এমরান চৌধুরী
আর একদিন পরেই পবিত্র আশুরা। দিনটা এলেই সবার মনে পড়ে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের উদ্ধৃত চরণ দুটি। এ দুটো চরণে মহররম মাসে সংঘটিত মর্মস্পর্শী ঘটনার স্বরূপ আমাদের অন্তরকে নাড়া দেয়। আমাদের ভাবিত করে। আমাদের মনকে নিয়ে যায় ৬১ হিজরীর সেই শোকাবহ দিনে। নিয়ে যায় কারবালার সেই ঐতিহাসিক প্রান্তরে। দুনিয়ার সকল মুসলমানের জন্য দুঃখ, বেদনা ও অনন্ত ত্যাগের মহিমায় ভাস্বর সেই ফোরাত নদীর তীরে। পবিত্র আশুরা তাই বাংলাদেশসহ বিশ্বের ধর্মপ্রাণ মুসলমানের নিকট অবিস্মরণীয় দিন।
কারবালার সেই শোকাবহ ঘটনার স্মরণে প্রতি বছর সারা বিশ্বের মুসলমান মাত্রই পরম ভক্তি ও শ্রদ্ধার সাথে পালন করে পবিত্র আশুরা। ইসলামের উন্মেষকাল থেকে যত শাহাদাতের ঘটনা ঘটেছে তার মধ্যে ইমাম হোসাইন (রা.) এর শাহাদাত অত্যন্ত মর্মস্পর্শী ও তুলনাহীন। কারণ ইমাম হোসাইন (রা.) পাহাড়সম বিপদের সম্মুখীন হয়েছিলেন। একদিকে তাঁর পরম শ্রদ্ধেয় নানাজানের নূরানী রক্তে গড়া দ্বীন ইসলামকে সমুন্নত রাখা, অন্যদিকে নিজের ও পরিবারবর্গের প্রাণ বাঁচানোর প্রশ্ন। এমনই এক কঠিন মুহূর্তে ইমাম হোসাইন (রা.) মোটেই বিচলিত না হয়ে ধৈর্য্যের কঠোর পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। এমনই গুরুতর সংকট ও দুঃখের কঠিন পরীক্ষায় তিনি সিদ্ধান্ত নিতে এতটুকু দেরি করেননি। শেষ পর্যন্ত অকুতোভয় বীরের মতো, লড়াকু সেনাপতির মতো লড়াই করে নিজের জীবনকে আল্লাহর পথে দান করে তিনি শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করেন। ইমাম হোসাইন (রা.) এর এই অনন্য সুন্দর শাহাদাতের ঘটনার পেছনে রয়েছে বিষাদ সিন্ধুর বিষাদময় কাহিনি। এ কাহিনি কোনো কল্পনা বা রূপকথা নয়। রক্তের লাল বর্ণের মতোই জ্বলজ্বলে সত্য। ইসলামের ইতিহাসে সর্বোচ্চ আত্মোৎসর্গের ঘটনা এটি। যে ঘটনার কথা কেউ যদি একবার পড়া শুরু করে তাঁর কখনো শেষ না করে উঠতে মন চাইবে না। কারণ ঘটনাটা এতই মর্মস্পর্শী যে তা অনায়াসে ছুঁয়ে যায় অন্তর। আবেগে আপ্লæত হয়ে কখন যে দু’চোখে অশ্রæ টলমল করে ওঠে তা অনেক সময় টেরও পাওয়া যায় না। সত্যের জন্য, ন্যায়ের জন্য সর্বোপরি শান্তির ধর্ম ইসলামকে সমুন্নত রাখার জন্য ইমাম হোসাইন (রা.) এর এই শাহাদাত অনুপ্রাণিত করবে সত্যের জন্য আত্মোৎসর্গে যে কোনো মুহূর্তে সামনে এগিয়ে যাওয়ার।
মহররম মাসের ১০ তারিখের দিনটা নানা কারণে ইসলামের ইতিহাসে খুবই গুরুত্ব বহন করে। কারণ এদিনে সংঘটিত হয়েছে এমন অনেক দ্যুতিময় ঘটনা যা ইসলাম ধর্মের অনুসারী প্রত্যেক মানুষের জন্যে গৌরবময়। এ রকম কয়েকটি আলোকিত ঘটনা উদ্ধৃত করছি।
