মোহাম্মদ মুজিবুর রহমান নেজামী
মোহাম্মদ মুজিবুর রহমান নেজামী অধ্যক্ষ মাদরাসা এ তৈয়বিয়া অদুদিয়া সুন্নিয়া ফাযিল, চন্দ্রঘোনা।
সকল প্রশংসা মহান আল্লাহর জন্য যিনি জগৎ সমূহের প্রতিপালক। অজস্র সালাত ও সালাম বর্ষিত হোক বিশ্বকুল সর্দার হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা’লা আলাইহি ওয়া সাল্লাম’র উপর যিনি নিজ উম্মতের দরদী শিক্ষক হিসেবে প্রেরিত হয়েছেন। তাঁর পরিবার বর্গ, সাহাবী, তাবেয়ী, তবে ভাবেয়ী সহ অগণিত ইসলামি স্কলারদের উপর সালাম বর্ষিত হোক যাঁদের সাবলীল রচনাবলি ও নিবেদিত প্রাণ খেদমতের কারণেই ইসলামের এই দীর্ঘ সফল জয় যাত্রা। আল্লামা এস এম ইকবাল মোজাদ্দেদী (রহ), তাঁদেরই একজন ক্ষণজন্মা ইসলামি মনীষী। যিনি পটিয়া উপজেলার বাহুলী গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম শেখ পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। আমি হুজুরকে ছাত্র অবস্থায় শিক্ষক হিসেবে দেখার যেমন সৌভাগ্য নসিব হয়েছে তেমনি কর্মজীবনে হুজুরের অধীনে চাকুরী করার বিরল সৌভাগ্য ও নসিব হয়েছে। শিষ্য ও অধীনস্থ সহকর্মী হিসেবে আমি হুজুরের সানিধ্যে দীর্ঘ প্রায় ২০ বছর অতিবাহিত করার বিরল সুযোগ লাভ করেছি। যা আমার জীবনের সেরা প্রাপ্তি। আমি হুজুরের বর্ণাঢ্য জীবনের খন্ডিত অংশ পাঠকের সদয় অবগতির জন্য পত্রস্থ করছি।
আদর্শবান দয়ালু শিক্ষকঃ আনুমানিক ১৯৭৮-৮০ ইংরেজির দিকে তখন আমি চন্দনাইশ উপজেলার প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত একমাত্র সুন্নি প্রতিষ্ঠান জোয়ারা ইসলামিয়া সিনিয়র ফাযিল মাদরাসার জমাতে হাপ্তমের শিক্ষার্থী। হুজুর ভাইস প্রিন্সিপাল হিসেবে উক্ত প্রতিষ্ঠানে যোগদান করেছেন। ভাইস প্রিন্সিপালকে তখন নায়েব সাহেব এবং অধ্যক্ষকে সুপারিন্টেজেন্ট বলা হতো। ঐসময় ফাযিল শ্রেণিকে এস এস সি এর সমমান দেয়া হয়েছিল। হাপ্তামের ছাত্র বলে আমরা হুজুরের নিয়মিত ক্লাস পেতাম না। নায়েব সাহেব হিসেবে হুজুরের যোগদানে গোটা মাদরাসার সকল ছাত্রদের মধ্যে প্রাণ চাঞ্চল্য ফিরে এসেছে। হজুর বিলাসী জীবন যাপনে অভ্যস্থ ছিলেন। প্রতিদিন তিনি মাদরাসায় আসার সময় মাদরাসার সুপার আলহাজ্ব মরহুম মৌলানা মাহমুদুর রহমান (রহ) মাদরাসার মাঠ পেরিয়ে সামনের রাস্তায় তাকে বরণ করার জন্য চলে যেতেন। আবার ছুটির পরেও ঠিক একই ভাবে রাস্তায় গিয়ে হুজুরকে বিদায় দিতেন। একটি মাদরাসার সুপার ও সহ-সুপারের পরস্পরের প্রতি এই