোষণা যথাক্রমে মধ্যরাতেই চট্টগ্রামের তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা, চট্টগ্রাম সংগ্রাম কমিটির অন্যতম নেতা (পরবর্তীতে শ্রম ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রী) মরহুম জহুর আহমেদ চৌধুরীর বাসভবনে এবং সকালে ফৌজদারহাটস্থ সলিমপুর ওয়্যারলেস স্টেশনে পৌঁছে। অতঃপর কিভাবে বহির্বিশ্বে ও সাধারণ জনগণের কাছে দ্রæত এ খবর ছড়িয়ে পড়ে সে বিষয়ে জানার আঝে।।
‘যুক্তি তথ্য-প্রমাণ প্রেক্ষাপট বঙ্গবন্ধুই স্বাধীনতার ঘোষক’, বই থেকে আরও জানা যায়, ২৫ মার্চ দিনগত রাত ১ টায় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হওয়ার অন্ততঃ এক থেকে দেড় ঘন্টা আগেই তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং চট্টগ্রামে প্রেরণের ব্যবস্থা করেন। তিনি পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক স্বাধীনতার যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য আপামর বাঙালি জনসাধারণের কাছে উদাত্ত আহবান জানান। বঙ্গবন্ধুর ঘোষণাটি দেশে এবং বিদেশে তাৎক্ষণিকভাবে প্রচারের বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হয়। সে সময়কার উত্তেজনাকর ও বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে বাণী প্রেরণের ব্যবস্থার কথা কৌশলগত কারণে সরাসরি প্রকাশ করা সম্ভব ছিল না। যেহেতু সময়টি ছিল অত্যন্ত উত্তেজনাপূর্ণ এবং প্রতিটি বাঙালির জীবনের জন্য চরম ঝুঁকিপূর্ণ। তাই সে সময় বাণীটি রিসিভ করাই ছিল গুরুত্বপ‚র্ণ কাজ; মিনিট-সেকেন্ড নির্ধারণ করে বাণীটি কে দিল তা যাচাই করার জন্য নয়। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা ঢাকার মগবাজারস্থ ভি এইচ এফ (ভেরী হাই ফ্রিকোয়েন্সী) ওয়্যারলেসযোগেও প্রেরণের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল। সেখানকার তৎকালীন ইঞ্জিনিয়ারিং সুপারভাইজার (ইএসডব্লিউ) মেজবাহ উদ্দিন গত ২৬ মার্চ সকাল আনুমানিক সাড়ে ৬ টায় অত্যন্ত ভীতিজনক পরিবেশে মগবাজার ওয়্যারলেস স্টেশন থেকে চট্টগ্রামের সলিমপুরস্থ ভিএইচএফ ওয়্যারলেস স্টেশনে যোগাযোগ করে বাণীটি প্রেরণ করেন। ওয়্যারলেস স্টেশনের পরিচিতি পরে দেয়া হয়েছে। মাঝরাত ১২ টার পর জহুর আহমদ চৌধুরীর বাসা থেকে বাণীটি সংগ্রাম পরিষদের বৈঠকে আসার পরপরই নেতাদের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাণীটি বিপুল সংখ্যায় সাইক্লোস্টাইল কপি করে মাঝরাত থেকেই সারা শহরে বিলি করার ব্যবস্থা নেয়া হয়। ২৬ তারিখ সকালেই সংগ্রাম পরিষদের বৈঠকে বাণীটি রেডিওতে প্রচারের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ঐদিন বাণীটির কপি শহর ছাড়িয়ে জনতার হাতে হাতে মফস্বল এলাকায় পৌঁছে যায়।
অপরদিকে সলিমপুর ওয়্যারলেস স্টেশনের দু’টি পৃথক বিভাগের স্টাফরা তাদের নিজ নিজ চ্যানেলের মাধ্যমে সমুদ্রে অবস্থিত বিদেশি জাহাজ এবং কলকাতা (ভিডবিøউসি) স্টেশনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার বিষয়টি আন্তর্জাতিকভাবে প্রচারের ব্যবস্থা নেন। তাঁরা বাণীটি দেশের অভ্যন্তরেও যতদূর সম্ভব জানাশোনা আওয়ামী লীগ নেতা কর্মীসহ বিভিন্ন স্তরে টেলিফোনে ও টাইপ করে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করেন। ৭১ এর ২৬ মার্চ ভাের রাত থেকে ২৭ মার্চ-এ বঙ্গবন্ধুর নামে স্বাধীনতা ঘোষণাসম্বলিত একটি সাইক্লোস্টাইল কপি সর্বত্র বিলি বন্টন হয়েছিল বলে বেশ কয়েকটি তথ্য দিয়ে প্রমাণ করা হয়।
ওয়্যারলেস টাওয়ার ছাড়াও আরও দুটি মাধ্যমে চট্টগ্রাম স্বাধীনতার বার্তা পৌঁছে । বঙ্গবন্ধু তার পাশের বাসায় অবস্থানরত মোশারফ হোসেন বা নঈম গওহরের মাধ্যমে বাণীটি চট্টগ্রামে প্রেরণের চেষ্টা করেছিলেন।
সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা এম আর সিদ্দিকী (পরবর্তীতে বাণিজ্যমন্ত্রী) টেলিফোনে বঙ্গবন্ধুর বাসায় যোগাযোগ করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে প্রতিবেশী মোশারফ হোসেন ও নঈম গওহরের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর সাথে যোগাযোগের ব্যবস্থা করেন। বঙ্গবন্ধু তাদেরকে একথা বলতে বলেন যে, ‘আলোনা ব্যর্থ হয়ে গেছে, সেনাবাহিনী ইপিআর ও পুলিশকে অস্ত্র সমর্পণ না করতে বলুন এবং জনগণকে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে বলুন!’
এ ব্যাপারে বিস্তারিত কথা বলার আগেই হঠাৎ করে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। পরে রাত সাড়ে এগারটা থেকে বারটার মধ্যে স্বাধীনতা ঘােষণার একটি বাণী টেলিফোনযোগে তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা এবং মন্ত্রী জহুর আহমদ চৌধুরীর বাসায় আসে। সে সময় জহুর আহমদ চৌধুরী চট্টেশ্বরী রোডস্থ ওয়াপদা রেস্ট হাউসে সংগ্রাম পরিষদের বৈঠকে কর্মপন্থা নির্ধারণ নিয়ে আলােচনায় ব্যস্ত ছিলেন। তাঁর অনুপস্থিতিতে তাঁর স্ত্রী ডাঃ নুরুন্নাহার জহুর ফোন রিসিভ করে বাণীটি লিখে নেন এবং অল্পক্ষণের মধ্যে একাধিক কাগজে কপি করে সংগ্রাম পরিষদের বৈঠকে পাঠান। এ ছাড়া টেলিফোনে সলিমপুর ওয়্যারলেস স্টেশনেও (কোস্টাল স্টেশন) অবহিত করেন।