১. এদিনে পরম করুণাময় আল্লাহ পাক লাওহে মাহফুজ, সাগর, মহাসাগর, পাহাড় ও নভোমÐল সৃষ্টি করেছেন।
২. আদি পিতা হযরত আদম (আ.), হযরত হাওয়া (আ.), হযরত ইবরাহিম (আ.) ও হযরত ঈসা (আ.) এদিনে জন্মগ্রহণ করেন।
৩. এদিন হযরত আদম (আ.) বেহেশতে প্রবেশ করেন। ৪. হযরত আদম (আ.) এর আমল থেকে হযরত ঈসা (আ.) এর আমল পর্যন্ত এদিনটা ছিল ঈদের দিন।
৫. এদিন হযরত মুসা (আ.) তুর পাহাড়ে গমন করেন এবং এদিন তওরাত কিতাব অবর্তীর্ণ হয়।
৬. এদিনে মিশরের অত্যাচারী বাদশাহ ফেরআউন নীলনদে ডুবে মারা যান এবং হযরত মুসা (আ.) হেঁটে নীল নদ পার হন।
৭. এদিনেই হযরত নূহ (আ.) তাঁর কিস্তি নিয়ে জুদি পাহাড়ের ওপর অবতরণ করেন।
৮. এদিন হযরত আয়ুব (আ.) দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে শেফা লাভ করেন।
৯. এদিন পৃথিবীর বুকে সর্ব প্রথম রহমতের বৃষ্টি বর্ষিত হয় এবং
১০. এদিনে আল্লাহতাআলা হযরত ঈসা (আ.) কে মাটি থেকে আসমানে তুলে নেন।
পরবর্তীতে ৬১ হিজরির এদিনেই সংঘটিত হয় কারবালার সেই লোমহর্ষক, হৃদয়বিদারক ঘটনা। যে ঘটনার কথা হৃদয়ে আলোড়িত হলে ধর্মপ্রাণ মুসলমান মাত্রই শোকে মুহ্যমান না হয়ে পারেন না।
ইমাম হোসাইন (রা.) -এর এই মহান আত্মোৎসর্গের ঘটনার নেপথ্যে রয়েছে এক ঐতিহাসিক পটভূমি। সেই ঐতিহাসিক ঘটনার কথা সচেতন, ধর্মপ্রাণ পাঠকমাত্রই কম বেশি জানেন। আমি শুধু সেই ঐতিহাসিক ঘটনার চুম্বক অংশ উদ্ধৃত করার চেষ্টা করছি। যাতে আমাদের স্মৃতিতে কোনো ধরনের অস্পষ্টতা থাকলে তা পরিষ্কার হয়। আমাদের প্রিয় নবী, ত্রিভুবনের প্রিয় মহামানব হযরত মুহাম্মদ (স.) এর দৌহিত্র ইমাম হাসান (রা.) মুসলিম জাহানের শাসনকর্তা নিযুক্ত হলে দামেস্কের শাসনকর্তা দুরাচার এজিদের গাত্রদাহ শুরু হয়। সে তার আধিপত্য খর্ব হবার আশংকায় হযরত হাসান (রা.) ও হযরত হোসাইন (রা.) এর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে। এক ভয়ংকর ষড়যন্ত্রের জাল বুনে প্রথমেই সে কৌশলে বিষ প্রয়োগ করে ইমাম হাসান (রা.) কে হত্যা করে। ইমাম হাসান (রা.) এর শাহাদাতের পর থেকেই এজিদের সঙ্গে ইমাম হোসাইন (রা.) এর সংঘাত শুরু হয়। তিনি এজিদের বিরুদ্ধে লড়াই করার দৃঢ় প্রত্যয় ঘোষণা করেন।
কুফার অধিবাসীগণ ইমাম হোসাইন (রা.) কে সহায়তা করার আশ্বাস দিলে তিনি স্বল্প সংখ্যক সৈন্য নিয়ে কুফা অভিমুখে যাত্রা করেন। পথে কারবালা প্রান্তরে তিনি এজিদ বাহিনির অবরোধে পড়েন। শক্তিমান ইমাম হোসাইন (রা.) ঈমানী শক্তির জোরে এজিদের সৈন্যদের পরাজিত করেন। কিন্তু ফোরাত নদী এজিদ বাহিনির অধিকারে থাকায় তাঁরা এক ফোঁটা পানিও সংগ্রহ করতে পারলেন না। ইতিপূর্বে এজিদের সেনাপতি ফোরাতের তীরে সৈন্য সমাবেশ করে ফোরাত