পবিত্র মে’রাজের শিক্ষা ও উপহার

1

সৈয়দ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন আল আযহারী

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ রাসুল হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মু’জিযা হলো পবিত্র ইস্রা ও মি’রাজ। এটা প্রিয় নবীর জীবনে এবং ইসলামের ইতিহাসে একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। তিনি ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোনো মানুষ, অন্য কোনো নবী-রাসুল, এমন কি কোনো নৈকট্যধন্য ফেরেশতদের জীবনেও এ ধরনের সৌভাগ্যময় ঘটনা সংঘটিত হয়নি এবং কিয়ামত পর্যন্ত হবেও না। স্বয়ং আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীন তাঁর প্রিয় হাবিবকে দাওয়াত করে হযরত জিব্রাইলকে পাঠিয়ে ‘বুরাক’ ও ‘রফরফে’ আরোহণ করিয়ে সর্বলোকের অতীত ‘কাবা কাওসায়ন আও আদনা’-এর মাকামে মহান আল্লাহর খাস কুরবতে নিয়ে যান এবং আল্লাহ পাকের দিদার প্রদানে ধন্য করেন। যা আল্লাহ্ পাক রাব্বুল আলামীনের মহান কুদরত ও তাঁর প্রিয় হাবীবের নবূয়্যত-রিসালতের সত্যতার স্বপক্ষে একটি বিরাট প্রমাণ এবং ঈমানদার ও জ্ঞানীদের জন্য হেদায়ত, নেয়ামত, রহমত ও শিক্ষা।
মে’রাজের শিক্ষা: ইসরা ও মি’রাজ নিছক একটি অলৌকিক ঘটনা নয়। মি’রাজে রয়েছে আমাদের জন্য অনেক শিক্ষা। যেমন,
আল্লাহ্র প্রিয়ভাজন বান্দাদের বরকতময় স্মৃতি ও নিদর্শনাবলীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন ও বরকত হাসিল করা:
যাত্রা পথে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম মদিনা শরীফ, সিনা পর্বত (যেখানে হযরত মূসা আলাইহিস্ সালাম আল্লাহ্ তা‘আলার সাথে কথোপকথন করার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন) এবং বেথেলহাম (হযরত ইসা আলাইহিস্ সালাম এর জন্মস্থান ফিলিস্তিনের বেথেলহাম) এ যাত্রা বিরতি করেন এবং ঐ বরকতময় স্থানগুলোতে নামায আদায় করেন। এ থেকে প্রমাণিত, আল্লাহ্র প্রিয়ভাজন বান্দাদের বরকতময় স্মৃতি ও নিদর্শনাবলীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা ও বরকত হাসিলের জন্য সেখানে নামায, দোআ ও ফাতিহা পাঠ করা সুন্নাত। [নাসাঈ, কিতাবুস্ সালাত, হাদিস নং-৪৫০]
রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামের নবুয়তের সার্বজনীনতা প্রকাশ ও সকল নবী রাসূলের উপর তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ : বায়তুল মাকদিসে সমস্ত নবী-রাসূল তাঁর ইমামতিতে সালাত আদায় করা তাঁর নবুয়তের সার্বজনীনতার পাশাপাশি তাঁকে ইমামুল আম্বিয়া ওয়াল মুরসালিন হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের প্রমাণ।
অদৃশ্য জগতের বাস্তবতাকে বুঝিয়ে দেওয়া : পরকাল অদৃশ্য জগত। তাই এর বাস্তবতা নিয়েও জড়বাদী বা বস্তুবাদীরা সন্দেহ পোষণ করে থাকে। তাই আল্লাহ সকল মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে তাঁর হাবিবকে এর বাস্তবতা দেখিয়ে দিলেন। জান্নাতের সুখ-শান্তি যে কত অফুরন্ত আর জাহান্নামের আযাব-গযব যে কত ভয়াবহ তা তিনি চাক্ষুস প্রত্যক্ষ করলেন।

ইসলাম হলো মানুষের স্বভাবজাত ধর্ম : মিরাজের রাত্রিতে রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে মদ এবং দুধ পরিবেশন করা হলে, তিনি দুধ গ্রহণ করেন এবং মদ প্রত্যাখ্যান করেন। তখন জিব্রাইল আলাইহিস সালাম তাঁকে বলেন, আপনি ফিতরাতের পথ অবলম্বন করেছেন। (মুসলিম শরিফ, হাদিস নং-৪৪২)

বিবিধ নেয়ামত ও নানা ধরণের শাস্তির প্রত্যক্ষকরণ : এ সফরে নবীজীকে জান্নাত-জাহান্নামের ভ্রমণও করানো হয়। নবীজী বলেন, জান্নাতের প্রাসাদগুলো মুক্তার তৈরি আর তার মাটি হল মেশকের। (দ্রষ্টব্য : সহীহ বুখারী, হাদীস ৭৫১৭)
তিনি মিরাজে কিছু সামাজিক অপরাধের শাস্তি স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছেন। যা পরবর্তীতে তাঁর উম্মতকে সতর্ককরণে বিশেষ সহায়ক হয়েছে। কেননা, কোন একটা বিষয় শুনে বলার চেয়ে দেখে বলার মধ্যে অনেক বেশী কার্যকর অনুভুতি থাকে। নবীজী যখন প্রথম আসমানে যান দেখেন এক ব্যক্তি, তার ডান পাশে কিছু রূহ আর বাম পাশে কিছু রূহের কাফেলা। তিনি ডানদিকে তাকালে হাসেন আর বাম দিকে তাকালে কাঁদেন। তিনি নবীজীকে সম্ভাষণ জানালেন। নবীজী জিজ্ঞাসা করলেন, জিবরাঈল! ইনি কে? জিবরাঈল বললেন, ইনি আদম আ.। আর তার দুই পাশে তার সন্তানদের রূহ। ডানদিকেরগুলো জান্নাতী আর বামদিকেরগুলো জাহান্নামী। এজন্য তিনি ডানদিকে তাকিয়ে হাসেন আর বামদিকে তাকিয়ে কাঁদেন। (বুখারী-৩৩৪২)
নবীজী একদল লোককে দেখলেন, তাদের নখগুলো তামার। নিজেদের নখ দিয়ে তারা নিজের গাল ও বুকে আঁচড় কাটছে। জিজ্ঞাসা করলেন, জিবরাঈল, এরা কারা? বললেন, এরা ওই সমস্ত লোক, যারা মানুষের গোশত খেত এবং তাদের সম্ভ্রমে আঘাত হানত। অর্থাৎ গীবত করত এবং মানুষকে লাঞ্ছিত করত। (মুসনাদে আহমাদ- ১৩৩৪০)
এ সফরে তিনি দেখলেন, একদল লোকের ঠোঁট আগুনের কাঁচি দিয়ে কাটা হচ্ছে। জিজ্ঞাসা করলেন, এরা কারা ?
জিবরাঈল বললেন, এরা বক্তৃতা করত বটে, কিন্তু নিজেরা আমল করত না। মুসনাদে আহমাদ-১২২১১)

নবীগণ আলায়হিমুস্ সালাম সশরীরে জীবিত : নবী ও রসূলগণ আলায়হিমুস্ সালাম-এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- তাঁরা ওফাত বরণের পরও সশরীরে জীবিত। তাঁদের শরীর মুবারককে গ্রাস করা যমীনের উপর আল্লাহ্ তা‘আলা হারাম করে দিয়েছেন। মি’রাজ শরীফে যাবার সময় হযরত মূসা আলায়হিস্ সালামকে প্রথমে তাঁর কবর শরীফে দাঁড়িয়ে নামায পড়তে দেখা, আবার বায়তুল মুক্বাদ্দাসে নবীগণের সাথে তাঁর নামায পড়া, আবার আসমানে সাক্ষাত পাওয়া, প্রতিটি আসমানে নবী-রাসূল আলায়হিমুস্ সালাম আমাদের প্রিয়নবীকে স্বাগতম জানানোর জন্য উপস্থিত থাকা, ইত্যাদি প্রমাণ করে নবীগণ ওফাত বরণের পরও সশরীরে জীবিত।
সহীহ মুসলিমে বর্ণিত আছে, “যে রাতে নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে মি’রাজ করানো হল সে রাতে তিনি হযরত মূসা আলায়হিস্ সালামের পাশ দিয়ে গমন করার সময় দেখতে পেলেনÑ তিনি নিজ কবর শরীফে নামায পড়ছেন।” (মুসলিম-৪৩৭৯)
প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,“নবীগণ আলায়হিমুস্ সালাম তাঁদের নিজেদের কবর শরীফে জীবিত এবং তাঁরা সেখানে নামায আদায় করেন। (আবূ ইয়া’লা:‘মুসনাদ’ ৬/১৪৭. ইমাম বায়হাক্বী:‘‘হায়াতুল আন্বিয়া”-৩)
তিনি আরও এরশাদ করেন,“আমি আমাকে দেখতে পেলাম একদল সম্মানিত নবী-রাসূলের সাথে। আর হযরত মূসা আলায়হিস্ সালামকে দেখলাম তিনি দাঁড়িয়ে নামায পড়ছেন। দেখলাম তিনি উপমাযোগ্য ব্যক্তি। তাঁর চুল কোঁকড়ানো, দেখে মনে হচ্ছিল- তিনি ‘শানুয়া’ স¤প্রদায়ের লোক। আবার দেখলাম হযরত ঈসা আলায়হিস্ সালাম দাঁড়িয়ে নামায পড়ছেন। ওদিকে হযরত ইবরাহীম আলায়হিস্ সালামও দাঁড়িয়ে নামায আদায় করছেন। তিনি দেখতে প্রায় আমার মতই। অত:পর নামাযের সময় এল। আর আমি তাঁদের সকলের ইমাম হিসেবে নামায আদায় করলাম।” (মুসলিম-১৭২)
হযরত সা‘ঈদ ইবনে মুসাইয়্যাব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বলেন, ‘হাররা’ (৬৩ হিজরীতে ইয়াযিদ বাহিনীর মদীনা শরীফ আক্রমন সময়কাল) -এর রাতগুলোতে আমি মসজিদে নববী শরীফে আশ্রয় নিলাম। তখন মসজিদে নববী শরীফে আমি ছাড়া আর কেউ ছিল না। কিন্তু যখনই নামাযের সময় হতো, তখন আমি প্রিয়নবীর কবর শরীফ থেকে আযান ও ইক্বামত শুনতে পেতাম। (দারামী ১/২২৮, ওফাউল ওফা ৪/১৩৫৬)
ইমাম জালাল উদ্দীন সুয়ূত্বী রাহ্মাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম এবং অন্যান্য নবী-রাসূলগণের নিজ নিজ রওযা শরীফে জীবিত থাকার বিষয়ের উপর ‘ইম্বাহুল আযকিয়া ফী হায়াতিল আম্বিয়া’ নামে একটি স্বতন্ত্র কিতার রচনা করেন। অনুরূপ ইমাম বাইহাক্বী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হিও এ বিষয়ে একটি স্বতন্ত্র পুস্তিকা রচনা করেন। পুস্তিকাটির নাম হল: “হায়াতুল আম্বিয়া আলাইহিমুস্ সালামু ফী ক্ববূরিহিম বা’দা ওফাতিহিম।” এ বিষয়ের প্রমাণ স্বরূপ তাঁরা অনেকগুলো হাদিস উল্লেখ করেন।
মে’রাজের সর্বশ্রেষ্ঠ উপহার হলো নামায: আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মিরাজে স্বীয় হাবিবকে যতগুলো হাদিয়া দিয়েছেন, তার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হলো নামায। যা মেরাজ রজনীতে মহান আল্লাহ পাক আমাদের প্রিয় নবীকে আরশে আযীমে ডেকে নিয়ে উপহার হিসেবে দিয়েছেন। আর এ জন্যই সালাত মুমিনদের জন্য মিরাজ স্বরূপ। বস্তুত নামায এমন একটি ইবাদত, যার মাধ্যমে রবের সাথে বান্দার সম্পর্ক সুদৃঢ় ও মধুময় হতে থাকে। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, বান্দা যখন নামায পড়ে তখন সে তার রবের সাথে নিভৃতে আলাপ করে। (বুখারী- ৪০৫)
আল্লাহ তাআলা তাঁর হাবিবের মানসিক অবস্থাকে বিবেচনা করে, এমন শান্তনার ব্যবস্থা করলেন; যাতে তাঁর সমস্ত দু:খ-কষ্ট, বেদনা-যন্ত্রণা হ্রাস পেয়ে গেল। ভূ-মন্ডল, নভোমন্ডল ভেদ করে, সপ্ত আসমান পাড়ি দিয়ে, সত্তর হাজার নূরের পর্দা অতিক্রম করে, আরশে আযীমে ডেকে নিয়ে, হাবিবের সাথে একান্ত আলাপ করে বুঝিয়ে দিলেন, দুনিয়ার অবুঝরা আপনাকে মূল্যায়ন না করতে পারে; কিন্তু আপনার মর্যাদা আমার কাছে সবার থেকে অনেক বেশী। এ ছাড়াও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মিরাজে রয়েছে উম্মতের জন্য অপূর্ব শিক্ষার সমন্বয়।

লেখক : বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ, সাদার্ন বিশ্ববিদ্যালয় খতীব, মুসাফিরখানা জামে মসজিদ