চন্দনাইশ প্রতিনিধি
চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের দোহাজারী পৌর সদরে বাস চাপায় নিহত ব্যাটারি রিকশা চালক রুহুল আমিনের ৬ কন্যা সন্তান অনিশ্চিত জীবনে পতিত হয়েছে। অসহায় হয়ে পড়েছে পুরো পরিবার। একটি দুর্ঘটনা কেড়ে নিয়েছে ৬ কন্যা সন্তানের ভবিষ্যতের স্বপ্ন। অন্যদিকে একই দুর্ঘটনায় নিজের ২ ছেলে-মেয়েকে হারিয়ে পাগলপ্রায় জসিম উদ্দিন ও তার স্ত্রী। বিলাপ করতে গিয়ে ক্ষণে ক্ষণে জ্ঞান হারাচ্ছেন তারা।
জানা গেছে, চন্দনাইশের দোহাজারী জামিজুরি গ্রামের রিকশাচালক রুহুল আমিন ১টি ছেলে সন্তানের আশায় পর পর ৬টি কন্যা সন্তানের জনক হন। অতি কষ্টে চলে রুহুল আমিনের ৮ সদস্যের সংসার। কিস্তিতে নেয়া রিকশা চালিয়ে দৈনিক ১ হাজার থেকে ১২’শ টাকা আয় করে টানাপোড়েনের সংসার চালান। ৪টি এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে নির্মাণ করেছেন বসতঘর। মাসে ৪ হাজার টাকা, সপ্তাহে ১৩’শ টাকা, ১৩’শ পঞ্চাশ টাকা, ১২’শ টাকা কিস্তি চালাতে হয় তাকে। স্ত্রী, ৬ কন্যা সন্তানের ভরণপোষণের একমাত্র ভরসা ছিলেন রুহুল আমিন। সারাদিন রিকশা চালিয়ে যা আয় হতো তা দিয়ে চলতো সংসার, লোনের কিস্তি ও কন্যাদের পড়ালেখার খরচ। এবার ৬ মেয়েকে ঈদের নতুন জামা-কাপড় কিনে দিয়ে যেতে পারেননি রুহুল আমিন।
রুহুল আমিনের ৬ কন্যা সন্তানের মধ্যে বড় মেয়ে উম্মে সুলতানা বিজ্ঞান বিভাগ নিয়ে এইচএসসি ১ম বর্ষে পড়ছে গাছবাড়িয়া সরকারি কলেজে। দ্বিতীয় মেয়ে তাসফিয়া সুলতানা রিপা দোহাজারী জামিজুরী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণিতে, তৃতীয় মেয়ে আলিফা জামিজুরী মাদ্রাসার ৪র্থ শ্রেণিতে, ৪র্থ মেয়ে ওয়াকিয়া ২য় শ্রেণিতে পড়ে। তার ৬ কন্যা সন্তান পিতাকে হারিয়ে শোকে বিহব্বল। মাত্র ২৮ দিনের নবজাতক ফাইজাসহ ৬ কন্যা সন্তানের দায়িত্ব নেবে কে- এমনটাই প্রশ্ন পাড়া-প্রতিবেশিদের। সংসারের একমাত্র উপার্জনকারী রুহুল আমিন সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর কারণে ৬ কন্যা সন্তানসহ পুরো পরিবারটি অনিশ্চিত জীবনের পথে ধাবিত হলো।
গতকাল শুক্রবার নিহত রুহুল আমিনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, জরাজীর্ণ দুই কক্ষের ছোট্ট একটি সেমিপাকা ঘর। ওই দুই কক্ষে কোনোভাবে বসবাস করতো পরিবারের সবাই। পিতার শোকে ৬ কন্যা সন্তানের কান্না যেন থামছেই না। বড় বোনের কোলে অঝোরে কেঁদে যাচ্ছে মাত্র ২৮ দিন বয়সী শিশুটিও যার নামটিও এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে রাখা হয়নি। আড়াই বছরের শিশু মা ফাতেমাসহ ৬ বোনের চোখের পানিতে ভাসছেন পাড়া-প্রতিবেশিরাও। এমন দৃশ্য যারাই দেখছেন চোখের পানি ধরে রাখতে পারছেন না কেউ।
নিহত রুহুল আমিনের ছোট ভাই রুহুল কাদের জানান, তার বড় ভাই বিগত দুই আড়াই বছর ধরে রিকশা চালিয়ে পরিবারের ভরণপোষণ ও মেয়েদের পড়ালেখার খরচ বহন করে আসছিল। বৃহস্পতিবার সকাল ৮ টার দিকে ভাড়া নিয়ে দোহাজারী সদরে গিয়েছিল। ঘাতক বাস তার ভাইয়ের রিকশার পেছনে চাপা দিলে ঘটনাস্থলেই তিনি মারা যান। এখন তার ছোট ছোট ৬ মেয়ের ভবিষ্যৎ কি হবে, কিভাবে পড়ালেখা করে বড় হবে কিছুই যেন জানা নেই তাদের। সাজানো গোছানো একটি সংসার ছিল। সবকিছু তছনছ করে দিয়ে গেছে ঘাতক বাসটি। ৬ কন্যা সন্তানের পুরো ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। ৬ মেয়ের জন্য ঈদের জামা-কাপড়ও কিনে দিয়ে যেতে পারেনি।
স্থানীয় মোহাম্মদ আবছারুল্লাহ বলেন, খুব ভালো মনের মানুষ ও পরিশ্রমী লোক ছিলেন রুহুল আমিন। ভাড়া দিক বা না দিক পথে যাকেই পেতেন তাকে তুলে নিতেন নিজের রিকশায়। ঘটনার পর পর চন্দনাইশ উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভ‚মি) ও দোহাজারী পৌর প্রশাসক ডিপ্লোমেসি চাকমা নিহত রুহুল আমিনের পরিবারে গিয়ে তার ৬ কন্যা সন্তানের খোঁজ-খবর নেন। পৌরসভার পক্ষ থেকে আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করার আশ^াস দেন। রুহুলের আমিনের পরিবারের পাশে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে অনেকেই এগিয়ে এসেছেন। গ্রীন চাটার্ড স্কুল অ্যান্ড কলেজ পরিচালনা পরিষদ নগদ ৫০ হাজার স্থানীয় স্থানীয় নাসির উদ্দীন ৫০ হাজার, সামাজিক সংগঠনের পক্ষ থেকে ৫০ হাজার, পৌর এলডিপির সভাপতি আইনুল কবির ১০ হাজার টাকা, দোহাজারী উচ্চ বিদ্যালয়ের ২০০৫ ব্যাচের শিক্ষার্থীরা ৩৩ হাজার জামায়াত নেতা চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. শাহাদৎ হোসেন ১০ হাজার টাকা প্রদানের পাশাপাশি বড় মেয়ের পড়ালেখার দায়িত্ব নেয়ার আশ^াস দেন।
অপরদিকে একই বাসের চাপায় একই পরিবারের ভাই-বোন মারা যায়। আদিল ও রিজভীর বাবা জসিম তার নিহত দুই সন্তানের কথা বলতে বলতে জ্ঞান হারাচ্ছেন। মা-বাবার প্রলাপে আশেপাশের লোকজনও কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। গত বৃহস্পতিবার রাতে জামিরজুরি মাদ্রাসা মাঠে হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতিতে জানাযা শেষে মসজিদের পাশে ভাই-বোনকে সমাহিত করা হয়। তার ৩ সন্তানের মধ্যে এখন একজন বেঁচে আছে।
মাত্র ৩০ সেকেন্ডের ব্যবধানে প্রাণে রক্ষা পাওয়া নিহত রিকশাচালক রুহুল আমিনের রিকশায় থাকা প্রত্যক্ষদর্শী ইসমত আরা ও তার ছেলে হাফেজ কামরুল ইসলাম জানান, রিকশাটি দুর্ঘটনাকবলিত হওয়ার মাত্র ৩০ সেকেন্ড পূর্বে আমরা মা-ছেলে রিকশা থেকে নেমে গিয়েছিলাম। না হলে লাশের সারিটা আরো দীর্ঘ হতো।
ইসমত আরা জানান, নিহতদের বাড়ির পাশেই আমার বাড়ি। প্রতিদিনের মতো সকালে জসিমের ছেলে আদিল ও মেয়ে রিজভীকে রিকশায় নিয়ে চালক রুহুল আমিন কোচিং সেন্টারে যাচ্ছিলেন। ছেলেকে কক্সবাজারের বাসে তুলে দেয়ার জন্য সকালে আমি গ্রামীণ সড়ক দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় তাদের দেখে রিকশাতে তুলে নেয় রুহুল আমিন। কিছুদূর যাওয়ার পর হেঁটে কোচিংয়ে যেতে দেখে তুশিনকেও ডেকে তুলে নেন তার রিকশায়। আমি, রিজভী, তুশিন ও আদিলের সাথে রিকশার পেছনে গাদাগাদি করে বসি। আর রিকশার সামনে চালকের সাথে বসেন আমার ছেলে হাফেজ কামরুল ইসলাম। দোহাজারী পৌর সদরে পৌঁছালে আমি ও আমার ছেলে কামরুল ইসলাম দুর্ঘটনাস্থল থেকে মাত্র ৩০ গজ দূরে সড়কের অপর প্রান্তে নেমে পড়ি। এসময় ভাড়া দিতে চাইলেও পরে নিবেন বলে সামনে চলে যান রুহুল আমিন। রিকশাটি কোচিং সেন্টারের দিকে যাওয়ার সময় পেছন থেকে চাপা দেয় দ্রুত গতির ঘাতক বাসটি। আমি দৃশ্যটি দেখি। রিকশায় চাপা পড়েছিল আদিল, রিজভী, তুশিন ও চালক রুহুল আমিন। আর এক মিনিট সময় পেলেই তারা হয়তো কোচিং সেন্টারে ঢুকে যেতে পারতো। বেঁচে যেতো সবার প্রাণ। ইসমত আরা কোনোভাবেই বিশ্বাস করতে পারছে না এমন হৃদয় বিদারক দৃশ্যের সাক্ষী হবেন।