থেকে পানি সংগ্রহের সব পথ বন্ধ করে দেয়। ফলে ইমাম হোসাইন (রা.) এর শিবিরে মাসুম শিশু, বালক-বালিকা, মহিলাসহ বাহাত্তর জন মানুষের শুরু হয় পানির জন্য হাহাকার। পিপাসা নিবারণের এতটুকু পানি না পেয়ে প্রাণ হারালেন অনেকে। এমন কি এক ফোঁটা পানির জন্য ইমাম হোসাইন (রা.) এর ছয় মাসের মাসুম শিশু হযরত আসগর (রা.) যখন আর্তনাদ করছিলেন, তখন একটি তীর এসে তাঁর কচি বুক ঝাঁঝরা করে দেয়। এই ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তিনি পাপিষ্ঠ এজিদের নিকট আত্মসমর্পণ করার পরিবর্তে ধর্মযুদ্ধে আত্মদান করাকেই শ্রেয় মনে করলেন। দশদিন পর্যন্ত কোনো খাদ্য বা পানীয় না পেয়ে ইমাম হোসাইন (রা.) সামান্য ক’জন সৈন্য নিয়ে ফোরাত অভিমুখে যাত্রা করেন। তিনি ফোরাত ক‚ল মুক্ত করে যেই পানি পান করবেন, এমন সময় পানির অভাবে তাঁর শিশু ও পরিবারবর্গের করুণ মৃত্যুর কথা চোখে দৃশ্যমান হলো। তখন তিনি অঞ্জলির পানি ফেলে দিলেন। তাঁর আর পানি পান করা হলো না। এমন সময় একটা তীর এসে তাঁর শরীর বিদীর্ণ করলে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। তখন এজিদের সেনাপতি পাষন্ড সীমার এসে তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করে। এভাবে সমাপ্তি ঘটে কারবালার শোকাবহ ঘটনার যাতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হযরত মুহাম্মদ (স.) এর পবিত্র বংশধরদের সত্যের ওপর অটল দৃঢ়তা ও মহত্বের দৃষ্টান্ত – যা ইসলামের ইতিহাসে অভূতপূর্ব ও অনুসরণীয়।
ইমাম হোসাইন (রা.) ও তাঁর পরিবারবর্গের এ মহান আত্মদান আমাদের শিক্ষা দেয় অন্যায়, অসত্য ও অধর্মের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার। শিক্ষা দেয় বাতিলের সঙ্গে কোনো আপস নয়। শিক্ষা দেয় দ্বীন ইসলামকে চিরদিন কলুষমুক্ত ও সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে নিজের জীবনকে বিলিয়ে দেওয়ার। বর্তমানে সারা দুনিয়া জুড়ে চলছে মুসলমানদের ওপর নানা ষড়যন্ত্র। যে এজিদি শক্তি ইমাম হোসাইন (রা.) এর বিপক্ষে লড়েছিল, তার পেছনে পরোক্ষ মদদ ছিল ইসলামের শত্রুদের। বর্তমানেও ইসলামের শত্রুরা হাত গুটিয়ে বসে নেই, তারা সুযোগ পেলেই ছোবল মারবে। তখনকার মতো তারা এখনও নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। তাই কারবালার শোকাবহ ঘটনাকে মনে করে চোখের পানি ফেলার সময় এখন নয়। এখন দ্বীন ইসলামের পতাকাকে চির সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে সকল প্রকার বাতিলের মোকাবিলায় আমাদের মেধা ও মননকে উৎসর্গ করার উপযোগী করে গড়ে তোলার সময়।
লেখক : শিশুসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক