বিশ শতকের চল্লিশের দশকে উপনিবেশিক শাসক ব্রিটিশদের ইচ্ছায় মুসলিম শাসিত ফিলিস্তিনের ভূ-খন্ডে গড়ে উঠে ইহুদী বসতি। পরবর্তীতে আমেরিকা ও ব্রিটিশের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় মধ্যপ্রাচ্যে মুসলিম শাসকদের একক আধিপত্যের অবসান ঘটানোর সুদূরপ্রসারি পরিকল্পনার মাধ্যমে ইসরায়েল নামক রাষ্ট্র গঠন করা হয়। ক্রমান্বয়ে ষড়যন্ত্র, চক্রান্তের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি ও মুসলিম নেতৃত্বে বিভাজনের রেখা টেনে জেরুজালেম, গাজা ও রাফাহ এলাকায় ইসরায়েলিরা জোরপূর্বক বসতি স্থাপন করে। আমেরিকার নেতৃত্বে পশ্চিমা বিশ্বের এ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রায় সাত দশক ধরে যুদ্ধ করে আসছে মুক্তিকামী ফিলিস্তিনরা। কিন্তু বিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোর কোন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা এ বর্বরতার বিরুদ্ধে কঠোর ছিল না। এমনকি মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলোও ঐক্যবদ্ধ হয়ে ইসরায়েলি বর্বরতাকে রুখে দিতে সাহস করে নি। আমরা দীর্ঘ ষাট বছরে দেখে আসছি, মাঝেমধ্যে যুদ্ধ বিরতির চুক্তি, শান্তির চুক্তি হয়, কিন্তু কয়েকদির পর তা ভেস্তে যায়। কিন্তু একটি স্বাধীন দেশকে ইসরায়েল যে আগ্রাসন চালিয়ে ধ্বংস করে দিচ্ছে, একটি জাতিকে নিচ্ছিন্ন করে দেয়া হচ্ছে, তা কিন্তু কেউ বলছে না। সম্প্রতি ইসরায়েলি আগ্রাসনের মাধ্যমে একটি জাতির উপর যে হারে গণহত্যা চালানো হচ্ছে এবং শহরের পর শহর যেভাবে ধ্বংস করা হচ্ছে, তা বর্ণনা করা কোনো ভাষাই এখন আমাদের নেই। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী কর্তৃক গাজার বেসামরিক নাগরিকদের উদ্দেশ্যমূলক ভাবে লক্ষ্যবস্তু করার খবরও পাওয়া যাচ্ছে। ফিলিস্তিনের শিশুদের অসহায়ত্ব বিশ্ববাসীর বিবেককে নাড়া দিচ্ছে না কেন? এমন হাজারও প্রশ্ন আমাদের। বস্তুত ফিলিস্তিনের নিরীহ মানুষের ওপর ইসরায়েলের অব্যাহত বর্বরতা মানবসভ্যতার অর্জনগুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এর দায় বিশ্ববাসী এড়াতে পারে না। এ জঘন্য কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে বিশ্বের ক্ষমতাধরদের নীরবতা আমাদের বিস্মিত করে। তবে এ গণহত্যার বিরুদ্ধে বিশ্ববাসী সোচ্চার হয়েছে। ঐক্যবদ্ধভাবে সরব হয়েছেন বাংলাদেশের মানুষও। শনিবার ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি জানিয়ে আয়োজিত ‘মার্চ ফর গাজা’ সমাবেশে ফিলিস্তিনিদের ওপর বর্বরোচিত গণহত্যা বন্ধের দাবি জানিয়েছেন দেশের অসংখ্য মানুষ। ‘প্যালেস্টাইন সলিডারিটি মুভমেন্ট বাংলাদেশ’-এর উদ্যোগে ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরাইলের বর্বরতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ কর্মসূচিতে মানুষের ঢল মহাসমুদ্রে রূপ নেয়। এদিন ছিল না দল-মতের বিভেদ; রেষারেষি ভুলে পাশাপাশি হেঁটেছেন সবাই। কর্মসূচি ঘিরে ঐক্যের এক নতুন ইতিহাস তৈরি হয়েছে। অত্যাচারের বিরুদ্ধে মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাদের মত প্রকাশ করেছে। এ কর্মসূচিতে অংশ নিতে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে এসেছেন শিক্ষার্থীসহ সর্বস্তরের মানুষ। খন্ড খন্ড মিছিল রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জমায়েত হয়ে জনসমুদ্র তৈরি করে। আগামী ২৬ এপ্রিল ঢাকায় আরো একটি বড় প্রতিবাদ সমাবেশের খবর পাওয়া গেছে।
‘মার্চ ফর গাজা’ উপলক্ষ্যে আয়োজিত পদযাত্রা ও গণজমায়েত থেকে ২০ দফা ঘোষণাপত্র ও অঙ্গীকারনামা পেশ করা হয়েছে। এতে আন্তর্জাতিক বিশ্ব, মুসলিম উম্মাহ ও সরকারের প্রতি চার স্তরে দাবিগুলো তুলে ধরা হয়। আন্তর্জাতিক আদালতে ইসরায়েলের গণহত্যার বিচার নিশ্চিত করা এবং গণহত্যা বন্ধে কার্যকর সম্মিলিত পদক্ষেপ গ্রহণের দাবিও জানানো হয়। ফিলিস্তিনকে ১৯৬৭ সালের পূর্ববর্তী ভূমি ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য বাধ্যবাধকতা তৈরি করতে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহবান জানানো হয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকা নিয়ে ঘোষণাপত্রে বলা হয়, জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সব জাতির অধিকার রক্ষা, দখলদারি ও গণহত্যা রোধের সংকল্প প্রকাশ করে। এ কারণে ইসরায়েলের গণহত্যার বিচার আন্তর্জাতিক আদালতে নিশ্চিত করতে হবে। গণহত্যা বন্ধে কার্যকর ও সম্মিলিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণ, নিরাপত্তা ও রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার পথ উন্মুক্ত করতে হবে।
ইসরায়েলের কারণে অবরুদ্ধ ফিলিস্তিনিদের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে চরমভাবে। ক্ষমতার মোহে নিমজ্জিত বিশ্বনেতারা নীরব থাকলেও সাধারণ মানুষ এ নৃশংসতার প্রতিবাদ জানাচ্ছেন নিজ নিজ অবস্থান থেকে। বিশ্ববাসীকে এসব জঘন্য ও নৃশংস কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বাধীন সত্তাকে স্বীকৃতি দিয়ে ইসরায়েলি বর্বরতাকে এখানেই থামাতে হবে। মানবতার স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার মাধ্যমে গাজায় শান্তি ফেরাতে বিশ্বনেতারা কার্যকর পদক্ষেপ নেবেন, এমনটি প্রত্যাশা আমাদের।