পটিয়ার বাতাসে ভয়ানক দূষণ দেখার কেউ নেই

1

রশীদ এনাম

প্রায় পনেরশ বছরের আদি শহর পটিয়া। পটিয়া উপজেলার আয়তন ৩১০.২৩ বর্গকিলোমিটার। পটিয়া শহরের আয়তন ৯.৯৬ বর্গ কিলোমিটার। প্রায় চারলক্ষ মানুষের বসবাস পটিয়া উপজেলায়। আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ ও প্রীতিলতার পটিয়া। প্রাচীনকাল থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধর্ম, বর্ণ, জাতি- গোষ্ঠী নির্বিবাদে বসবাস করে আসছে। একসময় সুদুর ইয়ামেন থেকে ইসলাম ধর্ম প্রচার করতে এসেছিলেন সুফিসাধক হযরত শাহচান্দ আউলিয়া (র.)। বহু গুণী, মনিষীর জন্মভূমি পটিয়া, চট্টগ্রামের সবচেয় উর্বরভূমি। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস ও পটিয়ার কথা বলে, ১৬/১৭ শতকে কোরেশি মাগন ঠাকুরের জন্ম চক্রশালা গ্রাম। উপমহাদেশবরেণ্য পুঁথিসংগ্রাহক আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের পটিয়া। শুধু তাই নয় শিক্ষা-দীক্ষা, সংস্কৃতি ও ইতিহাস-ঐতিহ্য পুঁথিসাহিত্যে স্বরূপতায় সমৃদ্ধ পটিয়া। একদা চট্টগ্রাম সরকারি বাণিজ্য কলেজের প্রয়াত অধ্যক্ষ শাফায়েত আহমেদ সিদ্দিকী স্যার পটিয়া সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘পটিয়া ইজ দা ব্রেইন বক্স অব চিটাগাং” বীরপ্রসবিনী পটিয়ায় জন্মেছিলেন, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের নায়ক মাস্টার দা সুর্যসেনের সহযোদ্ধা অগ্নিকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। সাবিত্রী দেবী, সুবোধ বল, লোকনাথবল প্রমুখ বিশ^খ্যাত ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবীরা এই অঞ্চল থেকেই জেগেছিলেন। পটিয়া নামটি শুধু বাংলাদেশে নয় উপমহাদেশে পরিচিত। শিক্ষা সাংস্কৃতির ক্ষেত্রেও এই অঞ্চলের অবদান বিশ^খ্যাত। আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ, কবি শশাঙ্ক মোহন সেন, শরচ্চচন্দ্র দাশ, কবিগুনা কর, নবীন চন্দ্র দাশ, যাত্রামোহন সেন, কালি শংকর চক্রবর্তী, জ্ঞানতাপস ড. আহমদ শরীফ, গণিতবিদ ড. আতাউল হাকিম, শিল্পী প্রফেসর সবিহ্ উল আলম, অর্থনীতিবিদ ড. নুরুল ইসলাম, হিসাববিদ ড. মুহাম্মদ নুরুল আলম, উপমহাদেশবরেণ্য গিটার জাদুকর আইয়ুব বাচ্চুসহ অনেক গুণীজনের জন্মভূমি পটিয়া।
দক্ষিন চট্টগ্রামের সৌন্দর্যরানির শহর ‘পটিয়া’ আজ দূষণের জাঁতাকলে পিষ্ট। দক্ষিণ চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহি পটিয়া উপজেলা শহর এখন ধূসর নগর। প্রতিনিয়ত শব্দদূষণ, বায়ুদূষণ, পানিদূষণ, থেমে নেই। যত্রতত্র ময়লা ফেলে পরিবেশ দূষণ সবমিলিয়ে চলছে পরিবেশ দূষণের উল্লাস। গত কয়েকবছর ধরে পটিয়া গৈড়লা মোড় এবং কৃষি ইশকুল এন্ড কলেজ উচ্চবিদ্যালয় এলাকায় ফুলকলি লিঃ এ কারখানার দূষিত বর্জ্যের পানি খালে এবং ধানী জমিতে প্রবেশের কারণে মারাত্বকভাবে পরিবেশ দূষিত হয়ে পড়েছে। বর্জ্যরে দুর্গন্ধ বেশ কয়েক মাইল ছড়িয়েছে। চট্টগ্রাম টু কক্সবাজার এলাকার যানবাহনে যাওয়ার হাজার হাজার যাত্রীদের পচা বর্জ্যরে দুর্গন্ধে দম বন্ধ হয়ে যায় এবং নাড়িবুড়ি বেড়িয়ে আসে। সবেচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ঐএলাকার কোমলমতি ইশকুল-কলেজ পড়–য়া ছাত্র-ছাত্রী এবং সর্বস্তরের জনসাদারণ। শুধু তাই নয় ঐ এলাকার আবাদিজমিতে চাষাবাদ এবং মাছ চাষেও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