নিখুঁত সম্মান প্রদর্শন তখনকার উক্ত মাদরাসার সকল ছাত্র দীর্ঘ দিন মনে রাখবে। হুজুরের অমায়িক ব্যবহার, পরিচ্ছন্ন জীবন যাপন ও ছাত্রদের প্রতি পিতৃতুল্য ব্যবহারে সকল ছাত্র ছিল হুজুরের প্রতি সীমাহীন আকৃষ্ট। আমরা হুজুরকে মাঝে মধ্যে বদলি ঘন্টায় পেতাম। হুজুরের পাঠদান পদ্ধতি ও বাচনভঙ্গি খুবই চমৎকার ছিলো। পাঠদানের সময় সকল ছাত্র ছাত্রী গভীর মনোযোগী
হতো। ক্লাসে পিনপতন নীরবতা বিরাজ করতো। তবে হুজুর উক্ত মাদরাসার বেশি দিন ছিলেন না।
যোগ্য প্রশাসক ও সুদক্ষ বানিয়ে মাদরাসাঃ আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক আল্লামা এস এম ইকবাল মোজাদ্দেদী ছিলেন জমিদার পরিবারের সন্তান। সাধারণত জমিদার পরিবারের সন্তান ভোগবিলাস ও ব্যবসা-বাণিজ্যে বেশি ব্যস্ত থাকে। তবে হুজুর বিলাসী- আয়াশি জীবন ও ব্যবসা বাণিজ্য ত্যাগ করতঃ মাদরাসার শিক্ষকতা পেশা নির্বাচন করেন। মহান আল্লাহর হেকমত ছিলো যে তিনি তাঁর মাধ্যমে অনেক মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করবেন ও অনেক মানুষকে মাদরাসার শিক্ষকতায় নিয়োজিত করবেন। অধম প্রবন্ধকার তাঁদের একজন। তাঁকে চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী বৃহত্তম অনন্য সুন্নি দ্বীনি প্রতিষ্ঠান শাহচান্দ আউলিয়া আলিয়া মাদরাসার বানিয়ে সানি তথা দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়। উক্ত প্রতিষ্ঠান হুজুরের হাতেই ষোল কলা তথা পূর্ণতার শিখরে পৌঁছে।মাদ্রাসার অবকাঠামো নির্মাণ পরিবেশগত উন্নতি কামিল তথা স্নাতকোত্তর স্তরে উন্নীত হওয়া হুজুরের সুদক্ষ হাতের সংস্পর্শে
হয়েছিল। মাদ্রাসা পরিচালনার ক্ষেত্রে তার অন্যতম একটি নীতি ছিল যোগ্য দক্ষ ও মেধাবী শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া। তিনি যেসব প্রতিষ্ঠান চাকুরী করেছেন ওইসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কেবল মাত্র যে প্রতিষ্ঠানে আমি কর্মরত আছি উক্ত প্রতিষ্ঠানের আলোচনা করছি।
মাদ্রাসা এ তৈয়বিয়া অদুদিয়া সুন্নিয়ায় এটি রাঙ্গুনিয়া উপজেলার একেবারে পূর্ব প্রান্তে রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান পার্বত্য অঞ্চলের সীমানায় অবস্থিত। মুর্শিদে বরকত রাহনুমায়ে শরীয়ত ও তরিকত হযরতুলহাজ্ব কারি সৈয়দ মোহাম্মদ তৈয়ব শাহ (রহ), এর পবিত্র হাতে প্রতিষ্ঠিত। আনজুমান এ রাহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়ার তত্ত¡াবধানে পরিচালিত। ১৯৭৬ ইংরেজিতে মাদ্রাসাটি প্রতিষ্ঠিত হলেও যোগা, দক্ষ, বিচক্ষণ, একজন পরিচালক/ সুপার/ অধ্যক্ষের প্রয়োজনীয়তা মাদ্রাসাটি বারে বারে উপলব্ধি করছিলো। অবশেষে আনজুমান এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া হুজুরকে মাদ্রাসা প্রধান হিসেবে নির্বাচন করেন। হুজুর যোগদানের পূর্বে কর্তৃপক্ষকে কতিপয় শর্ত প্রদান করেন। তৎমধ্যে অন্যতম শর্ত ছিলো যোগ্য, দক্ষ ও মেধাবী শিক্ষক নিয়োগ দেয়ার ক্ষেত্রে হুজুরকে একক ক্ষমতা দেয়া। আনজুমান কর্তৃপক্ষ হুজুরের উক্ত শর্ত সদয় কবুল করলে তিনি উক্ত মাদ্রাসায় সুপার হিসেবে যোগদান করেন। ঐ সময় মাদ্রাসা দাখিল স্তর পর্যন্ত অনুমোদিত ছিলো। তিনি যোগদান করেই অল্প দিনের সধ্যেই আলিম স্তরে পাঠদান শুরু করেন। যোগ্য ও মেধাবী শিক্ষক নিয়োগ দেয়ার ক্ষেত্রে তিনি সক্ষমতা প্রদর্শন করেন। ঐ সময় তিনি মোশতাক আহমদ (যিনি বর্তমানে ঢাকা মোহাম্মদপুর কাদেরিয়ার শাইখুল হাদিস) নুরুল ইসলাম (যিনি বর্তমানে। দক্ষিণ চট্টগ্রামের অন্যতম প্রতিষ্ঠান গারাগিয়া আলিয়া মাদরাসার মুহাদ্দিস) শিক্ষাগুরু মরহুম কবির আহমদ যিনি শাহচান্দ আউলিয়া আলিয়ার সাবেক মুহাদ্দিস নিয়োগ দিয়েছেন। বিধি অনুসারে অল্প দিনের মধ্যে মাদ্রাসা আলিম স্তরে অনুমোদন ও এমপিও লাভ করে। এরপর তিনি ফাজিল স্তর খোলার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এ উপলক্ষে তিনি আমি অধম ও আব্দুল মান্নান যিনি বর্তমানে ফতেনগর অদুদিয়ার অধ্যক্ষ নিয়োগ দেন। খুব বেশি দিন অপেক্ষা করতে হয় নাই। ১৯৯১ইং সালের জুন মাস থেকে ফাজিল (স্নাতক) এর এমপিও লাভ করে। মাদ্রাসা পূর্ণতার শেষ স্তরে উপনীত হয়। তাঁর যুগেই মাদ্রাসা এ তৈয়বিয়া অদুদিয়া সুন্নিয়া রাঙ্গুনিয়ার শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি লাভ করে। আর ছাত্র সংখ্যা, অভ্যন্তরীণ পরীক্ষার ফলাফল, বোর্ড পরীক্ষার ফলাফল ও মাদ্রাসার অবকাঠামোগত উন্নয়নে তাঁর যুগই ছিলো উক্ত মাদ্রাসার সোনালী যুগ। তাই তিনি রাঙ্গুনিয়া উপজেলার শ্রেষ্ঠ অধ্যক্ষের উপাধী লাভ করেন। মাদ্রাসার বেদখল জায়গা তাঁর সুযোগ্য তত্ত¡াবধানে মাদ্রাসা দখল করতে সক্ষম হয়। মাদ্রাসার পশ্চিম পার্শ্বে বিশাল খানেকাহ শরিফ নির্মাণ তাঁর যুগেই হয়েছে। খানেকাহ সংলগ্ন অনেক দোকান নির্মাণ তাঁর পরামর্শে ও পরিশ্রমে সম্পন্ন হয়েছে। তৈয়বিয়া তাহেরিয়া নুরুল হক জরিনা মহিলা দাখিল মাদ্রাসা (যা মাদ্রাসা পুকুরের দক্ষিণ পার্শ্বে অবস্থিত) তার মেধা ও পরিশ্রমের ফসল। মাদ্রাসা পুকুরের উভয় পার্শ্বে জায়গা (যেখানে বর্তমানে তৈয়বিয়া কমপ্লেক্স অবস্থিত) তিনি উদ্ধার করেছেন। মাদ্রাসার মাঠের পূর্ব পার্শ্বে স্থাপিত তৈয়বিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়কে অন্যত্র স্থানান্তরের প্রস্তাব তিনিই দিয়েছেন।