দেরিতে হলেও পাটিয়ার চারটি ইউনিয়নকে পানি সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে ঘোষণা করে সরকার হতাশার দিগন্তে আলো ফুটিয়েছে। পটিয়াবাসীর দীর্ঘদিনের দাবি ছিল, পানির অতি সংকটাপন্ন চারটি ইউনিয়নকে যেন সরকারিভাবে ‘সংকটাপন্ন’ ঘোষণা করে বিশুদ্ধ পানির দ্রুত ব্যবস্থা করা হয়। সর্বশেষ নানা জটিলতা কাটিয়ে সরকার যে উদ্যোগ নিয়েছে, তাতে ভুক্তভোগী এলাকাবাসী আনন্দিত ও উৎফুল্ল। তবে এরসাথে সরকারের নির্দেশনাগুলো সঠিকভাবে প্রতিপালন হচ্ছে কিনা, তা দেখার বিষয়। দক্ষিণ চট্টগ্রামের প্রবেশদ্বার ও প্রাচীন জনপদ পটিয়ার বেশ কয়েকটি ইউনিয়নের মানুষ দীর্ঘ প্রায় পাঁচ বছর ধরে বিশুদ্ধ পনিসংকটে ভুগছেন। সেইসাথে সেচ প্রকল্পের মাধ্যমে চাষাবাদ করাও অনেকটা বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে এলাকার ৪ লাখের অধিক মানুষ দীর্ঘদিন যাবৎ জীবন ও জীবিকা দুটোর হুমকির মুখে রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, শিল্পকারখানার গভীর নলকূপ ব্যবহার করে অীতরিক্ত পানি উত্তোলন, জলাশয় ভরাট করে ঘরবাড়ি নির্মাণ এবং টিউবওয়েলের বিকলতার কারণে গ্রামের পানির স্তর প্রতি বছর ৩ থেকে ৭ ফুট পর্যন্ত নিচে নেমে গেছে। হাবিলাস দ্বীপ, চরকানাই, হুলাইন, পাচুরিয়া ও হাবিলাসদ্বীপ ইউনিয়নের জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের ৩৫০টি টিউবওয়েলও কার্যকারিতা হারিয়েছে। ফলে কৃষিকাজ ব্যাহত হচ্ছে এবং বোরো আবাদে লবণাক্ত পানি ছড়িয়ে পড়ায় কৃষকরা ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়ছেন।
এ নিয়ে ভুক্তভোগী পটিয়ার মানুষ দীর্ঘ আন্দোলন করেও কোন প্রতিকার না পাওয়ায় সর্বশেষ উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হন। আদালতের নির্দেশের প্রেক্ষিতে পানি মন্ত্রাণালয়, চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক ও স্থানীয় প্রশাসন সংকট নিরসনে দ্রুত উদ্যোগ নেন। কর্তৃপক্ষ তদন্ত, জরিপ, সংকট ও সম্ভাবনার বিষয়গুলো খতিয়ে দেখে স্থানীয় প্রশাসন ও পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের পাঠানোর প্রতিবেদনের আলোকে সরকার মঙ্গলবার (২৮ অক্টোবর) পটিয়াকে পানি সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে সরকারি গেজেটে ঘোষণা করেছে। উল্লেখ্য যে, পানি সংকট মোকাবিলায় অংশীজনরা তিনটি প্রস্তাব রেখেছেন। এর মধ্যে রয়েছে, পরিবারভিত্তিক টিউবওয়েল স্থাপন বন্ধ করে কমিউনিটি ভিত্তিক টিউবওয়েল স্থাপন করা, শিল্পকারখানার জন্য হালদা নদীর মিঠা পানি সরবরাহের উদ্যোগ নেওয়া এবং বোয়ালখালীর ভান্ডালজুড়ি থেকে চট্টগ্রাম ওয়াসার পানি সংযোগ নেওয়ার উদ্যোগ।
এর আগে হাইকোর্টের নির্দেশনায় চারটি গ্রামকে অতি উচ্চ পানি সংকটাপন্ন ঘোষণা করা হয়েছিল। আদালত শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন থেকে বিরত থাকতে এবং দূষণ থেকে জনস্বাস্থ্য রক্ষা করতে নির্দেশ দিয়েছে। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়, পরিবেশ অধিদপ্তর এবং জেলা প্রশাসককে আটটি শিল্প প্রতিষ্ঠানের দূষণের পরিমাণ যাচাই করে ক্ষতিপূরণ আদায়ের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বাংলাদেশ পানি আইন, ২০২৩-এর ধারা ১৭ অনুযায়ী জলাধার ও পানি স্তর সংরক্ষণ এবং সুষ্ঠু পানি ব্যবস্থাপনার জন্য অতি উচ্চ, উচ্চ ও মধ্যম পানি সংকটাপন্ন এলাকা চিহ্নিত করা হয়েছে। পটিয়া পৌরসভার ৫টি মৌজা অতি উচ্চ পানি সংকটাপন্ন এবং ৩টি মৌজা উচ্চ পানি সংকটাপন্ন হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। উপজেলার ৩টি ইউনিয়নের ৭টি মৌজা অতি উচ্চ, ৯টি ইউনিয়নের ২৭টি মৌজা উচ্চ এবং ৮টি ইউনিয়নের ৩০টি মৌজা মধ্যম সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।
সেই সাথে সরকার কর্তৃক ঘোষিত যে ১১টি নির্দেশনা দেয়া হয়েছে তা কঠোরভাবে পালনের আদেশ জারি করা হয়েছে। নির্দেশনায় বলা হয়েছে, খাবার পানি ব্যতীত নতুন কোনো নলকূপ স্থাপন এবং বিদ্যমান নলক‚প থেকে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন বন্ধ রাখতে হবে। ভূগর্ভস্থ পানি নির্ভর শিল্প স্থাপন ও খাল, বিল, পুকুর, নদীসহ কোনো জলাধারের শ্রেণি পরিবর্তন করা যাবে না। জনগণের ব্যবহারযোগ্য জলাধর ইজারা দেওয়া ও জলস্রোতের স্বাভাবিক প্রবাহ বিঘ্নিত করা যাবে না। নদী ও জলাশয়ে বসতবাড়ি বা শিল্প প্রতিষ্ঠানের বর্জ্য নিষিদ্ধ করা হবে। এছাড়া অধিক পানি নির্ভর ফসল উৎপাদন সীমিত করে পানি সাশ্রয়ী ফসলের আবাদ করতে হবে।
আমরা মনে করি, সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ পটিয়া উপজেলার পানি ব্যবস্থাপনা ও জলাধার সংরক্ষণের জন্য প্রথমবারের মতো আইনি ভিত্তি তৈরি হলো। নির্দেশনা লঙ্ঘন দন্ডনীয় অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। পটিয়ার পানি সংকট নিরসনে সরকারের উদ্যোগ এবং আদালতের নির্দেশ কার্যকর হওয়ায় আশা করা যাচ্ছে, আগামী দুই বছরে এলাকাটির ভূগর্ভস্থ পানি স্তর পুনরুদ্ধার সম্ভব হবে। তবে সরকারের কঠোর নির্দেশণাগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা, তা স্থানীয় প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট বিভাগকে তদারকি করতে হবে। সেই সাথে এলাকার মানুষকে আরো সচেতন হতে হবে।











