পবিত্র শবে বরাত বরকতময় মাহে শাবানের উপহার

1

ফখরুল ইসলাম নোমানী

পবিত্র মাহে রমজানের আগমনী বার্তা নিয়ে বিশ্ব মুসলিমের মাঝে হাজির হলো পবিত্র শাবান মাস। হিজরি চান্দ্রবর্ষের অষ্টম মাস হলো শাবান মাস। এ মাস বিশেষ মর্যাদা ও ফজিলতপূর্ণ। হিজরতের দেড় বছর পর পূর্বতন কিবলা ফিলিস্তিনের মসজিদুল আকসা বা বাইতুল মুকাদ্দাস-এর পরিবর্তে মক্কা শরিফের মসজিদুল হারাম তথা খানায়ে কাবা তথা কাবা শরিফ কিবলা হিসেবে ঘোষিত ও নির্ধারিত হয় এই শাবান মাসেই। তাই শাবান মাস একদিকে যেমন মুসলিম স্বাতন্ত্র ও ইসলামি ঐক্যের মাস অন্যদিকে তেমনি কাবাকেন্দ্রিক মুসলিম জাতীয়তা ও ভ্রাতৃত্ববোধে উজ্জীবিত হওয়ার মাস। শাবান মাসের ফজিলত সম্পর্কে নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেছেন রজব আল্লাহর মাস, শাবান আমার মাস এবং রমজান আমার উম্মতের মাস। শাবান মাসকে রমজান মাসের প্রস্তুতি ও সোপান মনে করে রাসূলুল্লাহ (সা.) বিশেষ দোয়া করতেন এবং অন্যদের তা শিক্ষা দিতেন। উম্মুল মুমিনীন হজরত আয়েশা (রা.) বলেছেন নবী করিম (সা.) কখনো নফল রোজা রাখতে শুরু করলে আমরা বলাবলি করতাম তিনি বিরতি দেবেন না। আর রোজার বিরতি দিলে আমরা বলতাম যে তিনি মনে হয় এখন আর নফল রোজা রাখবেন না। আমি রাসূলুল্লাহ (সা.) কে রমজান ব্যতীত অন্য কোনো মাসে পূর্ণ এক মাস রোজা পালন করতে দেখিনি। কিন্তু শাবান মাসে তিনি বেশি নফল রোজা রেখেছেন। অন্য একটি হাদিসে বর্ণিত আছে শাবান মাস ছাড়া অন্য কোনো মাসে রাসূলুল্লাহ (সা.) এত অধিক হারে নফল রোজা আদায় করতেন না। পবিত্র রজব মাস শেষ হওয়ার পর আকাশে-বাতাসে বরকতময় শাবান মাসের আগমন বার্তার গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। এখন থেকে ধর্মপ্রাণ ও খোদামুখী বান্দারা পবিত্র রমজান মাসে প্রবেশের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে।
পবিত্র শাবান ফজিলত ও অনন্য মর্যাদাপূর্ণ মাস। শাবান মাস মুসলিম স্বাতন্ত্র ও ইসলামি ঐক্যের মাস। আরবি এ মাসের পূর্ণ নাম হলো ‘আশশাবানুল মুআজজম’ অর্থ মহান শাবান মাস। নবী করিম (সা.) হিজরি সালের শাবান মাসের গুরুত্ব, মাহাত্ম্য ও তাৎপর্যের বিবেচনায় এ মাসে অধিক হারে নফল ইবাদত-বন্দেগি করতেন। মাহে রমজানের মর্যাদা রক্ষা এবং হক আদায়ের অনুশীলনের জন্য রাসুলূল্লাহ (সা.) শাবান মাসে বেশি বেশি রোজা রাখতেন। এ সম্পর্কে হযরত আনাস (রা.) বলেছেন নবী করিম (সা.) কে জিজ্ঞেস করা হলো আপনার কাছে মাহে রমজানের পর কোন্ মাসের রোজা উত্তম ? তিনি বললেন রমজান মাসের সম্মান প্রদর্শনকল্পে শাবানের রোজা উত্তম। হযরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে রাসূলুল্লাহ (সা.) এর প্রিয় মাসের একটি হলো শাবান। এ মাসে নফল রোজা আদায় করেই তিনি মাহে রমজানের রোজা পালন করতেন। রাসুলুল্লাহ (সা.)-রজব ও শাবান মাসব্যাপী এ দোয়া বেশি বেশি পড়তেন : আল্লাহুম্মা বারিক লানা ফি রজব ওয়া শাবান, ওয়া বাল্লিগ না রমাদান। অর্থাৎ-হে আল্লাহ! রজব মাস ও শাবান মাস আমাদের জন্য বরকতময় করুন ; রমজান আমাদের নসিব করুন। যেন আমরা রমজান মাস পেয়ে অধিক হারে ইবাদত বন্দেগি, রোজা, তারাবি, লাইলাতুল কদরের ইবাদত, ইতিকাফ ইত্যাদির মাধ্যমে মহান পবিত্র রমজান মাসের ফজিলত লাভে ধন্য হই। এ জন্য পবিত্র রজব মাসের চাঁদ উদিত হওয়ার পর রমজানের চাঁদ দেখা পর্যন্ত উপরোল্লিখিত দোয়াটি পাঠ করা সুন্নত বা মুস্তাহাব।
পবিত্র শাবান মাসের বিশেষ আমল সমূহের মধ্যে অন্যতম হলো-বেশি বেশি নফল রোজা পালন করা। মাস জুড়ে প্রিয় নবি (সা.) এর নিয়মিত আমল প্রতি সোম ও বৃহস্পতিবার রোজা পালন করা। এছাড়া শুক্রবারসহ এমাসেও আইয়ামে বিজের রোজা অর্থাৎ চান্দ্র মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ নফল রোজা পালন করা। রোজা রাখার পাশাপাশি এ মাস জুড়ে নফল নামাজ বেশি বেশি আদায় করা। বিশেষ করে তাহাজ্জুদ, ইশরাক, চাশ্ত-দোহা, জাওয়াল, আওয়াবিন, তাহিয়াতুল মসজিদ, দুখুলুল মসজিদ ইত্যাদি নামাজের ব্যাপারে যতœবান হওয়া খুবই জরুরি। আর সব সময় প্রিয় নবি করিম (সা.) এর শেখানো দোয়াটি পড়া আমাদের জন্য একান্ত কর্তব্য। হযরত উসামা বিন যায়েদ (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন আমি নবী করিম (সা.) কে জিজ্ঞেস করলাম হে আল্লাহর রাসূল! আপনাকে শাবান মাসে অন্যান্য মাস অপেক্ষা বেশি নফল রোজা রাখতে দেখি। এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সা.)-বললেন রজব ও রমজানের মধ্যবর্তী এ মাস অনেকেই খেয়াল করেনা। এটি এমন একটি মাস যে মাসে মানুষের সব কর্মকান্ড আল্লাহর সামনে উপস্থাপন করা হয়।
হযরত মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা.)-বর্ণিত একটি হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সা.)-ইরশাদ করেছেন আল্লাহতাআলা মধ্য শাবানের রজনীতে তার সৃষ্টির (বান্দাদের) প্রতি দৃষ্টি দেন এবং সবাইকে ক্ষমা করে দেন তবে তারা ব্যতীত যারা আল্লাহর সঙ্গে কাউকে অংশীদার সাব্যস্ত করে এবং অপরকে ক্ষতি সাধনের বাসনা পোষণ করে। শাবান মাসে শবে বরাত নামে বিশেষ একটি রজনী আছে যে রজনীতে বান্দার সারা বছরের আমল আল্লাহর দরবারে পেশ করা হয় এবং আগামী এক বছরের জন্য বান্দার হায়াত, মউত, রিজিক, দৌলত ইত্যাদির নতুন বন্দোবস্ত দেওয়া হয়। যে কারণে শাবান মাসকে এত বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। এ মাসে মুসলমানদের আমল-আখলাক যেন সুন্দর হয় রাসূলুল্লাহ (সা.) সে দিকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছেন। শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত ১৫ তারিখের রাতকে ‘শবে বরাত’ বলা হয়। শবে বরাত কথাটি ফারসি। শব মানে রাত বারাআত মানে মুক্তি ; শবে বরাত অর্থ মুক্তির রাত। শবে বরাতের আরবি হলো ‘লাইলাতুল বারাআত’ তথা মুক্তির রজনী। এ রাতে ইবাদত করা ও দিনে রোজা রাখা সুন্নত। হজরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন ১৫ শাবানের রাত (১৪ তারিখ দিবাগত রাত) যখন আসে তখন তোমরা তা ইবাদত-বন্দেগিতে কাটাও এবং পরদিন রোজা রাখো।
