চিকিৎসাবিদ ও পুষ্টিবিদগণ নুন খেতে অনুৎসাহিত করে থাকেন। পঞ্চাশ ষাট বছর আগেও বাঙালি সমাজের পাতে নুন রাখার রেওয়াজ ছিল। সাম্প্রতিক কালের পুষ্টি বিশেষজ্ঞদের প্রধান লক্ষ হলো খাদ্যে লবণ বা নুন / সোডিয়ামের মাত্রা কমানো। লবণ হচ্ছে সোডিয়াম ক্লোরাইড। তবে পটাশিয়াম ক্লোরাইড যা কিনা লবণ হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। বাজারে নো-সল্ট নামে যে লবণ বিক্রি হয়, তা আর কিছু নয়- তা হলো গিয়ে পটাশিয়াম। সোডিয়াম ক্লোরাইড ও পটাশিয়াম ক্লোরাইড এরা হলো যমজ ভাই। কিন্তু সোডিয়াম ক্লোরাইডকে কাঠগড়ায় তোলা হয়। কিন্তু কে শোনে কার কথা, ব্যঞ্জনে বা খাদ্যদ্রব্যে লবণ কম হলেই বিপদ। বিষাদ হয়ে পড়ে। গৃহিণীদের শুনতে হয় লাঞ্ছনা ও তিক্তকথা।
সাম্প্রতিক সময়ে বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে দেশের কোথাও কোথাও খরার প্রবণতা দেখা দেয়। বিশেষ করে সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলে খরা বেশি হওয়ায় এবার বাংলাদেশে লবণের বাম্পার উৎপাদন হয়েছে। লবণ উপকূলীয় অঞ্চলের একটি অর্থকরী ফসল। উপকূলীয় সংস্কৃতিতে এর ব্যাপক প্রভাব লক্ষণীয়। বাংলাদেশ ব-দ্বীপ হওয়াতে সাগরের সাথে তার নিবিড় সম্পর্ক। ফলত বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে তার প্রভাব পড়ে। নুন লবণ নিমক শব্দক্রয় সোডিয়াম ক্লোরাইডের বাংলা নাম। লবণ নিয়ে কিছু প্রবাদ প্রবচনের উল্লেখ করা যাক, (১) নুন খাই যার গুণ গাই তার, (২) নিমক খেয়ে নিমক হারামি (৩) নুন আনতে পান্তা ফুরায় (৪) গুণে নুন দিতে নেই-গুণের ঘাট নেই (৫) নুন আর খুনের দাম কমে আসছে (৬) লবণহীন ব্যঞ্জন আর ভক্তিহীন ভজন দুইই সমান (৭) লা লোহা লবণ বেচে যাবন ইত্যাদি। লবণের নানা ধরনের হলেও তার স্বাদ নোনতা। তবে পটাশিয়াম ক্লোরাইড বিকল্প নুন হলেও তার স্বাদ সোডিয়াম ক্লোরাইডের মতো নয়। এই নোনতাগুণের কারণে প্রাচীনকাল হতে গোসত, মাছ, শাক-সবজি ফলমূল সংরক্ষণে লবণ ব্যবহার হয়ে আসছে। উদাহরণত বলা যেতে পারে চাটগাঁইয়াদের নুনাইয়া ইলিশ।
মার্কিন এক ব্যবসায়ী ষাট ধরনের লবণ বিপণন করে বিশ্ববিখ্যাত হয়েছেন। রাসায়নিক গঠনের দিক থেকে তার উদ্ভাবিত লবণের ৯০ শতাংশই হলো সোডিয়াম ক্লোরাইড। আলুর চিপস, পপ্কর্ণ, ভাজা বাদাম, কেক,রুটি, পনির, আচারসহ নানান খাবারে ব্যবহারের জন্য তারা লবনের মিহি অতিমিহি পরিবর্তন এনে বাজার মাত করেছেন। সচরাচর আমরা যে লবণ খেয়ে থাকি, তা খাবারের গায়ে লেগে থাকে না। তাঁর উৎপাদিত সব লবণই খাবারের সাথে লেগে থাকে না। তাঁর উৎপাদিত সব লবণই খাবারের সাথে লেগে থাকে।
লবণকে স্বাস্থ্যহানিকারক হিসাবে অনেকেই মতামত দিলেও চিকিৎসাবিদদের অনেকের আবার এ নিয়ে মতভেদ আছে। সোডিয়াম উচ্চ রক্তচাপের জন্য দায়ি করার সাক্ষীসাবুদ তত জোরালো নয়। সম্প্রতি আমার বন্ধু অসুস্থতা হেতু হাসপাতালে ভর্তি হলে, চিকিৎসকরা পরামর্শ দেন তাঁর অসুস্থতার কারণ হলো, রক্তে সোডিয়াম কমে যাওয়া। তারপরও লবণ বা সোডিয়ামকে বদবস্তু বলে মনে করা হয়। চিকিৎসকরা বলছেন উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, ক্যান্সার ইত্যাদি যাই হোক না কেন তার অর্থ এই নয় লবণ খাওয়া মাত্রই মৃত্যু ঘটবে। তারপরও বলা হয়ে থাকে লবণ কমালে শরীরের জন্য ভালো। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ অনুযায়ী দৈনিক পাঁচ গ্রামের বেশিলবণ গ্রহণ করা উচিত নয়। চিকিৎসাবিদ ও স্বাস্থ্য বিদদের সতর্কতা সত্তে¡ও খাদ্য উৎপাদনকারী এবং খাদকের পিছুটান দিয়েছেন বলে নজির নাই। লবণ ব্যবহার চলছে এবং চলবেই। প্রাণীদের জন্য লবণ অপরিহার্য। বিকল্প হিসাবে পটাশিয়াম ক্লোরাইড ব্যবহার করা যেতে পারে।
এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে, বিশ্বে উৎপাদিত লবণের মাত্র ৬ শতাংশ খাবারের জন্য ব্যবহৃত হয়। ১২ শতাংশ কন্ডিশনার পক্রিয়ায় লাগে। ৮ শতাংশ ডি-আইসিং হাইওয়েতে ( বরফ অপসারণে) ৬ শতাংশ কৃষিতে ব্যবহার হয়ে থাকে। এছাড়াও কস্টিক সোড়া, ক্লোরিন, পিভিসি, কাগজের মন্ড এবং অন্যান্য অজৈব ও জৈবযোগে ব্যবহার হচ্ছে।
এতো গেল মানব জাতির ব্যবহার্য কাজের হিসাব। ধর্মীয় কাজেও লবণের ব্যবহার আছে। রোমান ক্যাথলিক রীতিতে পবিত্র পাণি তৈরীর প্রথাগত নিয়ম হল পানিতে লবণ মেশানো। ইহুদি ধর্মে শনিবার প্রার্থনার আগে তাঁরা নোনতা রুটি খেয়ে থাকে। পৌত্তলিক ধর্মে লবণ পৃথিবীর উপাদানের প্রতীক। এটা অশুভ ও ক্ষতিকর শক্তিকে পরিষ্কার করে বলে তাঁদের বিশ্বাস। মন্ডপে বা বেদির কাছে এক থালা লবণ ও এক থালা পানি রাখে। এছাড়াও বিভিন্ন ধরনের আচার অনুষ্ঠানে লবণ ব্যবহার হয়ে থাকে। হিব্রু বাইবেলে ৩৫ শ্লোকে লবণের কথা বলা আছে। বাইবেলের নতুন টেস্টামেন্টে ৬টি আয়াতে লবণের কথা আছে। যিশু তাঁর অনুসারীদের পৃথিবীর লবণ বলে উল্লেখ করেছেন।
এথেকে বোঝা যায়, লবণ শুধু খাদ্যে নয় ধর্ম ও সংস্কৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। সমাজে সৎ মানুষেরা যাঁর লবণ বা খাদ্য গ্রহণ করেন তাঁর গুণ সব সময় করে থাকে। যদি গুণ ও খুন সমাজে সহজলভ্য হয়ে গেছে। তথাপি কৃতজ্ঞ মানুষের অভাব নেই। তাঁরা সমাজে আছেন বলে সমাজ এখনো চলমান, স্থবির নয়।
লেখক : কবি, নিসর্গী ও ব্যাংক নির্বাহী (অব)