অনেক লেখালেখি মানববন্ধন আন্দোলন হয়েছে। আজো তা বন্ধ হয়নি। পটিয়া পৌরসভায় পরিবেশ বান্ধব ডাম্পিং স্টেশন স্থাপন না করার কারণে পটিয়া পৌরসদরে আড়াকান সড়কের পাশে দীর্ঘদিন ধরে ময়লা আবর্জনার বার্গার পড়ে আছে। মাঝে মাঝে দেখি ময়লার আবর্জনার বার্গারের কালো ধোঁয়ায় বাহুলিগ্রাম সহ চারিদিকে ছড়িয়ে বায়ু দূষণ হচ্ছে। বিশ্রি গন্ধে বাহুলি গ্রামের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ছাত্র-ছাত্রীরা ক্লাশ করতে পারে না। ময়লার আবর্জনা আড়াকান সড়ক ছড়িয়ে শ্রীমতিখালেও পড়ছে এতে পানিও দূষিত হয়ে পড়েছে। যার ফলে পটিয়ায় কোমলমতি শিশুরা নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। বিষয়টি নিয়ে পূর্বে পটিয়ার জনপ্রতিনিধিদের জানানো হলেও তারা কোন সু ব্যবস্থা নিতে পারেনি।
পটিয়া সদরে ব্যাটারি রিকসা ও মোটর সাইকেলের শব্দদূষণ বেড়ে চলেছে প্রতিনিয়ত। যা মানবদেহের নীরব-ঘাতক সেটি অনেকে বোঝে না। কাগজী পাড়া ও ইন্দ্রপুল এলাকায় আড়াকান সড়ক ভেজা থাকে লবণভর্তি ট্রাকের পানি। রাস্তায় বেপরোয়া গাড়ি চালানো থেমে নেই। গাড়িতে অনেক যাত্রী নিয়ে চালকের আসনে বসে চালকরা অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নামে মরণ খেলায়। ফলে ঘটছে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা।
বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক দেশের পরিবেশ সংরক্ষণের লক্ষ্যে পরিবেশ সংরক্ষণ (সংশোধন) বিল ২০০২ এবং পরিবেশ আদালত (সংশোধন) বিল ২০০২ নামে দুটি আইন পাস করলেও পরিবেশ দূষণের বন্ধ সঠিকভাবে সমাধান মেলেনি। এবং বাস্তবায়নও হয়নি। বই পত্রে এবং জাতীয় দৈনিকে লেখালেখি, সেমিনার, মানববন্ধন সচেতনাতা বৃদ্ধির শর্তেও কমছে না পরিবেশ দূষণ। সমাধান ও মিলছে না পরিবেশ দূষণের দিন দিন মারাত্বক আকার ধারন করছে। পটিয়া শহরের বাতাসে ভয়ানক দূষণ যেন দেখার কেউ নেই। তলস্তয়ের থ্রি কোয়েশ্চনস বা তিনটি প্রশ্ন ছিল, প্রথম প্রশ্ন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ কে? দ্বিতীয় প্রশ্ন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ কী? তৃতীয় প্রশ্ন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় কী?
প্রথম প্রশ্নের উত্তর- যিনি আপনার সামনে আছেন, দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ মানুষের উপকার করা। তৃতীয় প্রশ্নের উত্তর হলো এখন। আসুন রাস্তায় যদি ময়লা আবর্জনা দেখি নিজ হাতে তা কুড়িয়ে নিয়ে ডাস্টবিনে ফেলব। রাস্তায় গর্ত দেখলে নিজ হাতে মাটি দিয়ে ভরাট করে দিব। মানুষকে সচেতন করতে সবসময় মানুষের কল্যাণে এবং পরিবেশ রক্ষায় সবার আগে এগিয়ে যাব। পরিবেশ দূষণ থেকে রক্ষার জন্য আমরা নির্দিষ্ট স্থানে ময়লা- আবর্জনা ফেলার ব্যবস্থা করতে পারি। বেশি বেশি করে গাছপালা লাগিয়ে পটিয়াকে সবুজায়ন করতে পারি পাহাড় কাটা এবং শ্রীমতি খাল থেকে বালি উত্তলন বন্ধ করতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। ‘তুমি আমি হলে সচেতন, হবে না পরিবেশ দূষণ’, কবি বলেছেন, একা হলে হারি আর এক হলে পারি তাই আসুন প্রতিজ্ঞা করি আমাদের পরিবেশ আমরাই একত্রিত হয়ে রক্ষা করব।
আমরা স্বপ্ন দেখি পটিয়া উপজেলায় চারলক্ষ মানুষের আট লক্ষ হাত একত্রিত করে সুন্দর একটি পরিবেশবান্ধব দক্ষিণ চট্টগ্রামের মডেল শহর পটিয়া গড়তে চাই। এজন্য প্রয়োজন সচেতনতা এবং ডাম্পিংস্টেশন স্থাপনকরাসহ, যে সকল কল-কারখানা আড়াকান সড়কের পাশে অবস্থিত তাঁদের কে জরুরিভিত্তিতে যত্রতত্র বর্জ্যে ফেলা বন্ধ করতে হবে এখনই। এব্যাপারে পরিবেশ মন্ত্রণালয় ও পটিয়া উপজেলা প্রশাসনের সু-দৃষ্টি কামনা করছি।
লেখক : কলামিস্ট ও প্রাবন্ধিক