শাবান মাসে ভারসাম্যপূর্ণ নেক আমলের তাগিদ দিয়ে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন তোমরা তোমাদের সাধ্যানুযায়ী আমল করবে কেননা আল্লাহর কাছে প্রিয় আমল তা-ই যা সর্বদা পালন করা হয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) প্রায় গোটা শাবানে নফল রোজা পালন করতেন এবং অন্যদেরও বিশেষভাবে আমল করার উৎসাহ দিতেন। তাই বলা হয় রজব মাসে শস্য বপন করা হয় শাবান মাসে ফসল কাটা হয় এবং রমজান মাসে ফসল কর্তন করা হয়। রাসুল (সা.) রজব মাসে প্রায় ১০টি নফল রোজা রাখতেন এবং শাবান মাসে ২০টি নফল রোজা রাখতেন। রমজানে পূর্ণ মাস ফরজ রোজা রাখতেন। শাবান মাস মূলত পবিত্র মাহে রমজানের প্রস্তুতির মাস। প্রতিবারের মতো শাবান মাস মুসলমানদের কাছে রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মহিমান্বিত রমজান মাসের সওগাত নিয়ে আসে। রাসূলুল্লাহ (সা.) শাবান মাসে অন্যান্য মাসের তুলনায় বেশি বেশি নফল রোজা, পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত ও নামাজ আদায় করে মাহে রমজানের পূর্বপস্তুতি গ্রহণ করেছেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) এর কাছে শাবান মাসের মর্যাদা এতই বেশি যে যখন তিনি এ মাসে উপনীত হতেন তখন মাহে রমজানকে স্বাগত জানানোর উদ্দেশ্যে আল্লাহর কাছে অধিক হারে এই বলে প্রার্থনা করতেন হে আল্লাহ! আপনি আমাদের রজব ও শাবান মাসের বিশেষ বরকত দান করুন এবং আমাদের রমজান পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দিন। সুতরাং মুমিন মুসলমানের উচিত শাবান মাসজুড়ে নিজেদের ইবাদত বন্দেগিতে নিয়োজিত রাখা।
সর্বশ্রেষ্ঠ মাস রমজানের আগাম প্রস্তুতির তাগিদ ও শবে বরাতের উপহার নিয়ে এলো বরকতময় শাবান মাস। শবেবরাতে যেমন পালনীয় বিষয় রয়েছে তেমনি এ রাতে কিছু বর্জনীয় বিষয়ও রয়েছে। এ রাতে আতশবাজি, হইহুল্লোড়, অহেতুক কাজে লিপ্ত থাকা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। অন্যের ব্যাঘাত সৃষ্টি করে নিজে কোনো ইবাদত করা যাবে না। আল্লাহ্র কাছে পাঁচটি রাত খুবই মর্যাদার। এর মধ্যে শবে বরাতের রাতও রয়েছে। হাদিস শরিফে এসেছে নিশ্চয়ই পাঁচ রাত্রির দোয়া আল্লাহ কবুল করেন। (১) রজব মাসের প্রথম রাতের দোয়া (২) শবে বরাতের দোয়া (৩) শবে কদরের দোয়া (৪) ঈদুল ফিতরের রাতের দোয়া ও (৫) ঈদুল আজহার রাতের দোয়া। আল্লাহ এ পুণ্যময় রজনিতে অসংখ্য বান্দা বান্দিকে ক্ষমা করেন তবে দুই শ্রেণির লোকের জন্য তাঁর ক্ষমার দ্বার বন্ধ থাকে। এক. ‘মুশরিক’ যে তাঁর সঙ্গে অন্যকে উপাস্য বানিয়েছে ; দুই. বিদ্বেষপোষণকারী যে তার অন্য মুসলমান ভাইয়ের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে। আল্লাহ আমাদেরকে এ রাতের গুরুত্ব বুঝে আমল করার তাওফিক দান করুন। শবে বরাত অনুতপ্ত হৃদয়ের মুক্তির রাত। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের যথাযথভাবে শব-ই-বরাত পালন করার তৌফিক দান করুক। আল্লাহুম্মা বারিক লানা ফি রজব ওয়া শাবান, ওয়া বাল্লিগ না রমাদান। আমিন!

লেখক : ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট