মনিরুল ইসলাম মুন্না
পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দেয়া, টেন্ডার তৈরিতে অনিয়মসহ নানা কারসাজি করে আসছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) অঙ্গ প্রতিষ্ঠান মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেডের অসাধু কর্মকর্তারা। এমনই অভিযোগ ভুক্তভোগী ঠিকাদারদের।
প্রতিষ্ঠানটির জেনারেল ম্যানেজার অপারেশন্স মো. মফিজুর রহমান, জেনারেল ম্যানেজার এইচআর ইনাম ইলাহী চৌধুরী এবং সহকারী জেনারেল ম্যানেজার (পার্চেজ) মোহাম্মদ শরিফুল ইসলামের বিরুদ্ধে টেন্ডারে অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ দায়ের হয়। সম্প্রতি বেনামি একটি অভিযোগ দুর্নীতি দমন কমিশনে জমা পড়েছে।
অভিযোগে বলা হয়, মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেডের জেনারেল ম্যানেজার (অপারেশন্স) মো. মফিজুর রহমান, জেনারেল ম্যানেজার (এইচআর) ইনাম ইলাহী চৌধুরী ও সহকারী জেনারেল ম্যানেজার (পার্চেজ) মোহাম্মদ শরিফুল ইসলামের বিরুদ্ধে টেন্ডার বাণিজ্যের অভিযোগ অনেক আগে থেকে। কিন্তু বিপিসিতে অনেকবার অভিযোগ করা হলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। প্রতিষ্ঠানটি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে একুশটি কাজের জন্য দুইটি পদ্ধতিতে দরপত্র আহŸান করে। এর মধ্যে বিশটি ‘উন্মুক্ত দরপত্র’ পদ্ধতির (ওটিএম) মাধ্যমে এবং একটি টেন্ডার ‘ওএসটিইটিএম’ পদ্ধতিতে করা হয়। ওটিএম দরপত্রে নিয়ম অনুযায়ী যেসব ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানগুলো অংশগ্রহণ করবে, তারা শিডিউলের মোট মূল্যের ১০ ভাগ অর্থ কম বা বেশি দেখিয়ে দরপত্র দাখিল করে থাকেন। এক্ষেত্রে মেঘনা পেট্রোলিয়ামের কিছু কর্মকর্তার যোগসাজশে পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দিতে গোপন করা হয় শিডিউলের প্রকৃত মোট মূল্যের অংকের পরিমাণ। এতে মোট অংকের ১০ ভাগ অর্থ কম বা বেশি দেখিয়ে দরপত্র দাখিল করেও কাজ পাচ্ছে না অনেক প্রতিষ্ঠান। তাদের কৌশলের ফাঁদে পড়ে টাকা খরচ করে শিডিউল কিনে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন অনেক ঠিকাদার।
সরকারি স্বায়ত্বশাসিত মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেডের জেনারেল ম্যানেজার (অপারেশন্স) মো. মফিজুর রহমান, জেনারেল ম্যানেজার (এইচআর) ইনাম ইলাহী চৌধুরী, ও সহকারী জেনারেল ম্যানেজার (পার্চেজ) মোহাম্মদ শরিফুল ইসলামের কৌশলের মারপ্যাচে পড়ে নির্দিষ্ট কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বারবার কাজ পাচ্ছে। পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে দরপত্রের কাজটি পাইয়ে দিলে ওই কর্মকর্তারা আর্থিকভাবেও লাভবান হচ্ছেন। মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেডের গত তিন বছরের ৯১টি টেন্ডারের তথ্য বলছে ‘ওএসটিইটিএম’ পদ্ধতিতে ১৯টি দরপত্র আহবান করা হয়েছে। আর পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে অর্থের বিনিময়ে কাজ পাইয়ে দিতে বাকি টেন্ডারগুলো হয় ওটিএম পদ্ধতিতে। এর মাধ্যমে এম এস ইসলাম এন্টারপ্রাইজ একাই পেয়েছে ৯টি কাজ। এমএস আরিয়ানা ট্রেডিং, সামুদা কনটেইনার্স লিমিটেড ৫টি করে কাজ পেয়েছে। এছাড়া টিএস এন্টারপ্রাইজ, সু-কন্যা এন্টারপ্রাইজসহ বেশ কয়েকটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেডের জেনারেল ম্যানেজার (অপারেশন্স) মো. মফিজুর রহমান, জেনারেল ম্যানেজার (এইচআর) ইনাম ইলাহী চৌধুরী, ও সহকারী জেনারেল ম্যানেজার (পার্চেজ) মোহাম্মদ শরিফুল ইসলামের পছন্দের তালিকায় রয়েছে। যে কারণে ঘুরে ফিরে একই প্রতিষ্ঠানগুলো বারবার কাজ হাতিয়ে নিচ্ছে। ফলে হাজার হাজার টাকা খরচ করে তাদের কৌশলের কারণে দরপত্রে অংশগ্রহণ করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে অনেক ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান।
ঠিকাদারদের অভিযোগ, মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেডের কর্মকর্তারা উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতির (ওটিএম) মাধ্যমে দরপত্র আহŸান করলেও সেই দরপত্রের কাজ তাদের নির্দিষ্ট ঠিকাদার ছাড়া অন্য কেউ পায় না। মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেডের ঝালকাঠী ডিপোর বিভিন্ন কাজের একটি দরপত্রে অংশগ্রহণ করে ফারদিন বিল্ডার্স। দরপত্রের মোট মূল্য দেখানো হয় ৫২ লাখ ৮০ হাজার টাকা। ওটিএমের নিয়মে মোট মূল্য অনুযায়ী দরপত্র দাখিল করা হয়। কিন্তু দরপত্র খোলার পর দেখা যায় অফিশিয়ালি দরপত্রের মোট মূল্য ছিল ৫২ লাখ ৭৭ হাজার ৪৯ টাকা। অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে দরপত্রের এই প্রকৃত হিসাব আগে থেকে জেনে যাওয়ায় সর্বনি¤œ দরদাতা হিসেবে কাজটি পেয়েছে টি এস এন্টারপ্রাইজ।
মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেডের জেনারেল ম্যানেজার (অপারেশন্স) মো. মফিজুর রহমান, জেনারেল ম্যানেজার (এইচআর) ইনাম ইলাহী চৌধুরী ও সহকারী জেনারেল ম্যানেজার (পার্চেজ) মোহাম্মদ শরিফুল ইসলাম পছন্দের ঠিকাদারদের কাজ দিয়ে যে কমিশন নিচ্ছেন সে কমিশনার টাকা চট্টগ্রাম শহরে ও নিজ এলাকায় প্রচুর সম্পদ করেছেন। তাছাড়া নিজস্ব গাড়িতে করে মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেড এ অফিস করতে আসেন। তারা বিভিন্ন ব্যক্তি এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে ঘুষের টাকা বিনিয়োগ করেছেন।
দুর্নীতি দমন কমিশন যদি তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দাপ্তরিক অনিয়ম ও উল্লিখিত ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের নিকট কাজ দিয়ে কমিশন নিয়ে ঘুষের টাকা এবং অবৈধ সম্পদের বিষয়ে তদন্ত করা হলে সহজে তাদের অনিয়ম বের করা সম্ভব হবে।
অভিযোগটি বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা, দুর্নীতি দমন কমিশনের সচিব এবং দুর্র্নীতি দমন কমিশন চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ে অনুলিপি আকারে পাঠানো হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ঠিকাদার পূর্বদেশকে বলেন, ‘মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেডে আগে থেকে একটা চক্র কাজ করে যাচ্ছে। যারা বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়েও দাপটের সাথে ক্ষমতার অপব্যবহার করে যাচ্ছে। একজন দোষ করলেও বাকিরা সবাই এক হওয়াতে দোষটা ঢাকার জন্য সবাই এক হয়ে কাজ করেন। দুর্নীতি দমন কমিশন বা বিপিসি যদি নজরদারি করে, তাহলে থলের বিড়াল বেরিয়ে আসবে।’
অভিযোগের বিষয়ে জানতে মেঘনা পেট্রোলিয়াম করপোরেশন কার্যালয়ে গিয়ে তাদের সাথে কথা বললে তারা অভিযোগের বিষয়টি ভিত্তিহীন বলে দাবি করেন।
জেনারেল ম্যানেজার (অপারেশন্স) মো. মফিজুর রহমান বলেন, ‘আমরা ই-জিপির মাধ্যমে টেন্ডার পরিচালনা করি। এখানে পছন্দের মানুষকে কাজ দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। এস্টিমেটেড ভেল্যু থেকে ১০ শতাংশ যোগ-বিয়োগ হলে বাদ দেয়ার সুযোগ আছে বিধায় একটি পক্ষ তার কাক্সিক্ষত টেন্ডার না পেয়ে এসব ভিত্তিহীন কথা বলছেন। আমি শপথ করে বলতে পারি, আমার দুই কাধে ফেরেশতা আছে। কোনো অন্যায় কাজ করলে, তারা দেখতে পাচ্ছেন। সেই চিন্তা করে আমি দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছি।’
জেনারেল ম্যানেজার (এইচআর) ইনাম ইলাহী চৌধুরী বলেন, ‘আমাকে এখানে ভুলভাবে আনা হচ্ছে। এসবের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। আর আমার কি পরিমাণ সম্পদ আছে, তা সরকারকে আমরা ইনকাম ট্যাক্সে নিয়মিত প্রদান করছি। অভিযোগ যা বলা হচ্ছে, তা মনগড়া।’
সহকারী জেনারেল ম্যানেজার (পার্চেজ) মোহাম্মদ শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘এখানে যে ফারদিন বিল্ডার্সের কথা বলা হচ্ছে, তারা আমাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করেনি বলে লিখিত দিয়েছে। আর টেন্ডারের ডিজাইন, ইস্টিমেট, টেন্ডারিং মেথডসহ যাবতীয় কাজ করে ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ। তারপর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও জিএম হয়ে আমার কাছে আসে। তারপর ই-জিপিতে দেয়া হয়। আমি এ প্রক্রিয়ার সাথে কোনোভাবে জড়িত নয়।’
তবে এসব বিষয়ে জানতে সরাসরি মেঘনা পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. টিপু সুলতানের কক্ষে গেলে উনাকে পাওয়া যায়নি। পরে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা ও ক্ষুদে বার্তা পাঠানো হলে, তিনি কোনো সাড়া দেননি।