মিঞা জামশেদ উদ্দীন
অভীক ওসমান। পরতে পরতে, এক অধ্যায় এবং এক ক্ষণজন্মার নাম। বিশেষ করে নব্বই দশকে এ নামের ব্যক্তিটি ছিল জীবন্ত স্ফূলিঙ্গ। বিশেষ করে ‘রাতফেরার অবশেষে জেনারেল’ নাটকে তাঁর বিপ্লবি উত্থান ঘটে। এটি আশির দশকের শেষের কাহিনী। রীতিমতো টান টান উত্তেজনা। কিন্তু সবাই পিনপতন নিরব। চট্টগ্রাম শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে পথ নাটকটি মঞ্চস্থ হয়। তখন দেশে এক জেনারেল জগদ্দল পাথরের মতো চেপে ধরেছে জাতির টুটি। টানা সংগ্রাম চলছে ছাত্র-জনতার স্বৈরচার বিরোধী আন্দোলন। কোথায় খাওয়া কোথায় থাকা; মনে হচ্ছে এক সেকেন্ডের মধ্যে টেনেহিঁচড়ে নামিয়ে পদপিষ্ট করি।
নাটকটির লেখক ছিলেন অভীক ওসমান। কিন্তু লেখকের ধারেকাছে যাওয়া বা সংস্পর্শ পাওয়াও ছিল রীতিমতো এক কঠিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের কাছে লেখককে অন্যভাবে জানা, দেবতুল্য ও আদর্শিক-চেতনা। এভাবে কল্পনা এবং ভাবনার দুয়ারে উঁকিঝুঁকি। এসব তাঁর কেরাসমাতি-যাদুকরী শক্তি-গল্প। ওইসময় অভীক ওসমান টগবগে এক যুবক। সম্ভবত সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা যুবক কিংবা মেধাবী শিক্ষক। অবশ্য এর বেশি কিছু জানারও সুযোগ ছিল না। নিজেও অধ্যয়ন অবস্থা বাঁধাভাঙা-উচ্ছ্বাসে। প্রতিদিন ঝুলে ঝুলে ২৪ মাইল অদূর থেকে ছুটে আসা এক নব্য কিউভান চির বিপ্লবী চে-গুয়েভারা! এমন চেতনা ধারণ না করলে কি উজ্জ্বল- নক্ষত্রসম যৌবন ইস্পাত-কঠিন এ দৃঢ়তা এবং সর্বদাই জাগ্রত হওয়া ;
সদা হাস্যোজ্জল চির তরুণ অভীক ওসমান। জীবন পৌঢ়তায়ও মেঘবর্ণ-ছুঁইতে পারেনি। কিছু পীড়াদায়ক কাল এখনো শিহরণ। আবার কাকতালীয় ভাবে ভীষণ যোগসূত্রও। বিশাল একটি পরিবারে বেড়ে ওটা। তের ভাইবোনের মধ্যে তিনি বটবৃক্ষ। তাই দায়িত্বটা অনুকরণীয় ছিল। সেই এক সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে পাড়ি দেওয়া। বাবা সাদামাটা আদর্শী এবং ন্যায়-নিষ্ঠাবান শিক্ষাগুরু। যাকে পান্তিক কৃষকও বলা যায়। একটি নোঙর করা জাহাজের মতো বিশাল পরিবার। মা-সংসার নামক ঘানি টেনে টেনে বৈতরণী পার হওয়া। আমাদের কিন্তু এক বেশি, চৌদ্দ। তবে অবস্থান ছিল ১১তম। তখনকার জনসংখ্যার বিশালতার-এ আধিক্য। ষাট কিংবা সত্তর দশকে এমন একটি পরিসংখ্যা মামুলিক, উড়ে বেড়াতো। ‘জন যার ধন তার বা দশের লাঠি একের বোঝা।’ পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যেও-এ ভেদাভেদ তীব্র ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানের ৫ কোটি, পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে সাত কোটি লোকসংখ্যা। তবুও অর্থনৈতিক, সামরিক ও পরিকল্পনায় বিশাল, যোজন-যোজন পারক বা বৈষম্য ছিল।
তবে নব্বই দশকের পর অনেকটা হাওয়া। ওইসময়ে একজন তরুণ উদ্যোক্তাদের চালিকা শক্তি ছিলেন তিনি। যেখানে টানা ৩০ বছর ধরে পত পত করে পতাকা উড়ানো তাঁর। যাকে বলতে হয় ভ্রæণ থেকে টেনে আনা। আজকে তারা-অনেকে মহীরুহ। কিন্তু অভীক ওসমান তার অভীষ্ট লক্ষে মাতাল হাওয়াকে তেড়ে ধাবমান। আজ চট্টগ্রাম চেম্বার ঝলমল এক স্তম্ভ। মাথা নুয়ে নয়, উঁচু করে দেখতে হয়। এরমধ্যে ভিন্ন মেরুতে চলা। অবশ্য ওইসময়ে আমি শহর ছাড়া অজপাড়া গাঁয়ে। শহরের যান্ত্রিকতায় বেসামাল। কয়েকটি গণমাধ্যমে টুকিটাকি, কলুর বলদের মতো ঘানি টেনে যাওয়া। না, গ্রামের নিড়িতা-শুনশান এবং ছায়াশীতল হাওয়া, আঁকাবাঁকা মেঠোপথ বড্ডই ভালো লাগে।
অভীক ভাইকে আবারও পিচঢালা রাজপথে নয়, এবার ক্ষানিকটা আভিজাত্যে, শান্ত এক কপোত। তবে, যেকোনো মুহূর্তে অগ্নিমূর্তি ধারণ করতে পারে!তিনি পেশাগত দায়িত্বে খুবই সিরিয়াস। এতসব প্রভাকান্ডের মধ্যে একধরণের বালখিল্য মনোভাব, যা কিনা সারল্যতা বা উদার মানসিকতা প্রকাশ।
অভীক ওসমানের অসংখ্য গ্রস্থ প্রকাশিত হয়েছে। আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘আমি অকৃতী অধম’ এর আতুড়ঘরের ইত্যকার কাহিনী নখদর্পনে। আহ্; অভীকভাই সবকিছু উজার করে এক অনিশ্চিত আলোর মুখ দেখলেন। বলতে যাচ্ছি, প্রতিটি বিষয় যেন তিনি নুড়ি-মুক্তার মতো খুঁটে খুঁটে, অতিযত্নসহকারে বুনেছেন। হাতে নিয়ে একবাক্যে বলতে হয়— অসাধারণ এক নান্দনিক শিল্পকর্ম এবং বিমূর্ততা। যদিও-বা এটি কাব্যগ্রন্থ নয়। প্রবন্ধের মতো আত্মজৈবনিক, অনেকটা কাটখোট্টা বিষয়বস্তু গ্রন্থিক হওয়া। এতে বিশেষ ইঙ্গিতবহ মেসেজ আছে।
গ্রন্থে লেখক অভীক ওসমান তার ৪০ নং মোমিন রোড এবং কদম মোবারক স্কুল, যেখানে সেভেন-এইট পর্যন্ত পড়েছেন। স্কুলে বির্তকে অংশ নিতেন এবং ক্লাসে ফার্স্ট হতেন। তখন ইসলামবাদী সংঘ ও সৌরভ-এ সাথেও জড়ান। স্কুলের পেছনে ছিল রাজার দিঘি। দিঘিতে সহপাঠীরা মিলে স্নান-সাতার কাটতেন। এ দিঘির পাশে রাজা ত্রিদিব রায়ের বাসা— তিনি পাকিস্তান সরকারের কেন্দ্রিয় মন্ত্রী ছিলেন। স্কুলে লেখাপড়ার পাশাপাশি দেয়ালিকা বের করতেন। মুলত সেখান থেকে রাজনীতিতে হাতেখড়ি। শৈশব থেকে তাঁর সংগ্রামী জীবন। টিউশনির বিনিময়ে আহার করা। এটি একসময়ে ব্যাপক প্রচলন ছিল গ্রাম-গঞ্জে। ওইসময়ে এক ছাত্রীর প্রেমে পড়েন। মেয়েটি এত মায়াবী ছিল যে তার দিকে অপলক চেয়ে থাকা এবং মুগ্ধতার আবির ছড়াতো ক্ষণে ক্ষণে। তাকে নিয়ে কবিতাও লেখেন। পাশাপাশি টিউশন, লজিং, হাফলজিং থেকেও খরচাপাতি সংগ্রহ করতে হতো।
অভীক ওসমানের জীবনে যতসব বৈচিত্র্যময় ঘটনা— প্রান্তিক জনদের সাথেও তাঁর জানাশোনা-সখ্যতা ছিল। রাখাল আহমদ, জালাল, নুরুচ্ছাফা বাইস্যা ও জালালের ভাইয়ের স্মৃতি কাতর। নানার বাড়ি, খালার বাড়ি, বুবুর বাড়ির রাখালদের সাথে গল্প- আড্ড এবং একসাথে খাওয়া- ঘুমানোর বিচিত্র কাহিনী। মনে পড়ে, শহর থেকে গেলে বুবুর রাখালদের বলতেন, ‘আঁর ভাইয়ুরে লই যা, মাটির রসত হাঁড়ি নামাইযরে আগেই আঁর ভাইযরে হাবাবি।’
১৯৬৭ সালের ১৭ ফেব্রæয়ারি ছোটভাই এমরানকে নিয়ে চলে আসলেন চটগ্রাম শহরে। কিন্তু জন্মস্থান এবং স্মৃতি মাড়িয়ে আসা ছিল রক্তক্ষরণ। অগ্রহাণের মাঠ, বন্ধুদের সাথে দাঁড়িয়াবান্ধা খেলার পেছনে রইলো গেরুয়া যুবতী- নদী, শঙ্খ, শ্যামল-গ্রাম এবং নিশীথে লঞ্চের ভয়ংকর ভেঁপু।
রাজনীতির পাঠ: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তির যে সনদ ৬ দফা ঘোষণা দিয়ে ছিলেন চট্টগ্রাম লালদিঘি ময়দানে। তখন থেকে বঙ্গবন্ধুকে দেখা এবং ভাষণ শোনা। ১৯৬৯ এর দিকে পাকিস্তান সরকার ‘পাকিস্তান-দেশ ও কৃষ্টি’ নামে একটি গ্রস্থ প্রকাশ করে। এ গ্রন্থটি ছিল বাঙালি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে। স্কুলে পড়াকালে এ রাজনীতির দুর্বৃত্তায়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সরব হয়ে ওঠা। তারা তপ্ত দুপুরে মিছিল সহকারে গিয়ে খাস্তগীর স্কুলের মেয়েদের নিয়ে প্রতিবাদে নেমে আসে রাজপথে। এরপর ৭০ নির্বাচন হলো। কর্মী হিসেবেও গ্রাম-গঞ্জে বিভিন্ন জায়গায় মিছিল ও পোস্টার লাগানো। বঙ্গবন্ধু এমএনন ছিলেন। পাক সরকারের প্রথম প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ছিলেন নুরুল ইসলাম চৌধুরী। তাদের আসনের এমপি ছিলেন, সদরুল পাশার বাবা ডা. এবিএম ফয়েজুর রহমান।
মুক্তিযুদ্ধের গল্প ছিল এভাবে, সে মায়ের সবচেয়ে ভীতু ছেলে। এমন কি প্রাকৃতিক কর্ম সারাতে যেতে, মা আগ বাড়িয়ে ল্যাম্প নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। তাঁর মা কিন্তু কওমি মাদ্রাসার ছাত্রী ছিলেন। ছেলে যখন পড়তেন, মা তখন কানপেতে শুনতেন— ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি।’ সেই মা তার সবচেয়ে ভীতু ছেলেটিকে গভীর-নিশীথে ঘর থেকে বের দিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে যাওয়া জন্য।
অপারেশন: দক্ষিণ চট্টগ্রামে উল্লেখযোগ্য অপারেশনের মধ্যে বশরত নগর মাদ্রাসা, জিরি মাদ্রাসা, রাজাকার আব্দুল হাকিমের ঘর, পটিয়া থানা, আনোয়ারা থানা ও ইন্দ্রপোল অপারেশন। বশরত নগর মাদ্রাসা অপারেশনে সবুর খান গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। দক্ষিণ চট্টগ্রাম অঞ্চলটি ছিল হানাদার মুক্ত অঞ্চল। শাহজাহান ইসলামাবাদী দক্ষিণ চট্টগ্রামে যুবকদের সংগঠিত করে ভারতে নিয়ে ট্রেনিং-এ ব্যবস্থা করেন। এস এম ইউসুফের মাধ্যমে উল্লেখসংখ্যক স্বাধীনতাকামী যুবক গেরিলা যুদ্ধের ট্রেনিং নিয়েছিলেন। অভীক ওসমান বয়সে কিশোর ছিলেন। তারপরও তাদের কাজ ছিল শত্রæর অবস্থান চিহ্নিত- রেকি করা। সঙ্গে ছিল কালাম ও ইলিয়াছ। তারাও এ দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন।
সীমান্ত পার হতে গিয়ে মিয়াখান নগরের কালামদের গ্রামের বাড়ির কাজের ছেলেদের দোকানের মাচায় এক রাত থাকতে হয়। মিরসরাই শুভপুর বাস স্টেশন, করেরহাট দিয়ে রামগড় বর্ডার পার হওয়ার চেষ্টা।
অভীক ওসমানের বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনে, কলেজের শিক্ষাকতা, চিটাগাং চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি এর সচিব, শিপ ব্রেকিং অ্যাসোসিয়েশনের সচিব এবং জিপিএইচ ইস্পাত লিমিটেড এর মিডিয়া এডভাইজার। তিনি সর্ব প্রথমে আয়োজন করেন চট্টগ্রামে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলাসহ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠানের পণ্য প্রদর্শনী ও উদ্যোক্তাদের মেলা। পাশাপাশি অসংখ্য দেশ ভ্রমণও করেন জাপান, সিঙ্গাপুর, আমেরিকা, জার্মান, বেলজিয়াম, কিংডম অব সৌদি আরব, ইউনাইটেড আরব আমিরাত, শ্রীলঙ্কা, ফিলিপাইন ও থাইল্যান্ড।
লেখক : কবি, গবেষক ও কলামিস্ট