এক কথায় তৈয়বিয়া অদুদিয়া তাঁর দক্ষ হাতের সংস্পর্শেই বর্তমানের পূর্ণতায় উন্নীত হওয়া। তৈয়বিয়ার ইতিহাসে বিশাল স্থান তিনি দখল করে থাকবেন। এছাড়া রাঙ্গুনিয়া উপজেলা দক্ষিনে শিলক তৈয়বিয়া ছত্তারিয়া দাখিল মাদ্রাসা তাঁরই দিক নির্দেশনা পরিশ্রমে প্রতিষ্ঠিত হয়ে মঞ্জুরি লাভ করে। রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলায় কর্ণফুলী পেপার মিলের পার্শ্বে ক.চ.জ.ঈ তৈয়বিয়া দাখিল মাদ্রাসা তাঁরই প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠা ও মঞ্জুরী লাভ করে। তৈয়বিয়া মাদ্রাসার পূর্ব দিকের তোরণ সংলগ্ন মার্কেট তাঁরই স্বপ্নের বাস্তবায়ন। মাদ্রাসার পশ্চিম দিকের ও তোরণ সংলগ্ন দক্ষিণ পার্শ্বে অবস্থিত খানেকা শরীফের সংলগ্ন পশ্চিম মুখী দোকান গুলো তাঁর আমলের সংস্কার। তিনি উক্ত তোরণ সংলগ্ন উত্তর দিকে স্থাপিত তৈয়বিয়া কমপ্লেক্স এর ভূমির দখল নিষ্কণ্টক করার জন্য ঢাকা হাইকোর্টে মামলা করেন। দীর্ঘ অনেক বৎসর তিনি উক্ত মামলা পরিচালনা করে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছে যান। তিনি আজ মাদ্রাসায় নেই এমনকি তিনি আমাদের ছেড়ে পরম বন্ধুর সান্নিধ্যে চলে গেছেন কিন্তু তাঁর কৃতিত্ব ও কর্মের মাঝে তিনি অনেক দিন বেঁচে থাকবেন।চট্টগ্রাম বিভাগে যদি ১০ জন দক্ষ অভিজ্ঞ ও সফল অধ্যক্ষের তালিকা করা হয় তৎমধ্যে তিনি অবশ্যই একজন হবেন। তিনি তার অনেক ছাত্রকে শিক্ষকতা পেশায় নিয়ে এসেছেন। যার সংখ্যা সেঞ্চুরি অতিক্রম করবে সম্ভবত। মানুষ মরণশীল কিন্তু কিছু মানুষ মরেও অমর হয়ে থাকেন নিজ কর্মের মাঝে ও অগণিত ভক্ত, শিষ্য ও অনুসারীদের মাঝে। আমার চেতনার বাতিঘর, মাদ্রাসা শিক্ষার পথিকৃৎ আল্লামা এস. এম. ইকবাল মোজাদ্দেদী চলে গেলেও সারা দেশে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত অগণিত ছাত্রদের মাঝে বেঁচে থাকবেন অনেকদিন। তিনি ছিলেন বিখ্যাত চলে গেলেন বিখ্যাত দিন শুক্রবার তথা মুসলমানদের ঈদের দিন। রহমানুর রহিমের কাছে ফরিয়াদ তিনি যেন হুজুরকে জান্নাতের সুমহান স্থানে জায়গা করে দেন। আমিন।
লেখক : প্রাবন্ধিক