পূর্বদেশ ডেস্ক
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়েছেন শেখ হাসিনা। বাংলাদেশের ইতিহাসে তিনিই প্রথম কোনো সরকার প্রধান, যিনি পদত্যাগে বাধ্য হয়ে দেশ ছেড়ে চলে গেছেন। এর আগে বাংলাদেশের কোনো সরকারপ্রধান বা রাষ্ট্রপ্রধানের ক্ষেত্রে এমন ঘটনা ঘটেনি। সদ্য সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী গতকাল সোমবার সকালে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে দেশ ছাড়েন। যাওয়ার সময় সঙ্গে ছোট বোন শেখ রেহানাও তার সঙ্গে ছিলেন।
সূত্রের খবর, দেশ ছাড়ার আগে হাসিনা একটি ভাষণ রেকর্ড করে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেই সুযোগ তিনি পাননি।
কলকাতাভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আনন্দবাজার পত্রিকা লিখেছে, শেখ হাসিনাকে বহনকারী সামরিক হেলিকপ্টারটি আগরতলায় উড়িয়ে নিয়ে যান এয়ার কমোডর আব্বাস। তিনি ১০১ স্কোয়াড্রনের সদস্য।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে ৩৬ দিন আগে শিক্ষার্থীদের যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল তা সরকার পতনের আন্দোলনে রূপান্তরিত হওয়ার পর দেশজুড়ে সংঘাত আর তিন শতাধিক মানুষের মৃত্যুর মধ্যে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা ছাড়তে হল। একটানা সাড়ে ১৫ বছর ক্ষমতায় ছিলেন শেখ হাসিনা।
আন্তর্জাতিক ফ্লাইট রেকর্ড রাখা সংস্থা ফ্লাইট রাডার ২৪ ডট কমের বরাত দিয়ে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়া টুডে জানিয়েছ পদত্যাগের পর সেনাবাহিনীর একটি পরিবহন বিমানে করে দেশ ছেড়েছেন শেখ হাসিনা।
তাঁর দেশ ছাড়ার খবরের পর এজেএএক্স-১৪৩১ ফ্লাইটটি সবচেয়ে বেশি নজরদারিতে ছিল। ধারণা করা হচ্ছে, এই ফ্লাইটেই তিনি দেশ ছেড়েছেন। এজেএএক্স-১৪৩১ কল সাইনের বিমানটি মূলত বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি সি-১৩০ জে হারকিউলিস।
ফ্লাইট রাডারের তথ্যানুসারে, সি-১৩০ জে হারকিউলিস গতকাল বিকেলে বাংলাদেশ থেকে রওনা হয় এবং কলকাতার দিকে যেতে শুরু করে। পরে পথ পরিবর্তন করে নয়া দিল্লির দিকে রওনা হয়। বিকেল ৫টা নাগাদ বিমানটি উত্তর প্রদেশ রাজ্যের রাজধানী লক্ষেèৗয়ের আকাশে ছিল।পরে সেটি স্থানীয় সময় বিকেল ৫টা ৩৬ মিনিটে দিল্লির কাছে গাজিয়াবাদে ভারতের বিমানঘাঁটি হিন্দনে অবতরণ করে।
নয়া দিল্লি থেকে শেখ হাসিনা কোথায় যাবেন তা এখনো অনিশ্চিত। তবে সূত্র জানিয়েছে, তিনি ইউরোপের কোনো দেশে যেতে পারেন। অপর একটি সূত্র জানিয়েছে, তিনি লন্ডনে যেতে পারেন।
এক প্রতিবেদনে ভারতীয় গণমাধ্যম আনন্দবাজার জানায়, সদ্য পদত্যাগ করা শেখ হাসিনা ভারতে কোনো রাজনৈতিক আশ্রয় চাননি। প্রথমে শোনা গিয়েছিল, গতকাল রাতেই তিনি লন্ডনে রওনা হবেন। তারপর একটি অসমর্থিত সূত্র জানায়, ব্রিটেন হাসিনার রাজনৈতিক আশ্রয়ের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছে।
লকহিড সি-১৩০ জে হারকিউলিস চার ইঞ্জিন বিশিষ্ট টার্বোপ্রপ সামরিক পরিবহন বিমান। এই বিমানটি বহুমুখী ব্যবহারে নির্ভরযোগ্যতার প্রতীক হিসেবে পরিচিত।
প্রবল গণআন্দোলনে এখন পর্যন্ত হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ও শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়েছে। তবে এরশাদ দেশ ছাড়েননি। তিনি দেশেই ছিলেন। ২০০৬ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। তবে ওই সরকার নির্বাচন করতে না পারলে সেনা সমর্থিত তত্ত¡াবধায়ক সরকার দায়িত্ব নেয়। এরপর থেকে খালেদা জিয়াকে বিদেশে পাঠানোর কথা বলা হলেও তিনি যেতে রাজি হননি।
পদত্যাগ করার কয়েকদিন আগেই কার্যালয়ে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠকে তার পালানোর গুজব প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, ‘শেখ হাসিনা পালায় না।’
১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতার পর থেকে গত ৫৩ বছরে যারা সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন তাদের মধ্যে কেউ রাষ্ট্রপতি, কেউ প্রধানমন্ত্রী, কেউ প্রধান উপদেষ্টা আবার কেউ সামরিক শাসন জারি করে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে দেশ পরিচালনা করেছেন।
বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে রাষ্ট্রপতি এবং সরকারপ্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বপালন করেন। ১৯৯৫ সালের আগস্টের ১৫ তারিখে একদল সামরিক কর্মকর্তার হাতে শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হন।
শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাÐের পর আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা খন্দকার মোশতাক আহমদকে রাষ্ট্রপতির পদে অধিষ্ঠিত করা হয়। ওই দিনই দেশে সামরিক আইন জারি করেন। ওই বছরের ৬ নভেম্বর পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি থাকার সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। ওই দিন তিনি ক্ষমতাচ্যুত হন।
ওই সময় তিন নভেম্বরের অভ্যুত্থানে সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমান পদচ্যুত হন। অভ্যুত্থানের নেতা ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ নিজেকে সেনাপ্রধান ঘোষণা করেন এবং ছয়ই নভেম্বর তৎকালীন প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমকে রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত করেন। পর দিন খালেদ মোশাররফ নিহত হন। তখন সেনাপ্রধান পদে আবার আসেন জিয়াউর রহমান।
এরপর ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল প্রেসিডেন্ট সায়েমকে সরিয়ে নিজেই রাষ্ট্রপতি হন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। এর এক বছর গণভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন তিনি। ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে এক ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানে নিহত হন জিয়াউর রহমান। তাঁর মৃত্যুর পর রাষ্ট্রপতি হন আবদুস সাত্তার। তবে বেশিদিন ওই পদে থাকেননি তিনি। এক বছর পর সেনাপ্রধান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে তাঁর শাসনামল শেষ হয় ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর।
এছাড়া অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে সাহাবুদ্দিন আহমেদ, তত্ত¡াবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে বিচারপতি হাবিবুর রহমান, বিচারপতি লতিফুর রহমান, অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহমেদ ও ড. ফখরুদ্দিন আহমেদ দায়িত্ব পালন করে পরবর্তী সরকারের হাতে দায়িত্ব হস্তান্তর করেছেন।