নুরুল হক : একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার প্রতিকৃতি

1

নাসিরুদ্দিন চৌধুরী

মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য হিসেবে যাঁরা যুদ্ধ করেছেন, তাঁরা ছাড়াও বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইপিআর-এর অনেক সদস্য ছুটিতে থাকার কারণে ২৬ মার্চ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তাঁরা স্ব স্ব রেজিমেন্ট বা ঘাঁটিতে যোগদান করতে পারেননি। আবার অনেকেই পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণে মূল গ্রুপ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন। যেহেতু তাঁদের সামরিক ট্রেনিং ছিলো এবং অস্ত্র ছিলো, তাই তাঁরা মাতৃভ‚মির বিপদের দিনে হাত পা গুটিয়ে না থেকে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে মিলিত হয়ে যুদ্ধে নেমে গিয়েছিলেন। অনেকে আবার নিজেরাই গ্রুপ গঠন করে যুদ্ধ আরম্ভ করেছিলেন। সামরিক বাহিনী থেকে দলছুট হয়ে পড়া এমনি বেশ ক’জন এনসিও, জেসিও এবং সিপাহী মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে শোর্যবীর্য ও বীরত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে যাঁদের নাম আমি এ মুহূর্তে মনে করতে পারছি, তাঁরা হলেনÑ ক্যাপ্টেন করিম, সার্জেন্ট আলম, সুবেদার টি এম আলী, সুবেদার সোলয়মান, সুবেদার আবদুল লতিফ, সুবেদার সিরাজ, হাবিলদার নুরুল আলম, গোলাপুর রহমান, নায়েক আজিজুল হক, হাবিবুর রহমান, ওবায়দুল হক সিকদার প্রভৃতি। ক্যাপ্টেন করিম, সার্জেন্ট আলম, সবুর, হাবিবুর রহমান বিমান বাহিনীর লোক। এমনি একজন বৈমানিক নুরুল হক, যার বাড়ি ছিলো কর্ণফুলী নদীর তীরবর্তী সবুজে ঘেরা নয়নাভিরাম রাঙ্গুনিয়া থানার কোদালা গ্রামে।
১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করলে নুরুল হক মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। মুক্তিযুদ্ধে ১নং সেক্টরের অধীনে সেক্টর কমান্ডার মেজর রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম-এর নেতৃত্বে নুরুল হক গ্রæপ কমান্ডার হিসাবে রাঙ্গুনিয়া এলাকায় যুদ্ধ পরিচালনা করেন। মুক্তিযুদ্ধের এক পর্যায়ে ডিমাগিরি ২নং ইয়ুথ ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্য তাঁর ডাক পড়ে। তিনি সেখানে যান এবং মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেন। পরবর্তীকালে চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে যুদ্ধে অংশ নিয়ে সফল অপারেশন করে দেশকে শত্রুমুক্ত করেন।
নুরুল হক বীর মুক্তিযোদ্ধা ছাড়াও শিক্ষাব্রতী এবং সমাজকর্মী হিসেবে সুখ্যাত ছিলেন। ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দের ১০ জুন কোদালা গ্রামে তাঁর জন্ম। তাঁর পিতা আবদুল হামিদ, মাতা মেহেরাজ খাতুন। পিতামহ তুফান আলী ও মাতামহ নজু মিয়া তালুকদার।
নুরুল হক শৈশবে লেখাপড়া করেন কোদালা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ছোটবেলায় দুরন্ত প্রকৃতির হলেও তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। তাই শিক্ষকরা তাঁকে খুবই স্নেহ করতেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ালেখা শেষ করে ভর্তি হন শিলক বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে। বাড়ি থেকে প্রায় চার মাইল পায়ে হেঁটে তাঁকে বিদ্যালয়ে যেতে হত। পরে তিনি পটিয়া রাহাত আলী উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে ওই বিদ্যালয় থেকে ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে মানবিকে ২য় বিভাগে মেট্রিক পাস করেন। এরপর এইচএসসিতে ভর্তি হন কানুনগোপাড়া স্যার আশুতোষ কলেজে।
কলেজে অধ্যয়নকালে নুরুল হক ছাত্র রাজনীতিতে জড়িত হন। তিনি ছাত্রলীগে যোগ দেন, তাঁকে ছাত্রলীগ কলেজ শাখার সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব প্রদান করা হয়। ছাত্রাবস্থায় তিনি কোদালা চা বাগানে সংগঠিত শ্রমিক আন্দোলনে যোগ দেন এবং শ্রমিকদের দাবি আদায়ের পক্ষে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন। কলেজে ২য় বর্ষে পড়ার পর পারিবারিক আর্থিক অস্বচ্ছলতা ও পড়ালেখার প্রতি অনিচ্ছার কারণে তিনি পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে যোগ দেন। তিনি ১৯৫২ থেকে ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে অফিসার পদে চাকরি করেন। রাওয়ালপিন্ডি, পেশোয়ার, করাচীসহ আরো বিভিন্ন স্থানে দায়িত্ব পালন করেন। বিমান বাহিনীর চাকরি করতে তিনি উপলব্ধি করেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষ পূর্ববাংলার মানুষের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ সুবিধা ভোগ করছে। বিমান বাহিনীতে থাকাবস্থায় পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিকদের সাথে তাঁর যোগাযোগ থাকত। পূর্ব পাকিস্তানের মিটিং, মিছিল ও জনমত গঠনে অংশগ্রহণ সহ নানা কারণে পাকিস্তানের প্রশাসন তাঁর উপর ক্ষুব্ধ হয়। এ সময় বিমান বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাঁকে রোষদৃষ্টিতে দেখতে শুরু করে, তিনিও তাদের প্রতি খারাপ আচরণ করতে কুন্ঠাবোধ করেননি। একদিন খাবার টেবিলে বাক-বিতন্ডায় জড়িয়ে পড়লে তিনি একজন মেজরের গায়ে জগ ছুঁড়ে মারেন। এর জের ধরে কোর্ট মার্শাল করে তাকে চাকরি থেকে বহিষ্কার করা হয়। চাকরি থেকে অব্যাহতির পর ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে তিনি পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে আসেন। তখন পূর্ব পাকিস্তানের সামগ্রিক পরিস্থিতি ছিল অত্যন্ত উত্তেজনাকর। তুমুল ছাত্র আন্দোলনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চরম উত্তেজনা বিরাজ করছিল। এরমধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে তাঁর যোগাযোগ হয়। অবশ্য সামরিক বাহিনীতে থাকতেই বঙ্গবন্ধুর সাথে তাঁর এই যোগাযোগ গড়ে ওঠে। বঙ্গবন্ধু তখন ৬০-৬১ খ্রিস্টাব্দের দিকে বঙ্গবন্ধু পশ্চিম পাকিস্তানে গিয়েছিলেন এবং করাচীতে সোহরাওয়ার্দী কন্যার বাসভবন লাখাম হাউজে কিছুদিন ছিলেন। এই সময় তিনি সামরিক বাহিনীতে কর্মরত বাঙালি কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তারই এক পর্যায়ে নুরুল হকের সঙ্গে যোগাযোগ হয়।
তিনি ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে অয়্যারলেস অপারেটর হিসাবে চাকরি নেন। ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গবন্ধু ছয় দফা দেওয়ার পর এই কর্মসূচি মানুষের মধ্যে অভ‚তপূর্ব জাগরণ সৃষ্টি করে। ছয় দফার ভিত্তিতে সমগ্র দেশে তীব্র আন্দোলন গড়ে উঠলে এক উত্তাল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এসময় তিনি ঢাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে দেখা করলে তিনি তাঁকে দেশের স্বাধীনতার পক্ষে তার আন্দোলন চালিয়ে যেতে উদ্বুদ্ধ করেন। ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে আগরতলা মামলা দায়ের করা হলে সারা দেশের মানুষ তীব্র বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। নুরুল হকও ছয় দফা ও আগরতলা মামলা বাতিলের আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন এবং রাঙ্গুনিয়ায় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের কর্মীদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে জোরালো আন্দোলন সৃষ্টি করেন। ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি আওয়ামী লীগের রাঙ্গুনীয়া থানা শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন।
১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে তাঁকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ রাঙ্গুনীয়া থানা শাখার সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব প্রদান করা হয়। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁকে ব্যবসায়িক লাইসেন্স প্রদান করলেও ঐসবের আর্থিক সুবিধাদি তিনি তার এলাকায় আওয়ামী লীগকে সুসংগঠিত করার কাজে ব্যয় করেন। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট ঢাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করা হলেও বঙ্গবন্ধুকে হত্যার প্রথম ষড়যন্ত্র হয়েছিল রাঙ্গুনীয়া থানার চন্দ্রঘোনাস্থ মাহবুব আলম চাষীর পাহাড়ে। এই ষড়যন্ত্রের তথ্য পেয়ে বঙ্গবন্ধুর খুনিচক্রের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন নুরুল হক। ওই ষড়যন্ত্রের একাধিকবার বৈঠক ষড়যন্ত্রকারী মাহবুব আলম চাষীর চন্দ্রঘোনাস্থ খামার বাড়িতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। বৈঠকে তিনি চায়ের কাপ নিক্ষেপ করে ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান। হত্যার ষড়যন্ত্র চলছে এমন খবর ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর তৎকালীন রাজনৈতিক সচিব তোফায়েল আহমেদকে অবহিত করেছিলেন। পরে বঙ্গবন্ধুর সাথে সরাসরি দেখা করেও তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্রের কথা জানিয়ে দেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তখন নুরুল হক-এর কথায় গুরুত্ব না দিয়ে বলেছিলেন, “আমাকে কে মারবে, আমি তো কারো ক্ষতি করিনি।”
১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দে প্রথমবার ও ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয়বার তিনি অবিভক্ত শিলক ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে নিজ গ্রামে কোদালা উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি। বিভিন্ন মেয়াদে তিনি রাঙ্গুনিয়া কলেজ পরিচালনা পরিষদের দায়িত্বে ছিলেন। তিনি চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা ছিলেন। কোদালা পশ্চিম ধোপাঘাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, দক্ষিণ ধোপাঘাট বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, দক্ষিণ নোয়াগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, দক্ষিণ রাজানগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কোদালা খয়রাতি পাড়া জামে মসজিদ, শিলক তৈলাভাঙ্গা বিলে খালের দু’পাশে বাঁধ নির্মাণ, শিলক হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা, শিলক ইউনিয়ন পরিষদ ভবন নির্মাণ, অবিভক্ত শিলককে দু’ভাগে ভাগ করে কোদালাকে ইউনিয়নে রূপান্তরসহ বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক কাজ সম্পাদনে তিনি অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক। নিজ এলাকায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সমুন্নত রাখার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান ছিল ব্যাপক। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে লুটতরাজ, নারী নির্যাতন, সংখ্যালঘু নির্যাতন প্রতিরোধসহ ভারতের বাবরী মসজিদ ভাঙ্গাকালে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের সময় তিনি তাঁর এলাকা ও রাঙ্গুনিয়ায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টির চেষ্টা কঠোর হস্তে দমন করেন।
নির্লোভ, ত্যাগী ও সমাজের জন্য নিবেদিত এই দেশপ্রেমিক মহান ব্যক্তি ২০১১ খ্রিস্টাব্দের ১৭ জানুয়ারি রাত সোয়া ৯টায় রাঙ্গুনিয়ার কোদালায় নিজ বাড়িতে ৮৪ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক