পটিয়ায় দখল-দূষণে মৃতপ্রায় শত বছরের খাল

2

কাউছার আলম, পটিয়া

দখল, দূষণে নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে পটিয়া পৌরসভার অভ্যন্তরের বেশ কয়েকটি খাল। দীর্ঘদিন ধরে খনন না করায় নাব্যতা হারানো খালগুলো এখন ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। পানির প্রবাহ স্বাভাবিক না থাকায় সৃষ্টি হচ্ছে জলাবদ্ধতা। এতে বর্ষা মৌসুমে রোগবালাইসহ বিভিন্ন ভোগান্তিতে পড়েছে পৌরবাসী। সেসব খালগুলোর মধ্যে মরা খালটি নিশ্চিহ্ন প্রায়।
এদিকে অবৈধ স্থাপনার তালিকা তৈরিসহ দখল ও দূষণমুক্ত করতে প্রশাসন একাধিকবার উদ্যোগ নিলেও দখলদারদের চাপে বারবার ভেস্তে গেছে সেসব উদ্যোগ। সরকারি তফসিলভুক্ত রেকর্ডীয় খালগুলো দখলমুক্ত এবং পুনঃখনন করে ভোগান্তি নিরসনের দাবি পৌরবাসীর। শুধু গতানুগতিক আশ্বাস নয়, বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছে পৌরবাসিন্দারা। সর্বশেষ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) খালটি খননের উদ্যোগ নিয়ে দখলদারদের বাধায় অসমাপ্ত রেখেই কাজ সমাপ্তের ঘোষণা দিয়েছে। এতে করে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্থানীয়রা।
শত বছরের প্রাচীন চাঁনখালী খালের সংযোগস্থল মরা খালটি পটিয়া পৌরসভার বাহুলী থেকে চাঁনখালী খাল পর্যন্ত দৈর্ঘ্যে প্রায় ৪ কিলোমিটার। বাহুলী থেকে শুরু হয়ে পটিয়া বাইপাস সড়ক অতিক্রম করে বাকখালী হয়ে গিয়ে মিশেছে চাঁনখালি খালে। বিগত সরকারের অপরিকল্পিত কিছু উন্নয়ন, দখল ও দূষণে হারিয়ে যাচ্ছে এ খালটি। এরই মধ্যে পটিয়া বাইপাস অংশ এলাকায় প্রভাবশালী সুমন নামের এক দখলদার খালটির বেশ কিছু অংশে সীমানা প্রাচীর নির্মান করে বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণের কাজ করছেন। এতে ভরাট হয়ে গেছে খালটির একাংশ।
তথ্য অনুযায়ী, পটিয়া পৌরসভার তফসিলভুক্ত যে কয়েকটি খাল রয়েছে তার মধ্যে জনগুরুত্বপূর্ণ এই মরা খাল। তালিকাভুক্ত খালের দৈর্ঘ্য প্রায় ৪ কিলোমিটার। এসব খালের সীমানার মধ্যে শতাধিক পাকা ইমারত এবং সহ¯্রাধিক টিন-কাঠের স্থাপনা রয়েছে। ময়লা-আবর্জনায় ভরা খালটি এখন মৃতপ্রায়।
সরেজমিনে পৌর শহরের মরা খাল ঘুরে দেখা গেছে, পটিয়া পৌর সদরের বাহুলী এলাকার পাশে বয়ে চলেছে মরা খালটি। সেই খালটি বাসস্টেশন এলাকায় পটিয়া সরকারি কলেজের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে। পুরো খালের দুই তীরজুড়ে দখলের স্পষ্ট ছাপ। উভয় তীরে রয়েছে এ রকম অসংখ্য কাঁচা-পাকা স্থাপনা।
স্থানীয় পৌরবাসীর মতে, খালটি একসময় ৩০-৩৫ ফুট চওড়া থাকলেও বর্তমানে রয়েছে মাত্র ৮-১০ ফুট। তাও প্রতিনিয়ত দখলের চেষ্টা করছে প্রভাবশালীরা। দীর্ঘদিন খনন না করা এবং নিয়মিত ময়লা ফেলায় নাব্যতা নেই বললেই চলে। একসময়কার প্রবাহমান খালটি এখন নালায় পরিণত হয়েছে।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা খাল দখল করে বড় বড় পাকা ভবন তৈরি করেছে। ফলে বর্ষাজুড়েই জলাবদ্ধতা থাকে। ওই সব এলাকার বাসিন্দারা বাসা ভাড়া দিতে পারে না। একবার বৃষ্টি হলেই হাঁটুপানি হয়ে যায়। পানি নিষ্কাশনের কোনো অবস্থা নেই।
আবু তাহের নামের এক বাসিন্দা বলেন, পৌরসভার ভেতর দিয়ে মরা খালটি আমাদের বাপ-দাদার সময়কার। এখন মরে গিয়ে খাল চেনার উপায় নেই। বর্ষা মৌসুমে পানি নামতে না পারায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। এতে সবাইকে দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে। সাথে মশা-মাছির উপদ্রুব বেড়ে গেছে। জামাল উদ্দিন নামের এক ব্যক্তি বলেন, কোথাও দখল, আবার কোথাও যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা ফেলে পুরনো খালটি মেরে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে। এসব রেকর্ডীয় খাল দখলমুক্ত করে পুনঃখনন ও সংস্কার করা প্রয়োজন।
পৌর শহরের আরেক বাসিন্দা বয়োবৃদ্ধ সোলাইমান হোসেন বলেন, এই পৌরসভার মধ্যে একটা খালেও পানির স্বাভাবিক প্রবাহ নেই। খালগুলো এখন মৃতপ্রায়। বিভিন্ন সময় মেয়র, ইউএনও, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও ডিসি অফিসে যোগাযোগ করেছি। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। খালগুলো যদি এভাবে মরে যেতে থাকে, তাহলে পৌরসভায় বসবাসের অনুপযোগী হয়ে উঠবে।
স্থানীয়রা আরও জানান, শত বছরের প্রাচীন চাঁনখালী খালের শাখা ‘মরা খাল’ নামের সংযোগ খালটি পটিয়া পৌরসভার বাহুলী থেকে চাঁনখালী খাল পর্যন্ত বিস্তৃত। বিগত সরকারের অপরিকল্পিত কিছু উন্নয়ন, দখল ও দূষণে হারিয়ে যাচ্ছে এ খালটি। মরা খালটি পটিয়া বাইপাস সড়কে শতাধিক অবৈধ স্থাপনা নির্মাণের ফলে খালটির অস্তিত্ব একেবারেই নেই বললেই চলে। সড়ক সম্প্রসারণ ও অবৈধ দখলদারত্বের কারনে খালটির বেশিরভাগ অংশ ভরাট করা হয়। বাকি অংশ নিকটতম জায়গার মালিক ও কিছু অসাধু চক্র অবশিষ্ট অংশ ভরাট করে দখলে নিয়েছে। পৌরসভার বেশির ভাগ অংশে পুরো খাল ভরাট করে ফেলা হয়েছে। এতে ওই এলাকার পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে গেছে। সেচ সংকটে পড়েছে কৃষি জমি। নষ্ট হয়েছে প্রাকৃতিক মাছের উৎস। খালটি পুরোপুরি ভরাট হয়ে যাওয়ায় উপজেলার সহ¯্রাধিক একর কৃষি জমির উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
পটিয়া পৌরসভার সহকারী প্রকৌশলী মিজানুর রহমান বলেন, পৌরসভার ৯টি ওয়ার্ডে যে কয়টি খাল রয়েছে। এগুলোর মধ্যে অনেকগুলোই অবৈধ দখলে। আবার অনেকের নামে রেকর্ড হয়ে আছে। স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে। আমরা যখন এসব এলাকায় কোনো কাজ করতে যাই তখন বাঁধার মুখে পড়ি। মরা খালটি খনন করার জন্য আমরা পাউবোকে চিঠি দিয়েছিলাম। তারাও খনন কাজ শুরু করেছিলেন, কিন্তু কেন আবার বন্ধ হয়েছে তা আমার জানা নেই।
মরা খাল এলাকায় বর্তমানে সৃষ্ট জলাবদ্ধতা নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে এ প্রকৌশলী বলেন, বর্তমানে পৌরসভার হাজীর পাড়া এলাকায় একটি কালভার্ট নির্মাণের কাজ চলছে। তাই ঐ এলাকায় জলবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে বলে দাবি তার। খালটির দুই পাশে অবৈধ দখলদারত্ব নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি আরও বলেন, এখানে অনেকগুলো বিষয় আছে। যেটা আমরা খাল বলছি সেটা বাস্তবে খাল না। এটা পৌরসভার সিটে মৌজায় আর খাল হিসেবে নাই। দেখা যাচ্ছে কারো না কারো নামে কিছু কিছু অংশে রেকর্ড হয়ে আছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) পটিয়ার উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মো. আনিস হায়দার খান বলেন, পৌরসভার মরা খালটি পুন:খনন কাজ শুরু করেছিলাম। বাপাউবোর নিয়মিত মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ বাজেট থেকে খালটি পুনঃখননের কাজ গ্রহণ করা হয়েছিল। নির্ধারিত মেয়াদে স্থানীয় নানা বাঁধা-বিপত্তির কারণে খালটি যতটুকু খনন সম্পন্ন করা সম্ভব হয়েছে সে অবস্থায় কাজটি সমাপ্ত ঘোষণা করতে হয়েছে। ভবিষ্যতে উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় অবশিষ্ট সম্পূর্ণ দৈর্ঘ্যরে খালটির খনন কাজ বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হবে।
পটিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও পৌরসভার প্রশাসক ফারহানুর রহমান বলেন, পৌরসভার ভেতরের খালগুলো কিভাবে পুন:খনন করা যায় সে ব্যাপারে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাথে কথা বলব। আর খাল দখলের ব্যাপারটি সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে নিয়ে সরেজমিনে দেখার পর আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।